রণবীর সমাদ্দারের ‘ধোঁয়াশায় ভরা ঐতিহ্য’ (২৬-৫) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। ঐতিহ্য বিচারের প্রশ্নে, আমাদের সাংস্কৃতিক ইতিহাসে যা কিছু মানবিক, যা কিছু বৌদ্ধিক বিচারে উৎকৃষ্ট, তাকে শ্রেণিজাত দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে বিচার না করে মার্ক্সবাদের মানবতাবাদী ধারণার সঙ্গে কেমন করে মিশ্রণ ঘটানো যায় সেই প্রচেষ্টা জরুরি ছিল। উদাহরণস্বরূপ, রবীন্দ্রনাথকে শ্রমজীবী মানুষের দরজায় নিয়ে যাওয়া যেত। অধুনা দল তা করছে ঠিকই, অনুরূপে স্বামী বিবেকানন্দের সাম্য ও কর্মযোগের ভাবনাকে দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়াও উচিত ছিল। এ কথা বলা দরকার ছিল যে, এই মনীষীরা যে মানবিক আদর্শে সমৃদ্ধ সমাজের কথা ভেবেছিলেন, তার বাস্তবায়নের পথ দেখাতে পারে কমিউনিস্ট ভাবাদর্শ। গ্রামশি এ ভাবেই মেকিয়াভেলির বৌদ্ধিক চিন্তার ঐতিহ্যকে গেঁথেছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির ধারণার সঙ্গে।
অধুনা বিশ্বের পাশাপাশি ভারতেও মানুষ দক্ষিণপন্থার প্রতি আস্থা জ্ঞাপন করছে। নয়া উদারনীতিবাদী অর্থনীতিকে গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আপত্তি উঠছে না। এর মূলত তিনটি কারণ। প্রথমত, বামপন্থীরা কোনও বিকল্প অর্থবহ দিশা দেখাতে এখনও পর্যন্ত ব্যর্থ। দ্বিতীয়ত, দক্ষিণপন্থী পুঁজিবাদ অনেক রকমের কৌশল অবলম্বনে বহুলাংশে নিজেকে গ্রহণযোগ্য করে তুলতে সফল হয়েছে। তৃতীয়ত, পৃথিবীর অন্য বহু দেশের মতো ভারতেও বিশাল অংশের মানুষের কাছে মৌলবাদী ধর্মীয় সন্ত্রাস বড় বিপদ রূপে প্রতিভাত। আর এই নিরাপত্তাহীনতার কারণে অনেকেই মনে করছেন যে, এখন কড়া প্রশাসনের প্রয়োজন, জবরদস্ত কর্তৃত্ববাদী কোনও ব্যবস্থা ভীষণ ভাবে জরুরি।
প্রায়ই ভারতীয় কমিউনিস্টরা ‘মার্ক্সবাদ সর্বশক্তিমান, কারণ ইহা সত্য , ইহা বিজ্ঞান’ লিখে দেওয়াল ভরাতেন। নেতারা গুলিয়ে ফেলেছিলেন ভৌতবিজ্ঞানে যা সর্বদেশে সর্বকালে সত্য হয়, সমাজবিজ্ঞানে তা হয় না। বিপ্লবের পর মাত্র কয়েক বছর বেঁচে ছিলেন লেনিন। তিনি যদি মাত্র ৫৪ বছর বয়সে মারা না যেতেন তা হলে সমাজতান্ত্রিক দেশের রাষ্ট্রকাঠামোর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভাল দিকটাও নিশ্চিত ভাবেই অন্তর্ভুক্ত করতেন। যেমন অর্থনীতির ক্ষেত্রে ১৯২২ সালে রাশিয়ায় নয়া অর্থনৈতিক নীতি চালু করেছিলেন। পুঁজিবাদের পতন ও সমাজতন্ত্রের বিজয় অনিবার্য— আন্তর্জাতিকতাবাদে বিশ্বাসী কমিউনিস্টদের এই ভবিষ্যদ্বাণী মেলেনি, কারণ তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব পুঁজিবাদকে কতটা শ্বাসবায়ু দিতে পারে, তা তাঁরা বুঝতেই পারেননি।
১৯৭৭ সালে বামফ্রন্ট মন্ত্রিসভা শপথ নেয়। কেরল, ত্রিপুরার মতো এখানেও ভূমি সংস্কার সফল হয়েছিল। তবুও কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ ভাবতেই পারেননি তিন দশকের উপর ক্ষমতায় থাকবেন। তবে, প্রবল ভাবে উপেক্ষিত ছিল বহুত্ববাদ। এ কথা সত্যি, দেশের রাজনৈতিক কাঠামো চিনতে ভুল হয়েছে ভারতীয় কমিউনিস্টদের। অতএব শতবর্ষে শুরু হোক আত্মমন্থন।
সৌমিত্র মুখোপাধ্যায়, কলকাতা-৮৪
গভীর অসুখ
রণবীর সমাদ্দারের লেখা প্রবন্ধ ‘ধোঁয়াশায় ভরা ঐতিহ্য’ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি তথা বামপন্থীদের নীতি ও কর্মপন্থার জলজ্যান্ত দলিল। মানতেই হবে ভারতে, বিশেষ করে বাংলার জনজীবনে বামপন্থীদের প্রভাব সুদূরপ্রসারী, তা সে সমাজজীবন হোক বা রাজনৈতিক, সবেতেই বামেদের প্রভাব রয়েছে। এক সময় ভারতে কেরল, ত্রিপুরা এবং পশ্চিমবঙ্গ বামপন্থীদের শাসনে ছিল, রাজ্য আয়তনে বড় হওয়ার সুবাদে বঙ্গের বামপন্থীদের প্রভাব বেশি ছিল। কিন্তু ২০১১-য় বাংলায় বাম শাসনের অবসানের পর থেকেই বামপন্থীদের ভোটব্যাঙ্ক ও সমর্থনে যে রক্তক্ষরণ শুরু, তা আজও অব্যাহত। আসলে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে কংগ্রেসিদের সঙ্গে বামদলগুলির বোঝাপড়া থাকত, তা সে যতই বিরোধী হোক না কেন, মসৃণ সম্পর্ক ছিল। ২০১৪-য় কেন্দ্রে বিজেপি সরকার আসার পর আদর্শগত বৈপরীত্যের জন্য সেই রসায়ন তলানিতে। প্রতিনিধি কম হওয়ার জন্য সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে বামেদের প্রভাব ক্রমাগত কমছে।
একের পর এক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বামেদের সাধারণ মানুষের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। ত্রিপুরা এবং বাংলায় দীর্ঘ সময় শাসনের কারণে এক ধরনের দাম্ভিকতা কর্মীদের অত্যাচারী করে তুলেছিল, ফলে জনমনে বিরূপ প্রভাব পড়েছে। সাধারণ শ্রমিকদের স্বার্থে তৈরি ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা মালিকদের সঙ্গে অনৈতিক বোঝাপড়া করে আখের গুছিয়ে নিয়েছিলেন। ফলে সাধারণ শ্রমিকরা ট্রেড ইউনিয়ন বিমুখ হয়ে যান। পদ আঁকড়ে থাকার প্রবণতায় নতুন প্রজন্ম গড়ে না ওঠাতেও বামেদের শক্তি কমে। সঙ্গে শাসকের অত্যাচার এবং সেই বিপদে নেতাদের কর্মীদের পাশ থেকে সরে যাওয়া সমর্থকদের মনোবল ভেঙে দেয়।
দিল্লিতে তৃণমূলের সঙ্গে বাম একই নৌকায়, অথচ বাংলায় তৃণমূল বিরোধিতা চলবে— এই স্ববিরোধিতা বার বার পরিলক্ষিত হয়। কিন্তু নেতাদের হেলদোল নেই। দীর্ঘ দিন ক্ষমতায় থাকার ফলে বামনেতাদের এক ক্ষমতা ভোগের নেশা পেয়ে বসে। কংগ্রেস বিরোধিতা করেই বাম উত্থান, অথচ বাংলায় ২০১১-য় ক্ষমতা হারানোর পাঁচ বছরের মধ্যেই কী এমন ঘটল যে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করে ২০১৬-র নির্বাচনে যেতে হল? ২০২১-এ নিজেদের ধর্মনিরপেক্ষ দাবি করার পরও এক ধর্মগুরুর হাতে প্রতিষ্ঠিত দলের সঙ্গে জোট কেন?
প্রচুর আন্দোলনের উপাদান থাকা সত্ত্বেও নেতৃত্বের দূরদর্শিতার অভাবে আন্দোলনের সমস্ত সুযোগ হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে। পহেলগামে নিরীহ পর্যটক মারা পড়লে কোনও প্রতিবাদ নেই, অথচ ভারতীয় সেনার জঙ্গি দমনের বিরুদ্ধে মিছিল চলেছে! সামশেরগঞ্জে দু’জন বাম সমর্থকের মৃত্যুর পরও সমর্থকদের এককাট্টা করার চেষ্টায় রাস্তায় নেমে তীব্র আন্দোলন কই? নতুন রোগ তেড়েফুঁড়ে আন্দোলন শুরু করে হঠাৎ করে আন্দোলন থেকে হারিয়ে যাওয়া। আনিস খান, আর জি কর কাণ্ড, বেআইনি শিক্ষক নিয়োগ— সব ক্ষেত্রেই তা দেখা যাচ্ছে।
একটা সফল ব্রিগ্রেড সাময়িক স্বস্তি দিতে পারে, কিন্তু তার দ্বারা সাংগঠনিক উন্নতি হয় কি? প্রয়োজন সমকালের সমস্যা, বেকার সমস্যা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ইত্যাদির বিরুদ্ধে জোরদার আন্দোলন। কিন্তু, নেতৃত্বের কি বোধোদয় হবে?
স্বপন চক্রবর্তী, জগৎবল্লভপুর, হাওড়া
অন্য পন্থা
রণবীর সমাদ্দার তার ‘ধোঁয়াশায় ভরা ঐতিহ্য’ প্রবন্ধে শতবর্ষ উত্তীর্ণ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির বেহাল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে কয়েকটি দুর্বলতাকে যথার্থ চিহ্নিত করেছেন। সোভিয়েট ইউনিয়নের পতনের পর থেকে বিশ্ব জুড়ে বামপন্থীরা দুর্বল হতে থাকেন। উদার অর্থনীতির দখিনা বাতাস বিশ্বের মানবসমাজকে বামপন্থী আদর্শের বিপরীতে ভোগবাদী ও আত্মকেন্দ্রিক আদর্শের দিকে টেনে নিয়ে যেতে সাহায্য করছে। বিজ্ঞান প্রযুক্তির প্রভূত উন্নতির ফলে মার্ক্সবাদে উল্লিখিত শ্রমিক শ্রেণির চরিত্রের বেশ কিছু গুণগত পরিবর্তন লক্ষ করা যাচ্ছে। এ দেশে সংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের তুলনায় অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষিতে কর্পোরেট পুঁজি ও মধ্যস্বত্বভোগীদের দাপটের ফলে ছোট চাষিরা কৃষিকার্য ছেড়ে দিয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রে শ্রমিকের কাজ বেছে নিচ্ছেন।
দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো এই অসংগঠিত এবং ছন্নছাড়া শ্রমিক কৃষকদের তাৎক্ষণিক কিছু অর্থনৈতিক সুবিধা ও ধর্মীয় বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতার সুখ ভোগ করছে। শতবর্ষ উত্তীর্ণ ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি এই জটিল এবং সম্ভাবনাময় পরিস্থিতিকে নিজেদের অনুকূলে আনতে পারে। তার জন্য ঐক্যবদ্ধ ভাবে রুটি-রুজির প্রশ্নে তীব্র গণআন্দোলন গড়ে তোলা একটি পন্থা হতে পারে।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)