Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
Teachers Day

মনে হত, ঠিক যেন মায়ের মতো

শিক্ষক-শিক্ষিকারা তো এমনই হন, যাঁদের দেখে অনুকরণ করতে ইচ্ছে করে। তাঁদের মডেল করেই বড় হয়ে ওঠা।

ফাইল চিত্র।

ফাইল চিত্র।

নবনীতা দত্ত
শেষ আপডেট: ০৪ সেপ্টেম্বর ২০২০ ০০:১০
Share: Save:

স্কুলে কিছু শিক্ষিকা ছিলেন, একদম মায়ের মতো। কিছু হলেই ছুটে যাওয়া যেত তাঁদের কাছে। তাঁরা একটু বকুনি দিলেই অভিমানে চোখে জল চলে আসত। আর কড়া শিক্ষিকাদের ক্লাসে মূর্তিবৎ বসে থাকতাম। বিস্ফারিত চোখের অগ্নিবাণে যেন ভস্ম করে দেবেন তাঁরা! নজরও ছিল সাঙ্ঘাতিক। ডেস্কে বসেই টের পেতেন লাস্ট বেঞ্চে কেউ দুষ্টুমি করছে কি না। যার মন অন্য দিকে, ঠিক তাকেই পড়া ধরতেন! যে বই আনেনি, বেছে বেছে তাকেই রিডিং পড়তে বলতেন!

অভিনব শাস্তি দেওয়ার জন্যও মনে থেকে গিয়েছেন কয়েক জন। টোকাটুকি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল দুই বন্ধু। দু’জনকে নিয়ে শিক্ষিকা চলে গেলেন লাইব্রেরি। তাক থেকে ৬০০ পাতার দুটো বই নামিয়ে বলেছিলেন, ‘টুকতে চাও? নাও, শুরু করো।’ বই কপি করতে গিয়ে তাদের লাইব্রেরির নেশা ধরল। ভবিষ্যতে টুকে লেখার প্রয়োজনই পড়েনি!

শুধুই কি পড়াশোনা? নিয়মানুবর্তিতা, সুঅভ্যাস, কর্তব্যপালন— সব শেখা চলত শিক্ষিকাদের অণুক্ষণ নজরদারিতে। স্কুলে অনেক কিছুই শিখেছি, যা জীবনে কাজে লেগেছে প্রতি পলে। এক-এক জন শিক্ষিকা ছিলেন এনসাইক্লোপিডিয়া, তৎকালীন ইন্টারনেটের মতো। পড়ার বইয়ের বাইরেও বিশ্বজগতের খোঁজ তাঁদের কাছে। ক্লাসের ফাঁকে বা ছুটির পরে ঠাকুরদালানে বসে বুঁদ হয়ে শুনতাম বারমুডা ট্রায়াঙ্গল বা ওল্ড ফেথফুল গিজ়ারের গল্প।

কিছু শিক্ষিকা ছিলেন দারুণ ব্যক্তিত্বময়ী, কেউ আবার সুন্দর সাজতেন। তাঁদের হালকা রঙের সিল্কের শাড়িতে, কায়দা করে চুল বাঁধায় মোহিত হয়ে চেয়ে থাকতাম। হেঁটে গেলে সুন্দর গন্ধে ভরে উঠত করিডর, ঠিক যেমন মায়ের গায়ের গন্ধ থাকে, তেমনটাই। অ্যানুয়াল ফাংশনের গ্রিন রুমে শাড়ির ভাঁজ ফেলা, কাজল পরা— তাঁদের হাত ধরেই শেখা। শিক্ষিকাদের অনুকরণও করতাম আড়ালে। দিদিমণিদের সামনে দিদিমণি সাজার সুযোগ পেতাম শুধু শিক্ষক দিবসে। সবচেয়ে রাগী দিদিমণি সেজে যখন তাঁর সামনেই টেবলে স্কেল ঠুকে ‘সাইলেন্ট’ বলে চেঁচিয়ে উঠত কোনও বন্ধু, তখন সেই কড়াপাক দিদিমণির মুখেও নরমপাক হাসি লেগে থাকত।

শিক্ষক-শিক্ষিকারা তো এমনই হন, যাঁদের দেখে অনুকরণ করতে ইচ্ছে করে। তাঁদের মডেল করেই বড় হয়ে ওঠা। স্বপ্ন দেখতাম: বড় হয়ে ঠিক এই ‘দিদি’-র মতো করে ক্লাসে পড়াব, অমুক শিক্ষিকার মতো বোর্ডে চক দিয়ে ছবি আঁকব। তাঁরা এখনও একই ভাবে বেঁচে আছেন ছোটবেলার স্কুলপ্রাঙ্গণে। মাঝেমধ্যে রাস্তাঘাটে দেখা হলে কষ্ট হয়, তাঁদের বয়স হয়ে গিয়েছে দেখে। যে শিক্ষিকা স্পোর্টসের দিন মাঠ দাপিয়ে খেলার তদারকি করতেন, তাঁকে অশক্ত হাতে বাসের হ্যান্ডেল ধরতে দেখলে খুব কষ্ট হয়। হাত ধরতে এগিয়ে গেলে, হেসে বলেছেন, ‘পারব রে...’, যে ভাবে খারাপ রেজ়াল্ট হওয়ার পরেও পিঠে হাত রেখে বলতেন, ‘তুই পারবি রে!’

এক বার ক্লাসের ফাঁকে টয়লেট যাওয়ার নামে সারা স্কুল ঘুরে প্রায় আধ ঘণ্টা বাদে ক্লাসে ফিরেছিলাম। বকুনি দিয়ে দুই বন্ধুকেই ক্লাসের বাইরে দাঁড় করিয়ে রাখলেন শিক্ষিকা। সেই ফাঁকে আরও কয়েক চক্কর ঘুরে এলাম স্কুলের বাগান, ছাদের সিঁড়ি, করিডরে। আর বকুনি খাইনি। ভেবেছিলাম, দিদি বুঝতে পারেননি। রেজ়াল্টের দিন সেই শিক্ষিকা আমাদের ডাকলেন। শান্ত গলায় বললেন, ‘‘এ বার ক্লাস নাইন। ছোট ক্লাসের বোনেরা তোমাদের দেখে শিখবে। শাস্তির ফাঁকে স্কুল ঘুরতে বেরিয়ে পড়বে না যেন!’’ একটা কথাই ছিল দুটো চড়ের সমান।

কত বছর পার হয়ে গিয়েছে, এখনও স্কুলে গেলে ভয়ে ভয়ে থাকি, অসংযত আচরণ না করে ফেলি! অবসরে স্মৃতিপথ ধরে ঘুরে বেড়াই স্কুলের বারান্দায়, বাগানে, ঠাকুরদালানে। আর সেই পথে ঘুরতে ঘুরতে এসে ধাক্কা খাই মোবাইল-ল্যাপটপের স্ক্রিনে, যেখানে এখন স্কুল বসেছে পরবর্তী প্রজন্মের।

পড়াশোনা, পরীক্ষা, অনুষ্ঠান— সবই চলছে সেই ডিজিটাল স্কুলে। কিন্তু, তার রূপ-রস-গন্ধ গ্রহণ করতে পারছে তো ছোটরা? সেখানে যে চোখ-কান পেতেছেন অভিভাবকেরাও! শিক্ষক-ছাত্র সম্পর্কের গণ্ডিতে অজান্তেই ঢুকে পড়ছেন তাঁরা। আর সেই ভরা হাটে বকুনি খেয়ে, আত্মবিশ্বাস ভেঙে যাচ্ছে পিছিয়ে পড়া ছেলেটার, অপমানে গুটিয়ে যাচ্ছে মুখচোরা মেয়েটা। ওয়েব-ক্লাসের কারিকুরিতে ঠকে গিয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছেন প্রবীণ মাস্টারমশাইরাও।

পরিস্থিতি বদলালে নিশ্চয়ই আবার এক ছাদের তলায় জড়ো হবে শিক্ষক আর পড়ুয়ারা। কিন্তু মাঝের এ ক’টা দিন? ভিত গড়ার সময়েই গলদ থেকে গেলে তাতে ইমারত শক্ত হয়ে বসবে তো? এই এক-একটা ক্ষত পরে বড় গহ্বর তৈরি করে বসবে না তো দেওয়ালের খাঁজে-খাঁজে?

মাঝে মাঝে সন্তানের অনলাইন ক্লাসে ওর পাশে বসি। মনে প্রশ্ন জাগে, ও পারবে কখনও ওর প্রিয় শিক্ষিকাকে অনুকরণ করতে, অনুসরণ করতে? ই-স্কুলে পড়া হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু সবটা কি শেখা হবে? এর পরে স্কুল শুরু হলে, মানিয়ে নিতে পারবে তো? খুব ইচ্ছে করে, নিজের ছেলেবেলার স্কুলবাড়িটা ওদের সামনে তুলে ধরি। কিন্তু ই-স্কুলের পরিধিতে সে-স্কুল কি চিনতে পারবে ওরা?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Teachers Day Teacher Mother
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE