E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: অধিকারে কোপ

২০২০ সালে অতিমারির সময়কালে প্রচলিত শ্রম আইন পরিবর্তিত করে তৈরি হয় নতুন চারটি শ্রম কোড বা শ্রম বিধি, যার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ লড়াই আন্দোলন সংগ্রামে অর্জিত শ্রমিকের অধিকারগুলিকে খর্ব করা হয়েছে।

শেষ আপডেট: ২২ অগস্ট ২০২৫ ০৫:৫৮

নব দত্তের ‘ধর্মঘটের পরে কী?’ (৭-৭) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু বক্তব্য। হঠাৎ কী কারণে স্বাধীনতার পর এ-যাবৎ পর্যন্ত প্রচলিত শ্রম আইন পরিবর্তন করতে হচ্ছে? আশঙ্কা হয়, এই সময়ে সরকার রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পসংস্থা ও কলকারখানাগুলিকে বেসরকারিকরণ করতে চায়। তার জন্য প্রচলিত শ্রম আইনকে শিথিল করা প্রয়োজন। তাই মালিকদের বা নিয়োগকর্তার স্বার্থে এই চারটি শ্রম কোড চালু করা হচ্ছে, যা শ্রমিক-স্বার্থ বিরোধী।

২০২০ সালে অতিমারির সময়কালে প্রচলিত শ্রম আইন পরিবর্তিত করে তৈরি হয় নতুন চারটি শ্রম কোড বা শ্রম বিধি, যার মধ্য দিয়ে দীর্ঘ লড়াই আন্দোলন সংগ্রামে অর্জিত শ্রমিকের অধিকারগুলিকে খর্ব করা হয়েছে। যেমন ৮ ঘণ্টার কাজের অধিকার আজও আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত, কিন্তু এই শ্রম কোড চালু হলে শ্রমিকদের ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা কাজ করতে হবে। এই বিধি অনুসারে চুক্তি প্রথায় নিয়োগকে সর্বত্র চালু করতে ‘ফিক্সড টার্ম এমপ্লয়মেন্ট’ চালু করা হচ্ছে, যা কার্যত স্থায়ী শ্রমিক নিয়োগ প্রথা রদ করার শামিল।

সর্বত্র ‘ক্যাজ়ুয়াল’ শ্রমিক, চুক্তিভিত্তিক শ্রমিক, ঠিকাদার শ্রমিক বা অস্থায়ী শ্রমিক দিয়ে স্থায়ী শ্রমিকের কাজ করানো হবে, তার সম্ভাবনা যথেষ্ট। সংগঠিত সংস্থায় অসংগঠিত শ্রমিকের সংখ্যা ক্রমবর্ধমান হবে। যে শিল্পসংস্থায় ৩০০ জন বা তার কম সংখ্যক শ্রমিক-কর্মচারী কর্মরত সেখানে লে-অফ, লকআউট করতে সরকারের অনুমতির প্রয়োজন হবে না। পূর্বের আইন অনুযায়ী এই সংখ্যা ছিল ১০০ জন। বর্তমানে ৭০ শতাংশ শিল্পসংস্থাতেই ৩০০ বা তার কম সংখ্যক কর্মচারী আছেন। এই ধরনের সংস্থায় কাজ করেন দেশের ৭৪ শতাংশ শ্রমিক-কর্মচারী। এঁরা সবাই ‘হায়ার অ্যান্ড ফায়ার’ নীতির শিকার হয়ে পড়বেন। সুতরাং, এই চারটি শ্রম কোড বাতিল ধর্মঘটের অন্য দাবিগুলির মধ্যে অন্যতম দাবি। এই কোডে বলা হয়েছে ওভারটাইম বাধ্যতামূলক। নারী-শ্রমিকরাও রাতের বেলা কাজ করতে বাধ্য থাকবেন। অথচ সামাজিক সুরক্ষা ও উপযুক্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থাগুলির কথা উপেক্ষিত হয়েছে। তাই ঐতিহাসিক ভাবেই ধর্মঘট, শ্রমিকের ন্যায্য অধিকার দাবি এবং ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন ও লড়াইয়ের মধ্য দিয়েই অধিকারগুলি রক্ষা করার পথে হাঁটতে হবে। কোনও ধর্মঘটই এক দিনের হয় না, ধর্মঘটের প্রভাব সুদূরপ্রসারীই হতে দেখা যায়। এটাই কিন্তু চিরসত্য।

দীপক সাহা, কলকাতা-১৪০

অন্ধকারে

‘ধর্মঘটের পরে কী?’ প্রবন্ধে নব দত্ত যথার্থই বলেছেন, শ্রমিক আন্দোলন কেবল কিছু সুবিধা আদায়ের লড়াই নয়। এ হল, সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার লড়াই। সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ধর্মঘট পরিচালনা করা এবং তার পরবর্তী কার্যক্রম নির্ধারণ ও তা কার্যকর করা হচ্ছে কি না, সেটা বিচার্য হবে।

এ বারের ধর্মঘটের অন্যতম দাবি ছিল, শ্রমিক-স্বার্থ বিরোধী চারটি ‘শ্রম বিধি’ বা লেবার কোড বাতিল করতে হবে। আগের ২৯টি শ্রম আইন যে শ্রমিক-স্বার্থকে সব দিক থেকে রক্ষা করত এমন না হলেও বর্তমান শ্রম বিধি শ্রমিক-স্বার্থকে আরও বিপন্ন করে মালিকশ্রেণির স্বার্থ রক্ষার স্পষ্ট ইঙ্গিত নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। তার চেয়েও উদ্বেগের কথা, এই বিধি তৈরি হয়েছে মোট শ্রমিকের প্রায় ৯২ শতাংশ অসংগঠিত শ্রমিকে বাদ রেখে। শ্রম বিষয়টি যুগ্ম তালিকায় থাকায় রাজ্যের হাতে শ্রমক্ষেত্রে স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার যতটুকু অধিকার ছিল তাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি রাজ্যে শ্রম বিধি চালু করার ‘রুলস’ তৈরি হয়েছে। মালিকশ্রেণিকে সুবিধা দেওয়ার প্রশ্নে রাজ্য সরকারগুলির দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পার্থক্য না থাকার কারণে ‘রুলস’ তৈরিতে অনেক প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। সে কারণেই বোধ করি শ্রম বিধির মৌখিক বিরোধিতার পাশাপাশি ৯ জুলাইয়ের ধর্মঘট মোকাবিলার ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূল সরকারের তৎপরতার সঙ্গে কেরলে সিপিএম সরকারের তৎপরতার কোনও পার্থক্য খালি চোখে ধরা পড়ছে না।

প্রবন্ধকার ঠিকই বলেছেন, শ্রম বিধি বাতিলের দাবিতে সর্বভারতীয় ধর্মঘটের মুখে দাঁড়িয়ে ট্রেড ইউনিয়নগুলির মূলত চার ধরনের অবস্থান দেখা যাচ্ছে। এক দল শ্রম বিধির সামান্য বিরোধিতা করলেও সার্বিক ভাবে শ্রম বিধির সমর্থক এবং ধর্মঘট-বিরোধী রূপে প্রতিভাত। এক দল শ্রম বিধির বিরোধী এবং ধর্মঘটের আহ্বায়ক বা সমর্থক। আর এক দল শ্রম বিধি এবং ধর্মঘট দুয়েরই বিরোধী। এবং চতুর্থ ধরনে দেখি, এঁরা ধর্মঘটের সমর্থক এবং রাজ্য সরকারগুলির সমালোচক।

এই পরিস্থিতিতে শ্রম কোড-সহ অন্য দাবিসমূহ এবং তার সঙ্গে ধর্মঘটের বহুমুখী চরিত্রকে স্পষ্ট ভাবে বোঝা সমস্ত স্তরের ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তা ছাড়া আছে শ্রমজীবী মানুষের বোঝার ক্ষমতা অনুযায়ী তাঁদের বোঝানোর মধ্য দিয়ে ধর্মঘটের সঙ্গে তাঁদের যুক্ত করা, যা কতটা সম্ভব হচ্ছে, সে নিয়েও সংশয় আছে। কিন্তু দুঃখের হলেও সত্য যে, ধর্মঘটের আহ্বায়কদের একটা বড় অংশ এই বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে দেখেন না। এটাকে তাঁরা ভোট রাজনীতির একটা অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসাবে দেখেন। সে কারণেও শ্রমজীবী মানুষের একটা বড় অংশ ধর্মঘটের মধ্যে তাঁদের স্বার্থের বিষয়টি যে যুক্ত তা বুঝতে পারেন না। এ ভাবেই শ্রমিক নেতাদের থেকে সাধারণ শ্রমিকরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন, শ্রমিক সংগঠনগুলির উপর তাঁরা আস্থা হারাচ্ছেন। পরিণামে সমাজমুক্তির পরিপূরক শ্রমিক আন্দোলনের ভবিষ্যৎ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

গৌরীশঙ্কর দাস, খড়্গপুর, পশ্চিম মেদিনীপুর

ন্যায়ের লড়াই

নব দত্তের ‘ধর্মঘটের পরে কী?’ প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। দেশের নানা সমস্যায় জর্জরিত কোটি কোটি শ্রমিককে ৯ জুলাই সর্বভারতীয় ধর্মঘট করতে হল। ঠিক তার আগেই সেই বিষয়ে এই প্রবন্ধ অত্যন্ত সুবিবেচিত, সুবিশ্লেষিত রচনা। দেশের অধিকাংশ কেন্দ্রীয় কর্মী সংগঠন এবং বেশ কিছু অন্য কর্মী সংগঠন এই সর্বভারতীয় ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল। মূল দাবি ছিল, চারটি কেন্দ্রীয় শ্রম বিধি বাতিল করা হোক।

ট্রেড ইউনিয়নগুলির আরও বক্তব্য এই যে, তিনটি কৃষি আইন যেমন রদ করা হয়েছে তেমনই চারটি শ্রম বিধিও রদ করতে হবে। এ কথা বাস্তব যে কৃষি আন্দোলন যতখানি জোরদার হয়েছিল, শ্রম আন্দোলন সেই বিক্রম বা তেজস্বিতা প্রকাশ করেনি, ২০১৯-২০২০’তে ওই চারটি শ্রম বিধি সংসদে পাশ হল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে করোনা-সঙ্কটের কারণে ওই শ্রম বিধির বিরুদ্ধে আন্দোলন করা হয়নি।

শ্রমিকরা তেমন প্রতিবাদ করে উঠতে পারলেন না। কারণ, স্ত্রী, পুত্রকন্যার মুখে অন্ন দিতে হবে, কাজেই তাঁরা রাজি হয়েছেন, এমনকি কাজের সময়সীমার ক্ষেত্রেও আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছেন। চরম বেদনাদায়ক বিষয় এই যে নিরাপত্তার অভাবে শ্রমিকের চোখের সামনে আপন সহকর্মী, প্রাণের বন্ধু, কাজ করতে করতে হঠাৎ করে যন্ত্রদানবের কলেবরে মাংসপিণ্ডে রূপান্তরিত হয়ে গেলেন অতি অল্প সময়ে, শুধু চোখে দেখতে হল, কিছু করা গেল না। শ্রমিক নেতাদেরও যে সেই আগের মতো প্রভাব নেই, নেই সেই বাঁধন।

প্রবন্ধকারের কথাগুলি এই চিন্তাকেই পোক্ত করে যে, শ্রমিকের আইনি দাবিদাওয়ার লড়াই হল সামাজিক ন্যায়ের লড়াই, প্রাপ্যের জন্য লড়াই, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য লড়াই, দৃঢ় সঙ্কল্প থেকে উঠে আসা লড়াই। তাই এই সংগ্রাম আসলে মানুষেরই সংগ্রাম। তার পালে হাওয়া জোগাতে তাই শ্রমিক সংগঠনগুলিকেও আবার শক্তিশালী করতে হবে, বুঝতে হবে ধর্মঘট একটি সাধারণ প্রতিবাদ মাত্র নয়, এ হল শ্রমিকের পাওনা বুঝে নেওয়ার এক লড়াই। তার সঙ্গে মালিক বা শাসককেও কিন্তু এ কথাটি বুঝতে হবে, তাঁরা যেন কদাপি শ্রমিককে দুর্বল না ভাবেন।

মানিক কুমার বসু, কলকাতা-১০৮

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Labour Code Workers

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy