প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘কোণঠাসা করার নীতি’ (৯-১) প্রবন্ধটি পড়ে কিছু সংযোজন করতে চাই। ইদানীং রাজনৈতিক দলগুলির মুখপাত্রদের যে কোনও বিষয়ে বিরোধী দলকে হেনস্থা করার প্রবণতা এত বেশি পরিলক্ষিত হচ্ছে যা এক-এক সময় সাধারণ মানুষের সহনশীলতার সীমা লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।
বর্তমান কেন্দ্রীয় শাসক দল দেশের দায়িত্বভার গ্রহণের পর থেকেই বিরোধীদের বিশেষ করে কংগ্রেস দলকে প্রতি দিন যে ভাষায় আক্রমণ করছে, তা নিন্দনীয়। সাধারণ মানুষ কিন্তু প্রতি দিনের এই ঘৃণার প্রদর্শন একেবারেই সমর্থন করছেন না। এঁদের বাংলা দখলের রাজনীতি কী ভাবে ব্যর্থ হল তা তো দেখাই গেল। গরিব মানুষের হাতে নগদ দেওয়ার বিষয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রবল অনিচ্ছাও সর্বজনবিদিত। তা হলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা আসবে কী করে আর জিডিপির বৃদ্ধিই বা কী করে সম্ভব? এই সাধারণ বুদ্ধি প্রয়োগ না করে শুধুমাত্র সদস্যসংখ্যা বৃদ্ধি আর ভোটবাক্স ভরানোর তাগিদ অনুভব করলে কি বাংলার মানুষের মন পাওয়া যাবে? এই বঙ্গে অন্তত নতুন শিল্প স্থাপন করে কর্মী নিয়োগের কোনও প্রচেষ্টা গত এক দশকে চোখে পড়েনি। শুধুমাত্র মৌখিক ভাষণ আর নিজেদের অহং প্রদর্শন করে দেশের মানুষকে প্রলুব্ধ করার প্রয়াস যে কত অন্তঃসারশূন্য তা জনসাধারণ বুঝে নিয়েছে। এ রাজ্যের শাসক দলটির অবস্থানও আশাব্যঞ্জক নয়। দলটির অন্দরের ঝামেলা প্রকট হচ্ছে। বাকি দু’টি বিরোধী দলের অবস্থান হতাশাজনক। যে কোনও ভোটের আগে জোটের গল্প শুরু হয় আর ভোট শেষে দেখা যায় দু’টি দলই গোহারান হেরেছে ও সেই হারের পর্যালোচনা করতে করতে আবার একটি ভোট এসে যায়। অগত্যা সাধারণ মানুষ নিজেদের প্রাণের দায়ে অথবা আর্থিক প্রলোভনের জন্যই ইচ্ছে না হলেও কেন্দ্র ও রাজ্যের শাসকদের মধ্যে যে কোনও একটি দলকে বেছে নিতে বাধ্য।
যে দেশের জিডিপির মাত্র দুই শতাংশের মতো বরাদ্দ হয় শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের জন্য, সে দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সংসদে গিয়ে মানুষের সুবিধা অসুবিধার কথা না বলে নিজেদের স্বার্থের খাতিরে অকথ্য ভাষায় বাদানুবাদে জড়িয়ে পড়বেন, এ আর আশ্চর্য কী! এঁদের অনেকেই তো ভোটে জিতলেও ক্ষমতা এবং অর্থের লোভের বশবর্তী হয়েই সেখানে গিয়েছেন। তাই শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্যের খাতে অর্থনৈতিক বৃদ্ধি নিয়ে মাথা ঘামাতেও তাঁরা নারাজ। তাঁদের কাছে ওগুলো ফালতু খরচ, যা না করলেও চলে।
সুব্রত সেনগুপ্ত, কলকাতা-১০৪
নৈরাজ্য চলছে
প্রেমাংশু চৌধুরীর লেখা ‘কোণঠাসা করার নীতি’ প্রবন্ধটি সময়োচিত এবং দূরদর্শী। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ ভারতীয় রাজনীতির ইতিহাসে মাইলফলক। তবুও তাঁর শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে উদ্ভূত অনভিপ্রেত পরিস্থিতির সাক্ষী দিল্লির রাজনীতি। শেষকৃত্য কোথায় হবে, সেখানে কি গড়ে উঠবে স্মৃতিসৌধ?— এ নিয়ে টানাপড়েন সরকার ও বিরোধীপক্ষের। ফলে এমন ব্যক্তির শেষকৃত্যেও একে অন্যের প্রতি শীতল মনোভাব দেখালেন ক্ষমতাসীন ও বিরোধী রাজনীতির বাদশারা। বাক্য বিনিময় হল না— জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে এ দৃশ্য বিরল। বেরিয়ে পড়ল দেশের শাসকের দাঁত নখ ও কঙ্কাল।
সংসদে নানা অধিবেশনে সরকার ও বিরোধী শিবিরের মধ্যে মতপার্থক্য অভিপ্রেত এবং সুস্বাস্থ্যের লক্ষণ। প্রশ্ন, দেশ গঠনের প্রতিনিধিত্ব করছেন যাঁরা তাঁদের মতান্তর থাকতে পারে কিন্তু মনান্তর হবে কেন? স্পিকার নীরব কেন? তাঁর ভূমিকা কী? অতীতের স্পিকার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের মন্তব্যটি স্মরণীয়— “আপনার আচরণ জনগণ দূরদর্শনে দেখছেন।” অতীত হাতড়ালে দেখা যাবে, বৈদেশিক কূটনীতি বা দেশের অভ্যন্তরীণ নানাবিধ সমস্যা সমাধানে শাসক শিবিরের শীর্ষ নেতারা বিরোধী দলনেতাদের সঙ্গে একমত হয়ে ফলপ্রসূ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন। জওহরলাল নেহরু, ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, মনমোহন সিংহ, অটলবিহারী বাজপেয়ীরা এই পথেরই পথিক। তা হলে অতীত থেকে শিক্ষায় অনীহা কেন? আজ লোকসভার বিরোধী দলনেতার বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জমা হচ্ছে! এও এক ঐতিহাসিক নৈরাজ্যের ছবি।
যাঁর অভিভাবকত্ব ও দূরদর্শিতায় ভারতের আমজনতার আস্থা, সেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সংসদে যাবতীয় বক্তৃতায় দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুকে দোষারোপ করে থাকেন। বিজেপি সরকার একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারিয়ে আজ শরিক-নির্ভর হয়ে পড়ায় কি ভীত-সন্ত্রস্ত? হয়তো তারই ফলে খরস্রোতে পড়া কেন্দ্রীয় সরকার বঙ্গের তৃণমূল সরকারের সঙ্গে আঁতাঁত রেখে চলেছে। তার উদাহরণ হয়ে থাকবে আর জি করের ঘটনা। সারা বিশ্ব যখন নিন্দায় তোলপাড় তখন অমিত শাহ বঙ্গে এলেও সন্তান হারানো দম্পতির আহ্বানে সাড়া দিলেন না! সময়ই বলে দেবে ভারতীয় রাজনীতির এই পথ কত সর্পিল ও ত্যাজ্য ছিল। সময়ই বড় শিক্ষক।
সূর্যকান্ত মণ্ডল, কলকাতা-৮৪
দুর্ভাগ্যের ঐতিহ্য
‘কোণঠাসা করার নীতি’ শীর্ষক প্রেমাংশু চৌধুরীর প্রবন্ধে ভারতীয় গণতন্ত্রে শাসক দল ও বিরোধীদের মধ্যে সৌজন্যবোধ এবং শিষ্টাচারের সম্পর্ক কতটা তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, তার ব্যাখ্যা রয়েছে। সরকার ও বিরোধীদের এই অসহযোগ-রাজনীতির বিরল সাক্ষী হয়ে থাকল প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর শেষকৃত্য। ঐতিহ্য ও চিরাচরিত রীতিকে উপেক্ষা করে খোদ মোদী সরকারের নির্দেশে এবং তত্ত্বাবধানে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের শেষকৃত্য সম্পন্ন হল লাল কেল্লার পিছনে নিগমবোধ ঘাট শ্মশানে। এই নিয়ে বিতর্ক হয়েছে এবং মনমোহন সিংহের পরিবার ও কংগ্রেস দল আপত্তি করলেও তাতে কর্ণপাত করেননি নরেন্দ্র মোদী ও তাঁর সরকার। কেবল বিতর্ক ও ক্ষতে প্রলেপ দেওয়ার জন্য দিল্লিতেই মনমোহনের স্মৃতিসৌধ গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করলেন মোদীর সরকার। মনমোহন সিংহকে শ্রদ্ধা জানিয়ে তিনি বললেন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর মৃত্যু দেশের অপূরণীয় ক্ষতিই নয়, দেশের বিকাশে তাঁর আত্মত্যাগ প্রেরণার যোগ্য— এটুকু বলেই তিনি ক্ষান্ত হন।
শোকমঞ্চে উপস্থিত শোকাতুর মনমোহন সিংহের পরিবার, বিজেপি-বিরোধী বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাংসদ, এমনকি সংসদের বিরোধী দলনেতা রাহুল গান্ধীর সঙ্গেও সৌজন্যবোধের শিষ্টাচারটুকু দেখালেন না তিনি। এ কি আত্ম-অহংবোধ? না কি সম্প্রতি সংসদ ভবনে বিরোধী সাংসদদের সঙ্গে অপ্রাসঙ্গিক হাতাহাতির ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাবের রেশ? তিনি কি ভুলেই গিয়েছেন, যে কোনও মৃত্যুই রাজনীতির ঊর্ধ্বে মানবিকতার প্রশ্ন? প্রয়াতের প্রতি শোকপ্রকাশ ও সন্তপ্তদের পাশে দাঁড়ানো এক চিরায়ত শিষ্টাচার, যে সৌজন্যবোধ রাজনীতিকে দূরে ঠেলে দিয়ে শত্রু, মিত্রকে এক করে দেয়?
এ যেন পাড়ার ছেলেদের মতো মাঠের ঝগড়াকে দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখার নমুনা দেখলাম, যা গণতন্ত্রের পক্ষে দুর্ভাগ্যজনক এবং বিরল।
মনে পড়ে, এ রাজ্যেই আমরা বাম-আমলে কিছু নেতার সৌজন্যবোধ এবং শিষ্টাচারের অভাব দেখেছি। আশির দশকে মহানায়ক উত্তমকুমারেরর মৃত্যুতে তাঁকে শেষ শ্রদ্ধা জানানোর জন্য রবীন্দ্রভবনে শায়িত করার অনুমতি দেননি তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু ও তাঁর দল। কারণ, উত্তমকুমার নাকি ‘কমিউনিস্ট’ ছিলেন না।
এমন আশ্চর্য রাজনৈতিক মনোবৃত্তিসম্পন্ন রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী ও বিরোধীদের প্রতি তাঁদের ‘অসম্মান প্রদর্শনের ট্র্যাডিশন’ যে এখনও দেশে রয়ে গিয়েছে, তার সাক্ষী হয়ে রইল কৃতবিদ্য প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রীর শেষকৃত্যে দেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দলের বিসদৃশ আচরণ। ইতিহাস এই অধ্যায় ভুলবে না।
তপনকুমার বিদ, বেগুনকোদর, পুরুলিয়া
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)