‘হাতুড়িতন্ত্র’ (২৫-১০) শীর্ষক সম্পাদকীয়ের পরিপ্রেক্ষিতে কিছু কথা। কেন্দ্রে এনডিএ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে স্বশাসিত সংস্থাগুলিকে নিজ নিয়ন্ত্রণে আনার যে প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে, ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউট (আইএসআই) তার নবতম সংযোজন। আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম করতে যা যা প্রয়োজন, সুচারু ভাবে সেই প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করা চলছে, গণতন্ত্রের মধ্যে।
এখন সংবেদনশীল মনের চেয়েও বেশি পছন্দ বাস্তব জীবনের অর্থ রোজগার। আইএসআই প্রতিষ্ঠানে পড়ার জন্য যে ন্যূনতম খরচের ব্যবস্থা রয়েছে, তার আমূল পরিবর্তন করে দিতে চায় কেন্দ্রীয় সরকার। অর্থাৎ, গরিব ছেলেমেয়েদের পড়ার জন্য কি সুযোগ দিতে নারাজ প্রশাসন? ‘ফেলো কড়ি মাখো তেল নীতি’তে বিশ্বাসীদের কাছে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা দোষের। প্রশ্ন জাগে, আমলাতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারি সমস্ত সুযোগ-সুবিধাপ্রাপ্ত দায়িত্বশীল আমলারাও কি নিজেদের বিবেক-বুদ্ধি বিসর্জন দিয়েছেন? তাঁদের বিভিন্ন সুবিধার যে আর্থিক ভার সরকার বহন করে থাকে, সেটাও সাধারণ জনগণের করের টাকাই, এ কথা তাঁদের ভুলে গেলে চলবে না।
সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, সরকারের আইন প্রণয়নের আরও একটি লক্ষণ— আলোচনাহীনতা। কথাটা একশো শতাংশ খাঁটি। প্রশ্নহীন আনুগত্যই এ ক্ষেত্রে একমাত্র লক্ষ্য। সমালোচনামূলক বিরোধিতা যে শেষ পর্যন্ত গণতান্ত্রিক কাঠামোকেই মজবুত করে, সেই সহজ সত্যটা মানতেও নারাজ তারা। তাদের নীতিই তোমার নীতি, এ রূপ একটি ধ্যানধারণা কায়েম হয়ে গিয়েছে। আমলারাও সরকারের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে অভূতপূর্ব একটি শাসনব্যবস্থা কায়েম করে চলেছেন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের থেকে রাজনীতি এবং সরকারি হস্তক্ষেপ দূর করে অবাধ ও নিরপেক্ষ সুষ্ঠু শিক্ষাব্যবস্থার আয়োজন করার কথা মনীষীরা বলে গিয়েছেন। আর বাস্তবে ঘটে চলেছে তার উল্টোটা।
রাজা বাগচী, গুপ্তিপাড়া, হুগলি
ক্ষতির মূলে
‘সৌন্দর্যের আড়ালে ক্ষত’ (৩১-১০) প্রবন্ধের লেখক অশোক ভট্টাচার্য কিছু দিন আগে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড় এবং ডুয়ার্সের ধারাবাহিক ক্ষতির হাত থেকে রেহাই পেতে কিছু প্রশংসার্হ জরুরি পদক্ষেপ করার দাবি জানিয়েছেন। যেমন জলাশয়, সবুজ এলাকা রক্ষার দাবি উঠে এসেছে তাঁর লেখায়, তেমনই আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে পাহাড়ে বেশি উচ্চতায় নির্মিত গৃহ এবং হোমস্টে ভেঙে দিতে বলার সাহস দেখিয়েছেন। তিস্তা অববাহিকায় নতুন বাঁধ নির্মাণ স্থগিত রেখে পাহাড়ের সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত সেবক-রংপো রেলপথের কাজ সাময়িক বন্ধ রেখে বৈজ্ঞানিক-পরিবেশগত নিরীক্ষার প্রয়োজনীয়তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেছেন।
হিমালয়ের মতো নবীন পর্বতের স্থিতিশীলতাকে অস্বীকার করে যে কর্মযজ্ঞ বহমান, স্বচক্ষে দেখে এসেছি গত বছর। যে ভাবে পাহাড় কেটে, ডাইনামাইট দিয়ে ভেঙে টানেল নির্মাণ করে হিমালয়ের সহনশীলতাকে টলিয়ে দিচ্ছে, তার প্রভাব কত সুদূরপ্রসারী, তা নিয়ে ভাবিত নন নির্মাণযজ্ঞের হোতারা?
উন্নয়নের জোয়ারে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত বন্যপ্রাণ। তারা ত্রস্ত, সন্ত্রস্ত। দিবারাত্রির যান্ত্রিক কর্মযজ্ঞে, আলোর উজ্জ্বলতম ঝলকানিতে দিশেহারা পাখিরা। শহরের দিকেও ধাবিত হচ্ছে বনের পশুরা। অরণ্য ধ্বংসের কারণে হাতিরা নিজেদের অরণ্য-পরিক্রমায় তাদের নিজস্ব নির্মিত পথ বা করিডরে দিগ্ভ্রান্ত হয়ে দুর্ঘটনায় প্রাণ হারাচ্ছে। ডুয়ার্সে সারা বছর ধরে বহমান ক্ষীণকায়া নদীগুলো ভুটান পাহাড়ের ঝর্না বা বাঁধ উপচানো জলে, হড়পা বানে ভেসে গেলে সেই মাল নদীর ভয়াবহ বিপর্যয় বারংবার ঘটবে। জলদাপাড়া অভয়ারণ্য পর্যন্ত বানভাসি হওয়ায় গন্ডারের মতো বলবান প্রাণীকেও ভেসে যেতে দেখেছেন মানুষ। অথচ, এই গন্ডার দেখার জন্য কী যে আকুলতা মনে, তা কেবল পর্যটকরাই জানেন। তাঁরা পাহাড়-নদী-কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ-দার্জিলিঙের ম্যাল দেখার টানে দার্জিলিঙের আশপাশে-লাভা-লোলেগাঁও-রিশপ এমনকি গরুবাথানেও হোমস্টে-তে রাত কাটাতে পাগলপারা। আর পাহাড়ের জনগণ ব্যবসায় এতটাই লাভবান যে নিজেদের বসতভিটেকেই একটু সাজিয়েগুছিয়ে অতিথিদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন। পাহাড়ি মানুষজন সুদিনের মুখ দেখেছেন, তাতে খেদ থাকার কথা নয়। কিন্তু, একেবারেই রাশ টানবে না প্রশাসন?
সচরাচর যে নদীর রূপ দেখে জনগণ আপ্লুত, সেই তিস্তার নদীখাত ভূমিধস এবং হড়পা বানে পাহাড় থেকে বাহিত ধ্বংসাবশেষে উঁচু হয়ে যাচ্ছে। ক্রমাগত বর্ষণে শিলিগুড়ি থেকে কালিম্পং বা সিকিমগামী ১০ নম্বর জাতীয় সড়ক অহরহ বিপর্যয়ের ধাক্কা সামলাচ্ছে। ছবির মতো ঘনবসতি এলাকা তিস্তাবাজার ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাচ্ছে।
ঘটনাক্রমে আমিও শিলিগুড়ি শহরের ভূমিপুত্র, প্রায় সাড়ে তিন দশক অতিক্রান্ত হল কলকাতার অদূরে থিতু। কিন্তু মাঝেমাঝে যাওয়া হয় শিলিগুড়িতে। যত বার মহানন্দা পার হই, দেখি, মহানন্দা চুরি হতে হতে কতটা ক্ষীণকায়া হয়েছে! নদীর চড়ায় স্বমহিমায় খাটাল, হিন্দি স্কুল, মূলত পাশের রাজ্যের অধিবাসীদের রাজ্যপাট। বালাসন নদী তো বালি-চুরির সাম্রাজ্যে আপন-নামেই খ্যাত।
নীহাররঞ্জন রায় এসেছিলেন উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে। তৎকালীন কনভোকেশন হলের পাশ দিয়ে বয়ে যেত ক্ষুদ্রকায়া সোঁতা (এখনও তার অস্তিত্ব আছে কি?)। দূরে হিমালয়। পরিষ্কার দিনে দেখা যায় কার্শিয়াং শহরের আকাশবাণীর টাওয়ার। রাতে তিনধরিয়া, কার্শিয়াঙের আলোগুলো দীপাবলির মতো জ্বলজ্বল করে। স্বমহিমায় বিরাজ করে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। নীহাররঞ্জন রায় চতুর্দিকে অপলক চেয়ে বলেছিলেন, “এখানে এলে চোখের স্বাস্থ্য বাড়ে।” স্পষ্ট মনে আছে তাঁর আপ্লুত বাক্যটি আজও। আর এখন? অরণ্য ধ্বংস করা লাভজনক ব্যবসা। দার্জিলিং-কার্শিয়াং ইট-কাঠ-কংক্রিটে ছয়লাপ। ভয় হয়, প্রকৃতি প্রতিশোধ নিতে নিতে আরও নিষ্ঠুর হবে না তো?
ধ্রুবজ্যোতি বাগচী, কলকাতা-১২৫
লোভের শিকার
অনির্বাণ রায়ের ‘দীর্ঘ অবহেলা যখন বন্যা হয়’ (২৫-১০) শীর্ষক প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আমার এই চিঠি। আজ মানুষের লোভের শিকারে নাজেহাল উত্তরবঙ্গের নদীগুলো। অবৈজ্ঞানিক উপায়ে কাটা হয়েছে নদীর চর। সেখানে একের পর এক গজিয়ে উঠছে রিসর্ট, বিলাসবহুল হোটেল। অরণ্যে নির্বিচারে কেটে ফেলা হয়েছে গাছের পর গাছ। অর্থ উপার্জন এবং বিনোদনের নামে নদীর বুকে বেড়েছে অবৈধ কার্যকলাপ। নদীর বুক থেকে বালি, পাথর যথেচ্ছ ভাবে তোলা হয়েছে। দিনের আলোতে, রাতের অন্ধকারে বালি-পাথর বোঝাই বড় বড় ডাম্পারে সে সব পাচার করা হয়েছে।
সংস্কার না করে এবং নদীর গতিপথ দখল করে আর্থিক মুনাফা বাড়িয়ে যাওয়ার পরিণতি শুধুমাত্র প্রকৃতির ধ্বংসলীলার পরেই জানা যায়। উত্তরবঙ্গের এই সব সমস্যা এত দিন রেখেঢেকে রাখা হত। কিন্তু সাম্প্রতিক বন্যার হাত ধরে এই সব সমস্যা সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি
এত্তা জঞ্জাল
নবান্নের প্রবেশদ্বার শিবপুর কাজিপাড়া মোড়ের পঞ্চাশ মিটার দূরের দৃশ্য। ল্যাম্পপোস্টের নীচে ডাঁই করে রাখা আবর্জনা। ঠিক পাশেই একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলের প্রবেশদ্বার এবং লাগোয়া একটি আবাসনের বাইরের গেট। বার বার প্রতিবাদ করেও ফল হয়নি। প্রশাসন থেকে জনতা— সবাই নির্বিকার।
অথচ এ রাস্তায় নিয়মিত জঞ্জাল নেওয়ার লোক আসেন। কিন্তু তার চেয়ে সহজ, যে কোনও সময় বাড়ির সামনের রাস্তায় ময়লা ছুড়ে ফেলা। তার পর জল জমুক, ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গি হোক— সে নিয়ে ভাবে কে?
শিবপ্রসাদ রায় চৌধুরী, শিবপুর, হাওড়া
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)