E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: সাদা কালো মায়া

সাদা-কালোয় চিত্রায়িত পথের পাঁচালী কিংবা সাদা পাতায় কালো অক্ষরে ছাপা রঙিন প্রেমের কবিতার মতো দর্শক-মনে রামধনুর রং ছড়িয়ে গেছে বহু বছর ধরে।

শেষ আপডেট: ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ ০৭:৩৮

পঙ্কজ সাহার ‘অর্ধশতকের ও-পার হতে’ (৮-৮) প্রবন্ধের সঙ্গের ছবিতে দূরদর্শনের প্রতীকটি চোখে পড়তেই মানসপটে ভেসে উঠল অবিস্মরণীয় এক আবহসঙ্গীতের তালে টেলিভিশনের পর্দায় ধীরে ধীরে প্রস্ফুটিত হতে থাকা দূরদর্শনের পরিচিতি-চিহ্নটি। ১৯৮০-র মার্চ মাসে কাঠের ভাঁজ করা (ফোল্ডিং) দরজাওয়ালা টিভি আনা হল যে দিন, বাড়িতে সে দিন উৎসব। সময় ও প্রযুক্তির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বাড়ির টিভি সেটের ব্র্যান্ড বদলেছে বহু বার, বেসরকারি চ্যানেলের সংখ্যা বৃদ্ধি হয়েছে দ্রুত লয়ে। তবুও দূরদর্শন কলকাতার সাদা-কালো দিনগুলোর অজস্র বর্ণময় ঘটনাপ্রবাহ, অসংখ্য দর্শকের মস্তিষ্ক কোষে ও হৃদয়ের কুঠুরিতে স্থায়ী ভাবে সঞ্চিত হয়ে আছে।

দূরদর্শনের সৌজন্যে টেলিভিশনের পর্দায় সাদা-কালো ছবিতে সম্প্রচারের সেই দিনগুলো, সাদা-কালোয় চিত্রায়িত পথের পাঁচালী কিংবা সাদা পাতায় কালো অক্ষরে ছাপা রঙিন প্রেমের কবিতার মতো দর্শক-মনে রামধনুর রং ছড়িয়ে গেছে বহু বছর ধরে। সেই দূরদর্শন কলকাতার ১৯৭৫ থেকে পথচলার ৫০ বছর পূর্তি হল ৯ অগস্ট ২০২৫-এ। প্রবন্ধ থেকে জানা গেল, সম্প্রচার শুরুর সময়কালে অ্যানালগ জমানায় ম্যাগনেটিক টেপে গৃহীত ও সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানের কোনও প্রতিলিপি সংগ্রহে না রাখার পরিবর্তে মুছে ফেলে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে ওই একই ম্যাগনেটিক টেপে নতুন অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং হত। দূরদর্শন কলকাতার পথ চলার ইতিহাস রচনায় প্রামাণ্য দলিল হিসাবে আবশ্যিক, সমসাময়িক দৃশ্য-শ্রাব্য কার্যক্রমকে সংগ্রহে না রাখতে পারাটা নিঃসন্দেহে অপূরণীয় এক মহাশূন্যতা তৈরি করেছে। এই তথ্য জানার পর, দূরদর্শন কলকাতার জন্মলগ্ন থেকে জড়িত প্রবন্ধকারের ব্যথিত হৃদয়ের সঙ্গে সেই সোনালি দিনগুলোর দর্শককুলও সমব্যথী না হয়ে পারবেন না। দূরদর্শন তার সামাজিক দায়বদ্ধতায় নিরন্তর অবিচল থেকে বঙ্গ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হয়ে স্বচ্ছ ও সুনির্দিষ্ট পথে চলতে থাকুক। অ্যানালগ থেকে ডিজিটাল প্রযুক্তির জমানায় উত্তরণের মহাকাব্যিক অধ্যায়ে, টিভির জন্মলগ্ন থেকে শুরু করে বিগত পঞ্চাশ বছরের ইতিহাস সর্বজনসমক্ষে আনবার প্রয়াসে সদর্থক উদ্যোগ গৃহীত হবে এবং তার সফল বাস্তবায়ন ঘটবে, পরিশেষে এই আশা রইল।

অরিন্দম দাস, হরিপুর, উত্তর ২৪ পরগনা

দর্শকের দরবার

পঙ্কজ সাহার ‘অর্ধশতকের ও-পার হতে’ শীর্ষক প্রবন্ধে বর্ণিত কলকাতা দূরদর্শনের প্রথম দিনের সম্প্রচার দেখার সৌভাগ্য আমার ক্ষেত্রে না ঘটলেও এই দূরদর্শনের সূত্রেই পুরনো দিনগুলোর ছবি একটার পর একটা ভেসে উঠতে থাকে স্মৃতিপটে। আসলে, দূরদর্শন শুধুমাত্র রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন একটা দৃশ্য-শ্রাব্য চ্যানেল নয়, যে বৈদ্যুতিন যন্ত্রের মাধ্যমে উক্ত চ্যানেলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হত, সেটিও ওই একই নামে পরিচিত। তাই ইংরেজিতে ‘টেলিভিশন’ নামক যন্ত্রটি, যার বাংলা প্রতিশব্দ দূরদর্শন, আমাদের জীবনে আক্ষরিক ভাবেই নিয়ে এসেছিল একটা বিপ্লব। বহু দূরে অনুষ্ঠিত টেস্ট ক্রিকেট ক্রীড়াস্থলে না গিয়ে পাড়া থেকে যে আমরা ‘লাইভ’ দেখতে পাওয়ার সুযোগ পেলাম, এক সময় তা তো আমাদের কল্পনার বাইরেই ছিল। ওই সময় দেশে, বিশেষ করে কোনও মেট্রো শহরে খেলা হলে সরাসরিই তা দেখানো হত। শুরুর দিকে পাড়ায় পাঁচ-ছ’টা ঘরে এই যান্ত্রিক সেটটির পদার্পণ ঘটলেও ক্ৰমে তা বাড়তে থাকে।

নিজেদের ঘরে বসে বিজ্ঞানের এই অবদানকে উপভোগ করতে এক দশকেরও বেশি সময়কাল অপেক্ষা করতে হয়েছিল বলে ওই ভাগ্যবান পরিবারগুলোর কোনও একটাতে কিংবা পাড়ার একটা বড় ক্লাবে গিয়ে বড়দের সঙ্গে আমাদের মতো কিশোররা খেলা দেখতে বসে পড়তাম। ভাবতামও না, সংশ্লিষ্ট টিভি মালিক কী ভাবছেন। তাঁরাও অবশ্য কখনও কোনও অসন্তোষ আমাদের বুঝতে দেননি। এমনও হয়েছে গৃহকর্তার পরিবারের কেউ ঘরের বাইরে থেকে খেলা দেখছেন, আর আমরা ঘরের মধ্যে।

এখনও মনে পড়ে, কিংবদন্তি পেলের নাম নিয়ে মায়ের কাছে বায়না করাতে মা একটা পঁচিশ বা পঞ্চাশ পয়সার কুপন কিনে দিয়েছিলেন পাড়ার ক্লাবে কসমস বনাম মোহনবাগান ম্যাচটি দেখার জন্যে। অনতিপ্রশস্ত ক্লাবঘর ভর্তি লোকের মধ্যে শারীরিক আরাম বিসর্জন দিতে হলেও খেলাটা দেখে যা আনন্দ পেয়েছিলাম, তা কোনও দিন ভোলার নয়। সেটা ছিল ১৯৭৭। পাঁচ বছর বাদে, ১৯৮২ সালে সংঘটিত হল আর একটা বিপ্লব। স্পেনে অনুষ্ঠিত ফুটবল বিশ্বকাপের দুটো সেমিফাইনাল আর ফাইনাল ম্যাচের সরাসরি সম্প্রচার। এর এক বছরের মধ্যে, ১৯৮৩ সালে আবার বিশ্বকাপ ক্রিকেট, ইংল্যান্ডের মাটিতে যা ভারতকে প্রথম বার জয়ের মুকুট পরিয়ে ইতিহাস তৈরি করল। এই সব খেলারই ভারতীয় সময় ছিল রাতের বেলা। খেলা দেখতে চলে যেতাম কলেজের এক সহপাঠীর বাড়ি। সেও আবার কাছেপিঠের কোনও জায়গায় নয়। হাওড়া থেকে ট্রেনে করে তিন-তিনটে স্টেশন। খেলা দেখে ভোরবেলায় পূর্ব কলকাতার বাড়িতে ফিরে আসতাম। সে কী উন্মাদনা! বিশ্ব ফুটবলের স্বাদ সেই যে টের পেলাম, তার পর থেকে ঘরোয়া ফুটবল আর দেখতেই ইচ্ছে করত না। খুবই জোলো লাগত। এর পর এল ১৯৮৬-র সেই বিখ্যাত বিশ্বকাপ। মাঠে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন ফুটবলের রাজপুত্র। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে তাঁর ‘হ্যান্ড অব গড’-খ্যাত গোল। বিতর্ক। চোখ সার্থক করা তাঁর বাঁ-পায়ের জাদু। অবিস্মরণীয়! এ জন্য কার যে ধন্যবাদ বেশি প্রাপ্য— মারাদোনা না দূরদর্শন, তা নিয়ে এখনও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি।

