স্বাগতম দাসের ‘যেন রুচির মহামারি’ (২৯-৯) শীর্ষক প্রবন্ধটি অত্যন্ত সময়োপযোগী এবং জনহিতকর। আজ সংখ্যার দৌড়ে লাইক শেয়ার কমেন্টের তোড়ে আমাদের মনের সৃজনশীল সত্তার দফারফা হচ্ছে। কিন্তু কবেই বা আমরা এ সবের তোয়াক্কা করেছি?
সব কিছুই বেআব্রু হয়ে গিয়েছে। নগ্নতাকে পুঁজি করে ধনী হওয়ার ইচ্ছা এ প্রজন্মকে পেয়ে বসেছে। মানের বদলে এসেছে পরিমাণের গুরুত্ব। রাষ্ট্রও কি সেই নেশা থেকে রেহাই পেয়েছে? ভোটের আগে উন্নয়নের জোয়ার কি আসে না? মুখে মিথ্যের বুলি কি ফোটে না? কেবল মুখে কেন, লিখিত আকারেও তো মিথ্যে ঘোষণা হয়। নাম দেওয়া হয় ‘ইস্তাহার’। ভাবুন তো, এই ইস্তাহারের সঙ্গে রিলের কি খুব পার্থক্য আছে? দুই-ই তো সাময়িক আনন্দ দেয়। আজ থেকে হাজার বছর আগেও কিন্তু ‘লাইক, শেয়ার, কমেন্ট’-এর কদর ছিল। অতীতে রাজসভার কবিরা ‘লাইক’ পেতেন বলেই তো রাজসভা থেকে দূরে এক দল যোগ্য কবি অন্ধকারে পড়ে থাকতেন। আজও হয়তো আছেন। কেবল কাঠামোটি বদলে গিয়েছে। আজও তো রাষ্ট্রপ্রধান ইচ্ছে করে যুদ্ধ তৈরি করেন। আবার থামিয়ে দিয়ে ‘রিচ’ বাড়ান।
আগে লোকে বলত, ঘরের কথা পরকে বলতে নেই। এখন মোবাইলের দৌলতে সে ধারণা বদলে গিয়েছে। এখন ঘরের রুচির দৈন্য, গোপনীয়তা দেখানোতেই ‘রিচ’ বাড়ছে। বুঁদ হয়ে থাকছে নবীন প্রজন্ম। পার্থক্য ঘটে গিয়েছে রুচিতে। ‘কনটেন্ট’-এ। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠা নয়, বরং ঝোড়ো আবেগেই মানুষ মুক্তি পেতে চাইছে। কিন্তু, যা পেতে চাইছে তার বিপরীত ফলই ফলছে।
দীপায়ন প্রামাণিক, গোবরডাঙা, উত্তর ২৪ পরগনা
পিছনে হাঁটা
স্বাগতম দাসের লেখা ‘যেন রুচির মহামারি’ অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও মননশীল প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, ওয়টস্যাপ নামক মাধ্যমের ব্যবহারকারীর সংখ্যা দ্রুত হারে বৃদ্ধির ফলে সমাজের প্রকৃত চিত্রটাই বদলে যেতে শুরু করেছে। আধুনিক যুবক যুবতীদের নেট-নাগরিক হয়ে ওঠার প্রবণতার উপর দায় চাপিয়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললে সত্যের অপলাপ হবে। নেশায় আক্রান্ত আট থেকে আশির বেশির ভাগ নাগরিক। ক্ষণিকের দৃষ্টিসুখের তাড়নায় বিশ্লেষণী মনোভাবের এবং মননের সংমিশ্রণে গড়ে ওঠা সুকুমার মনোবৃত্তির অভাব ঘটছে। আজকাল নাকি ‘কনটেন্ট’ বানিয়ে অর্থ রোজগার করা যায়, কী কনটেন্ট সে প্রশ্ন গৌণ, কত জন লাইক, কমেন্ট দিলেন সেটাই বিচার্য। অতএব ভাল মন্দের তোয়াক্কা না করে রিলস বানিয়ে যাও, আর অর্থ রোজগার করে যাও, সমাজের কথা অন্য সময় ভাবা যাবে।
যৌনতা হল মানুষের আদিম প্রবৃত্তি। স্বল্পবসনা নারী, অবিন্যস্ত বেশভূষায় চটুল বাক্যে কথা বলা নারীরা অহরহ আবির্ভূত হয়ে চলেছেন সমাজমাধ্যমে। নেই নিয়ন্ত্রণ, নেই নিষেধাজ্ঞা, নেই সেন্সরশিপ। ভাবলে আশ্চর্য হয়ে যাই, বয়স্ক মহিলাদের রিলস বানানোর প্রতিযোগিতা দেখে। প্রশ্ন জাগে, তিনি ক্ষণিকের ওই প্রায় বিবস্ত্র উপস্থিতিতে নিজে কী পান আর তাঁর ফলোয়ার-এর জন্য কী রেখে যান? এই সব ‘কনটেন্ট’ তৈরির পিছনে সবটাই যৌনতা, গ্রহণযোগ্য কিছু নেই।
ভাল ‘কনটেন্ট’ বলতে যা বুঝি, কোনও ভাল কবিতা, নয়নাভিরাম দৃশ্য, কোনও গল্প— এইগুলোই। তা যে পোস্ট হয় না, তেমনটাও নয়, কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয়, তার লাইক-কমেন্ট-শেয়ার এক্কেবারে তলানিতে। চটুল ‘কনটেন্ট ক্রিয়েটর’-এর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় মননশীল ওই সব ‘কনটেন্ট’ পিছনের সারিতে।
এই সব দেখতে অনভ্যস্ত নাগরিকদের সংখ্যাও কিন্তু কম নয়। তবে তাঁরা কোণঠাসা। বিরক্তি উদ্রেককারী ‘কনটেন্ট’ সামনে এলে এঁদের দু’-একটা মন্তব্যও চোখ এড়ায় না। অনুতাপের বিষয়, সেই মন্তব্য নিয়ে নেট-নাগরিকদের একাংশের আক্রমণের মুখে পড়তে হয়। আত্মসম্মানের তাগিদে এঁরা দূরে সরে থাকেন, বৃদ্ধি পায় ‘কনটেন্ট’-এর নামে আবর্জনা ক্রিয়েটর ও ‘কনটেন্ট’ চোরদের সংখ্যা।
একটি বিদ্যালয়ের এক প্রধান শিক্ষকের কাছে শুনেছি, এখন আর কেউ গল্প-উপন্যাস পড়ে না, কারণ সময় নেই, তাই অণুগল্পের গ্রহণযোগ্যতা বেশি। রাজ্যের প্রতিটি সরকারি বিদ্যালয়ে শুধু বাংলা বিষয়ের শিক্ষকের সংখ্যা ধরলে যা হবে, তার এক শতাংশও পুজোসংখ্যা বিক্রি হয় না। এটাকে ভাবের ঘরে চুরি ছাড়া আর কী বলতে পারি? অর্থাৎ পড়ার দরকার নেই, আমরা না পড়িয়াই পণ্ডিত!
একটি বিচিত্র প্রবণতায় আচ্ছন্ন নেট-নাগরিকের বেশ কিছু অংশ। তারা রাতারাতি বিখ্যাত হতে চায়। গল্প, কবিতা, ভ্রমণ বৃত্তান্ত, রান্নার রেসিপি, সব কিছু ফেসবুকের দেওয়ালে সেঁটে দেয়, রিলস বানায়, আর অপেক্ষায় থাকে কত লাইক কমেন্ট এল দেখার জন্য। অত্যন্ত সংবেদনশীল ও সংস্কৃতিমনস্ক এবং অসাধারণ চিত্রশিল্পী আমার এক প্রিয় বন্ধুর ফেসবুক অ্যাকাউন্ট নেই, অথচ তাঁর এটা নিয়ে আক্ষেপও নেই। তাঁর একটি অকাট্য যুক্তি কিছুতেই খণ্ডাতে পারিনি। বন্ধুটি অকপটে জানিয়েছেন, আপনার নিজস্ব শিল্পকলা, অথবা সাংস্কৃতিক মনন থেকে উঠে আসা লেখা অথবা ছবি এই আধুনিক ডিজিটাল গণমাধ্যমে প্রচারিত হলে, এমন মানুষের কাছ থেকেও আপনি ‘লাইক’, ‘কমেন্ট’ বা তিরস্কার পাবেন, যিনি ওই শিল্পকর্মের আদৌ কিছু বোঝেন না। কারণ এই মাধ্যমটি এমনই একটা মাধ্যম, যেখানে আপনি নিজেই আপনার ‘এডিটর’, নিজেই সৃষ্টিশীলতা বা রুচিশীলতার মানের নির্ধারক।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের সব কাব্যগ্রন্থ তিনি প্রয়াত হওয়ার পর প্রকাশিত হয়েছিল। আমাদের ছেড়ে চলে যাওয়া কবির কলম জুড়ে যে সম্ভাবনার প্রদীপ জ্বলে উঠেছিল, তার পূর্ণ বিকাশ লাভ করার আগেই তিনি লোকান্তরিত হলেন। আজকের জেট গতির এই গণমাধ্যমে, যেখানে চটজলদি বিখ্যাত হওয়ার বাসনায় তৃষিত মন উচাটন হয়, সেখানে সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো ব্যক্তিদের হয়তো আমরা কোনও দিন তেমন ভাবে পেতাম না। বিশ্লেষণী চিন্তাধারার দৈন্যদশা চলছে।
সৃষ্টির মূলে যে মনন, চিন্তন ও বোধের সমন্বয় প্রয়োজন, সেটাই ভুলে গিয়েছে। সৃষ্টিশীলতার স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য নিজের কঠোর মনঃসংযোগ ও পরিশ্রমের সময় দিতে নারাজ নেট-নাগরিকদের মন সমগ্র চেতনাটাকে কোন খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছে, ভেবেই আশ্চর্য হয়ে পড়ছি।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
ডাস্টবিন চাই
যত্রতত্র আবর্জনা ফেলায় নিষেধাজ্ঞাকে পূর্ণ সমর্থন জানাই, তবে কিছু মানুষের প্রতি এর ফলে নির্ভরতা বেড়েছে। এঁরা সকলে কর্তব্য যথাযথ ভাবে পালন না করলে নাগরিকরা বিপদে পড়ছেন। আমরা দক্ষিণ কলকাতার প্রান্তে ব্রহ্মপুর এলাকার গ্রিন ভিউ রোডের বাসিন্দারা রাস্তার সাফাই-এর দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মীদের দুর্ব্যবহার ও অসহযোগিতার কারণে তাঁদের উপর ভরসা করতে ও প্রতি দিন ময়লা ফেলতে পারছি না। শহরের অন্যত্র কিছু দূর অন্তরই ডাস্টবিন দেখা যায়, কিন্তু এই এলাকার কাছাকাছি সেই ব্যবস্থা নেই। সাফাইগাড়ি আসার সময়টিতে বাড়িতে থাকতে অপারগ হলে, ঘরের ময়লা ঘরেই থেকে যাচ্ছে। পর দিন, সাফাইগাড়িতে ফেলতে গেলে পাল্টা ‘কমপ্লেন করে দেব’-র রক্তচক্ষু দেখতে হচ্ছে। রাস্তা পরিষ্কারেও প্রায়ই অনীহা দেখা যায়।
এলাকায় ডেঙ্গি বাড়ছে বলে শুনছি। বিনীত অনুরোধ, যত দিন না কর্মীদের কর্তব্যপরায়ণ ও সহানুভূতিশীল হতে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে, এঁদের উপর যাতে নির্ভরশীল না হতে হয়, তার জন্য এলাকার কাছাকাছি আবর্জনা ফেলার পরিবেশবান্ধব ডাস্টবিন রাখারও ব্যবস্থা হোক, যা নিয়মিত পরিষ্কার করা হবে। এতে বাসিন্দারা অপ্রীতিকর ও অস্বাস্থ্যকর অবস্থা থেকে রেহাই পাবেন। আমাদের মতো বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যাঁরা ময়লা ফেলতে দূরে যেতে পারেন না, তাঁরা অশেষ উপকৃত হবেন।
বীথি ভৌমিক, কলকাতা-৯৬
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)