সোমা মুখোপাধ্যায়ের ‘কোন অতলের দিকে’ (৭-৬) প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। বহুচর্চিত ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটানোর জন্য তৃণমূলকে কোনও কুকথার ফুলঝুরি ছোটাতে হয়নি, বরং বামফ্রন্ট সরকারের নানা রকম অনৈতিকতা ও কতিপয় বাম নেতৃত্বের বিভিন্ন কদর্য ভাষা ও তাঁদের আত্ম-অহঙ্কারকে জনগণের সামনে তুলে ধরেই নির্বাচনী যুদ্ধে সাফল্যের সন্ধান পেয়েছিল। বিরোধী আসনে থাকলে ক্ষমতা দখলের রাজনীতির কৌশলকেই যে পাখির চোখ করতে হয়, সেই একাগ্রতাই সসম্মানে উত্তীর্ণ করেছিল বর্তমান শাসক দলকে।
কিন্তু ক্ষমতা দখলের পর থেকেই প্রতিটি শাসক দলেরই প্রধান চিন্তা হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতা হারানোর ভয় এবং তৃণমূলও এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম নয়। সেই কারণেই দলের নেতা-নেত্রীদের বিভিন্ন কদর্য ও প্ররোচনামূলক বক্তব্য, মানুষকে নানা রকম ভাবে ভয় দেখানো এবং পুলিশের একাংশকে অনুগত করে রাখা— এই সব ঘটতে দেখা যাচ্ছে। সবই বিরোধী কণ্ঠস্বরকে দমন করার অঙ্গ হিসাবেই দেখা হয়। দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এই সমস্ত ঘটনাতেই দলের প্রচ্ছন্ন এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রকাশ্যেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মদত লক্ষ করা যায়। আবার বিরোধী দলকে দুর্বল করার অভিপ্রায়ে সারা বছর ধরেই চলে বিরোধীদের ভয় বা বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে বিরোধী নেতা-নেত্রীদের শাসক দলে যোগদানের মেলা। যদিও ক্ষমতায় আসার আগে বিপক্ষ দলের এই সমস্ত নেতৃত্বের বিরোধিতাই ছিল মানুষের মন জয় করার প্রধান অস্ত্র। কিন্তু শাসক দলে যোগদানের পর এঁরাই আর তাঁদের বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই করেন না। বিবেচিত হন দলের সম্পদ হিসাবে।
দোষীদের বিরুদ্ধে শীর্ষ নেতৃত্ব কঠোর না হলে, জনগণের ক্রোধ ও ঘৃণা এক দিন প্লাবনে পরিণত হবে। পূর্বেও দেখা গিয়েছে, এতে সরকার তলিয়ে যাওয়া কোনও আশ্চর্যের বিষয় নয়। তবে, রাজ্যের একদা গর্বের সংস্কৃতিরও যে ভাবে দিনের পর দিন অবনমন ঘটছে, এর বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি হওয়া সত্যিই প্রয়োজন।
অশোক দাশ, রিষড়া, হুগলি
বিষাক্ত পরিবেশ
সোমা মুখোপাধ্যায়ের ‘কোন অতলের দিকে’ প্রবন্ধটি বতর্মান পরিস্থিতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের নেতারা একের পর এক কুকথার বর্ষণ করে, জেল খাটার পরেও শাসক দলের ছাতার তলায় আশ্রয় পেয়ে যাচ্ছেন কী করে? তবে, সরকারি ক্ষমতাতেই থাকুন, বা সরকারি ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষায় নির্বাচনে লড়ুন, সারা বছর এই চিত্রই আমরা দেখি, শুনি। সারা বছর সরকারি দলের এবং বিরোধী দলের কাদা ছোড়াছুড়িতে অকথা কুকথার অনর্গল বর্ষণ। এতে রাজনীতি সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিতৃষ্ণা বেড়েই চলেছে। ভাইরাল অডিয়ো ক্লিপটি যে ঠিক নয়, এখনও প্রমাণিত হল না। এত ধরনের হুমকি শোনা গেল। কিন্তু রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে শাস্তি হয়েছে কি?
বিরোধী শিবিরের তাবড় নেতাদের মধ্যেও অনেকেই প্রায়ই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে রাজনীতির অভিধান বহির্ভূত কুকথায় আক্রমণ শাণান। অথচ এই নেতাদের তো জানা উচিত, মনে রাখা উচিত, এ দেশে রাজনীতির সংস্কৃতি, ইতিহাস কত উন্নত— জনগণ ও দেশের জন্য কাজ করা। যা এ দেশে বিপ্লবীরা আমরণ করেছেন। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ছিলেন এমন এক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, যাঁর স্মৃতি, আদর্শ আজও দেশের মাটিতে প্রবহমান। স্বাধীনতা আন্দোলনে জাতির জনক গান্ধীজির সঙ্গে ছিল সুভাষের আদর্শগত বিরোধ। নেতাজি সংগ্রামের যে পথে বিশ্বাস করতেন, গান্ধীজির ভাবনা তার চেয়ে আলাদা ছিল। তবু নেতাজি বা তাঁর অনুগামীরা এক মুহূর্তের জন্য জাতির জনককে অসম্মান করেননি। এটাই তো এ দেশের সংস্কৃতি। আজ দেশের শাসক ও বিরোধী দলগুলির নেতা-মন্ত্রীদের কদর্য মন্তব্যের ভিড়ে রাজনৈতিক পরিবেশ কর্দমাক্ত, বিষাক্ত হয়ে চলেছে। আগামী প্রজন্মের কাছে তাঁদের আচরণ কোনও দিশা দেখায় না। এ দেশের সংস্কৃতিকে রক্ষা করতে সাধারণ মানুষের জোরালো প্রতিবাদ খুব জরুরি হয়ে উঠেছে।
খাদিজা বানু, বহরমপুর, মুর্শিদাবাদ
ক্ষত ও ক্ষতি
‘কোন অতলের দিকে’ পড়লাম। অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক ও প্রতিবাদী, সাহসী লেখা। তার পরও কিছু কথা বলার থাকে। রাজনীতিতে নীতি, আদর্শ বলে এখন আর কিছু নেই। কুকথার স্রোত, হুমকি সংস্কৃতি সমানে চলছে। লেখক নিরপেক্ষ ভাবে এ সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের নাম উল্লেখ করে দেখিয়েছেন, কিছু প্রশ্ন পাঠকসমাজের কাছে তুলে ধরেছেন। খানিকটা বলা চলে, চোখে চোখ রেখেই শীর্ষ নেতৃত্বের গোচরে বিষয়টি এনেছেন। এতে কিছু পরিবর্তন হোক বা না হোক, অন্তত একটা সাবধানতা হিসাবে কাজ করবে বলে আশা করি। আসলে গত বেশ কয়েক মাসের মধ্যে পর পর এই রাজ্যে যা ঘটে চলেছে তার সব ক’টিতেই শাসকদের চরিত্র, স্বরূপ জনমানসে স্পষ্ট হয়েছে। ফলে জনসাধারণের মধ্যেও একটা গা-সওয়া ভাব এসে গিয়েছে। তাঁরা মনে করেন, যত বড় অন্যায়ই শাসক দল করুক না কেন, কিছুই হবে না। সেই নীতিতেই শাসক দলও বেশি মাত্রায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছে।
দিনের আলোর মতো স্পষ্ট ঘটনাগুলোকে ধামাচাপা দেওয়া, দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হওয়া, সব কিছুর মধ্যেই বিরোধীদের চক্রান্ত দেখা, বহিরাগতদের যোগসূত্র খুঁজে পাওয়াই এঁদের অভ্যাস। শুধু ক্ষমতায় থাকা না থাকা নিয়েই ভাবছেন। দেশ তথা রাজ্য তথা সমাজ সভ্যতা সংস্কৃতি রাজনৈতিক পরিবেশ কোন পর্যায়ে চলে যাচ্ছে, এ নিয়ে ভাবার অবকাশ নেই।
বিদ্যুৎ সীট, জগদল্লা, বাঁকুড়া
উল্টো দিকে
সোমা মুখোপাধ্যায়ের ‘কোন অতলের দিকে’ প্রবন্ধটি সময়োপযোগী এবং যথোচিত, এই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ নেই। শুধু একটা কথাই বলার, যে পুলিশ আধিকারিকের সঙ্গে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় সে দিন হয়েছিল, তাতে এই প্রমাণ কিন্তু মিলছে না যে, ওই আধিকারিক তাঁর কর্তব্যে সদা সর্বদা অবিচল থাকেন। যাঁর সঙ্গে কথোপকথনের রেকর্ডিং ডিজিটাল দুনিয়ায় এক জনকে ভিলেন বানিয়ে দিল, মনে রাখতে হবে, অপদস্থ হওয়ার পরেও তাঁর পক্ষ থেকে কোনও রেকর্ডিং বা আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য আমাদের সামনে আসেনি। তবে তার জন্য ওই কুকথা প্রয়োগকারীর দোষ ক্ষালন হয়ে যায় না।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
উত্তম পুরুষ
এই মাসে তাঁকে বড় মনে পড়ে। ২৪ জুলাই ১৯৮০। দেখতে দেখতে কেটে গেল ৪৫টা বছর। তিনি নেই। তিনি উত্তমকুমার। দেশভাগের ধাক্কা, শরণার্থী আগমন, বেকারত্ব, দারিদ্র আর কোনও রকমে টেনেটুনে চলা বঙ্গসমাজে তিনি ছিলেন অন্ধকারে আলোর আভা। তাঁর চলচ্চিত্রে রূপায়িত চরিত্রগুলো অবলম্বন করে মানুষ অনেক অপ্রাপ্তির শূন্যতাকে ঢাকা দিয়ে বাঁচার পথ পেয়েছিলেন। মনে আছে সে দিন তাঁর মৃত্যুসংবাদ পাওয়া মাত্রই মানুষ বাড়ি থেকে বাইরে বেরিয়ে এলেন। শবযাত্রায় সঙ্গী হলেন। প্রত্যন্ত এলাকায় পর্দা টাঙিয়ে দিনের পর দিন দেখানো হল উত্তম চিত্রমালা। অনুরোধের আসরে দিনরাত বাজল তাঁর গান।
সব রকম চরিত্র ও পোশাকে মানানসই বাঙালি ছিলেন তিনি। পুরনো ধারার অভিনয় রীতিকে ঝেড়ে ফেলে খানিক ‘চড়া দাগের অভিনয়’ দিয়েই সেই যে দর্শককে আচ্ছন্ন করে ফেললেন, তার রেশ এখনও বুকের ভিতর বহন করে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। তাই হয়তো আজও তিনি প্রাসঙ্গিক।
প্রতিমা মণিমালা, হাওড়া
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)