অগ্নি রায় তাঁর ‘কূটনীতির স্নায়ুযুদ্ধ’ (৮-৪) প্রবন্ধে ভারতের বিদেশনীতি নিয়ে যে মনোজ্ঞ পর্যালোচনা করছেন তা বেশ কিছু ভাবনার অবকাশ রাখে। কে না জানে, বর্তমানে ভারতের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক মধুর নয়। পাকিস্তান বা বাংলাদেশের কথা তো ছেড়েই দেওয়া হোক, শ্রীলঙ্কা, মায়ানমার, মলদ্বীপ, এমনকি নেপাল, ভুটানের মতো দেশও ভারতকে আর তাদের দাদা বা বন্ধু হিসাবে মান দিতে চাইছে না। একেই ভারতের সঙ্গে সীমান্ত নিয়ে সমস্যা তৈরি করছে চিন, তার উপর চিনের আগ্রাসন নীতি এবং তার ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে চিনের সীমান্তে ভারতকে সর্বদা ব্যতিব্যস্ত থাকতে হয়।
শেখ হাসিনার আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে আমাদের দেশের সোনালি সম্পর্ক ছিল এ কথা অনস্বীকার্য। কিন্তু তার সঙ্গে আমাদের এটাও স্বীকার করতে হবে যে, সেই সদ্ভাবের পরিপ্রেক্ষিতেই সে সময়ের সরকারের প্রতি বাংলাদেশের জনমানসের ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল। তাই কিছু ক্ষেত্রে ভারতীয়দের সঙ্গে হাসিনার অতি মাত্রায় সুসম্পর্ক সে দেশের সাধারণ জনগণকে ভারতের প্রতি বিরূপ করে তুলেছিল। তার উপর মৌলবাদীদের ক্রমাগত ভারতবিরোধী উস্কানি তো ছিলই। বাংলাদেশে এত চটজলদি পট পরিবর্তনের সম্ভাবনা ভারতের মানুষ তো ছাড়, নেতা, পররাষ্ট্র বিশেষজ্ঞ— কে-ই বা আঁচ করতে পেরেছিলেন? এ যে আমাদেরই ত্রুটি, আজ এ কথা স্বীকার করে নিতে লজ্জা নেই।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে বাংলাদেশের বিষয়ে কোন অবস্থান নেবে ভারত? খুব বেশি কঠোর অবস্থান নেওয়া বা দাদাসুলভ আচরণ করা এক কথায় অসম্ভব, কারণ চিন তাতে বাদ সাধবে। তারা অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে ঋণের জালে আবদ্ধ করে বাংলাদেশের উপর তাদের নিয়ন্ত্রণ জোরালো করতে চায়। বাংলাদেশের জমি, নদী, সমুদ্র, বন্দর ব্যবহার করার অধিকার চিন পেয়ে গেলে ভারতের সমস্যা হবে। এ ভাবেই শ্রীলঙ্কার বন্দর ব্যবহার করার ব্যবস্থা করেছে চিন। বাংলাদেশের কিছু বাঙালিকে নিয়েও মোদীর চিন্তিত হওয়া প্রয়োজন। ওখানে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার হলে তার প্রতিবাদের একটা নৈতিক দায় থাকে বিজেপি শাসিত সরকারের, যদিও হাসিনা-পরবর্তী সময়ে নির্যাতন ও ঘরবাড়ি ধ্বংসের বিরুদ্ধে কোনও জোরালো প্রতিবাদ এখনও পাওয়া যায়নি ভারত সরকারের কাছ থেকে।
গত কয়েক মাস ধরেই আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির যা গতিপ্রকৃতি ছিল, বিভিন্ন রাষ্ট্রের থেকে সুবিধা আদায়ের ক্ষেত্রে আমরা যে বিশেষ লাভবান হয়েছি এমনটা দেখা যায়নি। ইতিমধ্যেই কানাডার সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে, ট্রাম্পের সঙ্গে উষ্ণ আলিঙ্গন ও করমর্দন সত্ত্বেও ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে ভারত তেমন কোনও সুবিধাই পায়নি। সাম্প্রতিক সংঘর্ষ তো পরিস্থিতিকে আরও উদ্বেগজনক করল। সুতরাং, মনে হয় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ভারতকে আরও বিবেচনা করে এগোতে হবে। উপমহাদেশে চিনের আগ্রাসন ঠেকাতেও কিন্তু প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা খুব জরুরি।
সুরজিৎ কুন্ডু, উত্তরপাড়া, হুগলি
মন্দির কেন?
পশ্চিমবঙ্গ সরকার কর্তৃক দিঘায় জগন্নাথ মন্দির প্রতিষ্ঠা এক আশ্চর্য পদক্ষেপ। এক জন করদাতা নাগরিক হিসাবে একে মেনে নিতে অসুবিধা হচ্ছে। রাষ্ট্রের দ্বারা বা শাসকের দ্বারা কোনও রকম ধর্মীয় উপাসনালয় প্রতিষ্ঠাই সমর্থন করতে বাধে— তা সে রামমন্দির হোক বা জগন্নাথ মন্দির।
হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ভাল হিন্দু হয়ে লড়ার কৌশলটা কোনও দিনই সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ এই দুই ক্ষেত্রেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সেই অমোঘ কবিতার পঙ্ক্তি মনে পড়ে, “আপনারে স্থাপিয়াছ, জগতের দেবতারে নয়।”
বাংলা-সহ গোটা ভারতের মানুষেরই যা অবস্থা, তাতে কোনও শাসককেই মন্দির মসজিদ গির্জা তৈরির জন্য শক্তি ব্যয় বা সংরক্ষণের জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করা মানায় না। ধর্ম দিয়ে ধর্মের উগ্রতাকে খণ্ডন করা যায় না। ধর্মের সঙ্গে এক সময় শাসকের সংযোগ থাকত। কারণ এখানে পুরোহিত এবং ইউরোপে চার্চ রাজশক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু যদি ধরে নিই, আমরা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশ, তা হলে, সব মানুষের ধর্মযাপনকে মেনে নিলে, রাষ্ট্রের কোনও ধর্ম নেই রাষ্ট্রধর্ম ছাড়া, এ কথাই মেনে চলা উচিত।
সেখানে ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের বিরোধিতা করতে গিয়ে আমরাও যদি ছোটখাটো ধর্মীয় ফ্যাসিবাদী হয়ে যাই, তা হলে বিরোধিতা করে আর লাভটা কী হল? বিজেপির বিরুদ্ধে এখানে সকলের ঐক্যবদ্ধ লড়াই দরকার। কিন্তু রামমন্দিরের জবাব জগন্নাথ মন্দির, সন্তোষী মায়ের মন্দিরের জবাব শীতলা মন্দির, এ রকম করে চলতে থাকলে, শেষ পর্যন্ত বিরোধের জায়গাটা আর থাকবে কোথায়?
হতে তো পারত দিঘায় একটা উন্নত মানের হাসপাতাল, একটা বিশাল লাইব্রেরি, বা একটা উন্নত মানের মানমন্দির, আবহাওয়া সংক্রান্ত গবেষণার বিশাল ক্ষেত্র, সমুদ্র সংক্রান্ত গবেষণাগার, কিন্তু মন্দিরই গড়তে হল?
একটা রামমন্দির বা একটা জগন্নাথ মন্দির কি আমাদের জীবনের সমস্যাগুলিকে দূর করতে পারে? না কি এ শুধুই শাসকশক্তিগুলির একে অপরের সঙ্গে ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াই? কিন্তু এর সঙ্গে মানুষের জীবনসংগ্রামের কোথায় যোগাযোগ? বরং মানুষকে তো সচেতন করতে হবে— তোমার যাপনের সঙ্গে, জীবনযুদ্ধের সঙ্গে এই ঐশ্বরিক চিন্তার যোগ নেই। রাষ্ট্র কী ভাবে মন্দির বা মসজিদ বা গির্জা তৈরি করতে পারে? ভারত সরকারের রামমন্দির বা পশ্চিমবঙ্গ সরকারের জগন্নাথ মন্দির— দু’টিই মানুষের অস্তিত্বের লড়াইয়ের সঙ্গে খাপ খায় না।
আমি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করি, মানুষের মধ্যবর্তী কুসংস্কারকে খুঁচিয়ে বাড়ানোর মানে নেই। আধ্যাত্মিক চিন্তা ব্যক্তির নিজস্ব। সমষ্টিগত ভাবে তার প্রকাশ অসম্ভব। ধর্ম আধ্যাত্মিকতার চেয়ে অনেক দূরের একটি বিষয়।
হিন্দোল ভট্টাচার্য, কলকাতা-৮৯
যন্ত্রের ফাঁদে
‘তামাদি চেক’ (৪-৫) সম্পাদকীয়টি আবেগান্বিত করে তুলল। বহুকাল লালিত একটি অভ্যাস, যা জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোত ভাবে জড়িত ছিল, যাকে নিয়ে অনেক কাহিনি জড়িয়ে সে যখন তামাদি হতে চলেছে, তখন বুকের ভিতর এক চিনচিনে ব্যথা অনুভব হয়!
ব্যাঙ্কে টাকা তোলার স্লিপের কোথায় কী লেখা হবে তা বুঝতে না পেরে ইতিউতি দেখছেন নিরক্ষর বা স্বল্প-শিক্ষিত মানুষ কিংবা গোবেচারা কোনও ব্যক্তি। খুঁজছেন একটা কলম আর কে ওই ফর্ম পূরণ করতে পারবেন, চলছে তাঁকে খোঁজা ও এঁকে তাঁকে সামান্য অনুরোধ-উপরোধ করা— এ তো ব্যাঙ্কের চেনা ছবি। একটু অস্বস্তি হচ্ছে ভাবতে যে, ব্যাঙ্ক থেকে এই ধরনের ছবি বিদায় নিতে চলেছে। এখন তো প্রায় সবাই ইউপিআই ব্যবহারের মাধ্যমে স্মার্টফোনে লেনদেন করায় ইতিমধ্যেই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছেন। এমনকি খুচরো টাকা ও কয়েনের সরবরাহও খুব কমে গিয়েছে, হয়তো ডিজিটাল লেনদেন দ্রুত সর্বত্র ছড়িয়ে দেওয়ার প্রচেষ্টাই এই সঙ্কোচনের বড় কারণ।
ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে যাঁরা নগদে লেনদেন করেন তাঁরা বিমর্ষ, সমস্যায়। যে মোবাইল শুধু কথা বলা সহজ করতে এসেছিল, আজও যার আয়তন ক্ষুদ্রই বলা চলে, তারই দাপট কেমন বিশাল থেকে বিশালতর হচ্ছে! মুঠোয় ভরা জগৎটা যে সব কিছু গ্রাস করে নেবে, এ কি কল্পনাও করা গিয়েছিল?
যা-ই হোক, এই ব্যবস্থায় কিন্তু ‘হ্যাকিং’-এর উৎপাত বাড়ারও সম্ভাবনা রয়েছে। অদৃশ্য ভাবে নিমেষের মধ্যে প্রচুর টাকা উধাও হওয়ার কথা প্রায়ই শোনা যায়। সাধারণ মানুষের কাছে এই লুট যে কত বড় কষ্ট, বিড়ম্বনা— কহতব্য নয়। এই হয়রানি যাতে কমে, তার জন্য কি সরকার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করবে? এই প্রশ্ন কিন্তু সকলেরই।
বিবেকানন্দ চৌধুরী, কাটোয়া, পূর্ব বর্ধমান
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)