চিত্রহার ও চিত্রমালা-র মতো সিনেমার গানের বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান ছাড়াও শিক্ষা ও সংস্কৃতিমূলক যে সব অনুষ্ঠান প্রচারিত হত, সব বয়সের লোকেদেরই তা খুব ভাল লাগত। আকাশবাণী থেকে প্রচারিত ‘স্থানীয় সংবাদের খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়’-এর গম্ভীর কণ্ঠস্বরের সঙ্গে দূরদর্শনে তাঁর অবয়বটাও তখন দেখতে পাচ্ছি, সঙ্গে ছন্দা সেন, তরুণ চক্রবর্তী, আরও পরে এলেন ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়, মধুমন্তী মৈত্র কিংবা ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য-এর মতো সংবাদ পাঠিকা। সংবাদ পাঠ থেকে শুরু করে সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক অনুষ্ঠান কেমন হওয়া উচিত— তার পথপ্রদর্শক হিসাবে দূরদর্শনের ভূমিকা অনস্বীকার্য। দুঃখের কথা, দূরদর্শনের দর্শকের দরবারে-র মতো দর্শক-শ্রোতাদের মতমত যাচাই করার কোনও অনুষ্ঠান আজকের বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে দেখি না। অনুষ্ঠানের উন্নতি সাধনে এই ধরনের অনুষ্ঠানের প্রয়োজন। দূরদর্শনের লোগো ভেসে ওঠার সময় নেপথ্যে পণ্ডিত রবিশঙ্করের যে সুর ঝঙ্কৃত হত, তা আজও শুনলে মনটা কেমন করে ওঠে।

গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪

ভোলা যায় না

তরুণ চক্রবর্তীর ‘দুর্গানাম জপ করতে করতে মুখস্থ করেছিলাম আঙুলের হরেক সঙ্কেত’ (রবিবাসরীয়, ১০-৮) শীর্ষক প্রবন্ধটি অত্যন্ত মনোগ্রাহী। দূরদর্শনের সম্প্রচারিত অনুষ্ঠানগুলি পশ্চিম বর্ধমান জেলার বাসিন্দাদের দেখার সৌভাগ্য হয় ১৯৮৪ সালে। আমাদের ছাত্রজীবনে সেই সময় দূরদর্শনে ছোটদের অনুষ্ঠানগুলির মধ্যে জনপ্রিয় ছিল হরেকরকমবা ও চিচিং ফাঁক।

ইন্দিরা গান্ধীর মৃত্যুর প্রথম খবর কলকাতা দূরদর্শনে সরাসরি তরুণ চক্রবর্তীর সংবাদ পাঠের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার কথা স্পষ্ট মনে আছে। তাঁর কলমে কলকাতা দূরদর্শনের স্মৃতি সজীব হয়ে উঠেছে।

দূর্বাদল চট্টোপাধ্যায়, মিঠানী, পশ্চিম বর্ধমান

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

doordarshan

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy