অশোক কুমার লাহিড়ীর প্রবন্ধ ‘এই জাগরণের ভোরে’ (১৬-৯) একটি সুচিন্তিত ভাবনার বহিঃপ্রকাশ। আর জি কর হাসপাতালে দুর্ভাগ্যজনক ভাবে এক তরুণী চিকিৎসক ধর্ষিতা হয়ে প্রাণ হারানোর কয়েক দিনের মধ্যেই ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’ ধ্বনিতে গোটা কলকাতা তো বটেই, রাজ্যের, দেশের এমনকি প্রবাসের বাঙালিরা যে ভাবে প্রতিবাদী হয়ে গর্জে উঠলেন, তা সত্যিই অভূতপূর্ব। প্রবন্ধের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল এই গণআন্দোলনকে পরিপূর্ণ রূপে অরাজনৈতিক রাখা যায় কি না, তার ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। প্রবন্ধকার যথার্থই বলেছেন যে, এই অরাজনৈতিক গণআন্দোলনে শাসকবিরোধী দলগুলোর সরাসরি অংশগ্রহণ যেমন আন্দোলনের তীব্রতা ও স্বতঃস্ফূর্ততা হ্রাস করবে, তেমনই আবার রাজনীতিকরণের ভয়ে হাত গুটিয়ে বসে থাকাটাও হবে চরম নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। বিশেষত, এই ঘটনার অন্তরালে যখন শাসক দলের নেতানেত্রীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ যোগাযোগের ইঙ্গিত ফুটে উঠছে সিবিআইয়ের তদন্তের ফলে। তাই প্রবন্ধকারের মতে বিরোধী দলগুলোর ভূমিকা হওয়া উচিত প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে না গিয়ে, এই গণআন্দোলনকে পরিপূর্ণ সমর্থন করা। কিন্তু বাস্তবে তা কী করে সম্ভব, সে ব্যাপারে তিনি আলোকপাত করেননি।
আমার মতে, কোনও রকম রাজনৈতিক ধ্বজা ছাড়া যে মিছিলে কেবলমাত্র জাতীয় পতাকা হাতে শাসক দলের দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের অবদমিত ক্রোধের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে, তার মধ্যে সরাসরি কোনও রাজনীতি না আনাই বাঞ্ছনীয়। কিন্তু বিপরীতে, সরকারি হাসপাতালের ঘরের মধ্যে এই নিন্দনীয় ধর্ষণ ও খুনের প্রেক্ষাপটে যদি শাসক দলের প্রভাবশালী কোনও ব্যক্তির প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ যোগসূত্রের ইঙ্গিত মেলে, তা হলে বিরোধীরাই বা রাজনীতিকরণের শঙ্কায় নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করে বসে থাকেন কী করে? তাই অরাজনৈতিক এই জনগর্জনে, সাধারণ মানুষের ‘জাস্টিস ফর আর জি কর’-এর ধ্বনিতে বিরোধীদেরও একই সুরে গলা মেলানো প্রয়োজন। অদূর ভবিষ্যতে জুনিয়র ডাক্তাররা তাঁদের কর্মবিরতি যদি সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করেও নেন, তা হলেও বিরোধীদের প্রচ্ছন্ন সমর্থনকে পাথেয় করেই, আমজনতার আন্দোলন চলতে থাকুক। আন্দোলনকারীদের মনে রাখা উচিত, এর শেষ না দেখা পর্যন্ত পিছোনো যাবে না।
শান্তনু ঘোষ, শিবপুর, হাওড়া
আমলাতন্ত্র
প্রেমাংশু চৌধুরীর ‘পদত্যাগ এবং সাপলুডো’ (১৯-৯) শীর্ষক প্রবন্ধটি পড়তে পড়তে কয়েকটি ছবি পর পর চোখে ভেসে উঠল। ২০১০ সালের ডিসেম্বরের শুরুতে পশ্চিম এশিয়া এবং উত্তর আফ্রিকায় দারিদ্র দুর্নীতি ও রাজনৈতিক দমনপীড়নের বিরুদ্ধে যে গণবিক্ষোভ শুরু হয়েছিল, তার জেরেই ২০১১-য় ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয় এই অঞ্চলের অন্যতম প্রভাবশালী নেতা মিশরের হোসনি মুবারককে। অন্য দিকে, ২০২০-২০২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের কৃষি সংক্রান্ত তিনটি আইনের বিরুদ্ধে পথে নামেন উত্তর ভারতের বহু কৃষক এবং তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রশক্তি কী ব্যবস্থা করেছে, তা-ও প্রত্যক্ষ করেছে গোটা দেশ। যদিও অবশেষে সেই জনশক্তির কাছে হার মেনে তিনটি কৃষি আইন ফেরত নিতে বাধ্য হয় রাষ্ট্রশক্তি।
আর এখন আমরা দেখছি আর জি করে এক পড়ুয়া চিকিৎসকের ধর্ষণ ও হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে বিশাল গণআন্দোলন, যার মূলে রয়েছে সরকার এবং সরকারি আমলা ও তাদের কার্যপদ্ধতির বিরুদ্ধে গণঅসন্তোষ। বামফ্রন্টের ৩৪ বছরে আমরা দেখেছি শাসক দল সরকারের সমস্ত সিদ্ধান্তকে নিয়ন্ত্রিত করত। কিন্তু এই মুহূর্তে এ রাজ্যে আমলাতন্ত্রের যে রূপরেখা দেখতে পাওয়া যায়, তাতে এমন ধারণা হওয়া অস্বাভাবিক নয় যে, আমলারাই সরকার ও সরকারি দলকে নিয়ন্ত্রণ করছে। রাজ্যে মুখ্যমন্ত্রীর ‘আমার হোম সেক্রেটারি, আমার পুলিশ কমিশনার...’ ইত্যাদি বক্তব্য সে অনুমান আরও জোরদার করে বইকি। এই বৃহৎ আমলাতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের জেরেই আর জি কর ঘটনার ক্ষেত্রে একাধিক আমলার পদত্যাগের দাবি জোরদার হয়ে উঠেছিল, যার খানিকটা শীর্ষ প্রশাসন মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে।
ক’দিন আগে বিবিসি-র ২০১২-র কিছু লেখা দেখতে গিয়ে একটা অদ্ভুত তথ্য পেলাম। হংকং-ভিত্তিক পলিটিক্যাল অ্যান্ড ইকনমিক রিস্ক কনসালটেন্সি-র এক রিপোর্টে এশিয়ায় আমলাতন্ত্রকে এক থেকে দশের স্কেলে ফেলা হয়। এ ক্ষেত্রে দশ ছিল সবচেয়ে খারাপ ফলাফল। সেই ভিত্তিতে ভারতের ক্ষেত্রে স্কেলটি ছিল ৯.২১, যা ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপিনস বা চিনের থেকেও খারাপ। কিন্তু আমলাতন্ত্র তো নিজের থেকে কাজ করতে পারে না যদি না তাদের পিছনে রাজনৈতিক মদত থাকে। আবার এও ঠিক এই আমলাতন্ত্র ছাড়া ভারতে কাজ করা মুশকিল।
কিন্তু আর জি কর আন্দোলনে যে ভাবে মানুষ সাড়া দিয়েছেন, তাতে বোঝা যাচ্ছে সরকার বা তার আমলাদের কাজকর্মে মানুষ কতখানি বীতশ্রদ্ধ। সকলেই জানে, এই ধরনের গণআন্দোলনের ফলে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক পালাবদল ঘটেছে। এই রাজ্যেও তা যাতে না ঘটে, তার জন্যই জনগণকে শান্ত করতে আপাতত কয়েক জন আমলাকে সরিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছে রাজ্য সরকার। তবে এই ধরনের গণআন্দোলনের দীর্ঘ সময় টিকে থাকার উপরেই নির্ভর করে তার সাফল্য। তাই এর প্রভাব শুধুমাত্র দু’-এক জনকে পদত্যাগ করিয়ে বা সরিয়ে দিয়ে থেমে যেতে পারে না। ভবিষ্যৎই বলবে এই গণআন্দোলনের প্রভাব এবং তার ঢেউ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে লাগে।
অভিজিৎ চক্রবর্তী,বালি, হাওড়া
ভাল খারাপ
গৌতম চক্রবর্তী তাঁর ‘ছবিতে যে ডাক্তারদের দেখেছি’ (২১-৯) প্রবন্ধে ছায়াছবির কাহিনিতে ডাক্তারবাবুদের কয়েকটি বিশেষ চরিত্রের দিকে ইঙ্গিত করেছেন। সপ্তপদী, কাঁচের স্বর্গ, ডাক্তার, জীবন নিয়ে খেলা, সন্ন্যাসী রাজা, অগ্নীশ্বর-এর মতো ছবিতে এক দিকে চিকিৎসকদের মানবিক মুখ এবং অন্য দিকে দুর্নীতির অমানবিক ভয়াল রূপ তুলে ধরা হয়েছে। আর জি কর আন্দোলনের সঙ্গে এই উপমাগুলোর একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। প্রসঙ্গত, আমার দেখা কয়েক জন চিকিৎসকের কিছু ব্যবহারের কথা বলতে চাই। গ্রামের এক ডাক্তার ছিলেন এলএমএফ পাশ। লোকে তাঁকে বলত ভগবানের ডাক্তার। দু’টাকা ফি। তা-ও রোগী দেখে টাকা ফিরিয়ে বলতেন, “নে রোগীকে সাবু দুধ কিনে খাওয়াস।” আর এক জন ডাক্তার হিসাবে ভালই ছিলেন। কিন্তু রোগী দেখার আগে বলতেন, “টাকা এনেছিস? তবে দেখব।” আর এক জনের কথা বলতে পারি, যিনি কলকাতায় এক সরকারি হাসপাতালের সঙ্গে যুক্ত। এক দিন রাতে চেম্বার থেকে তাঁর সঙ্গে রিকশায় চড়ে তাঁর বাসার উদ্দেশে চলেছি। হঠাৎ রিকশা থেকে নেমে অন্ধকার এক কানাগলিতে ঢুকে গেলেন। ফিরে আসার পরে তাঁকে জিজ্ঞেস করতে বললেন, “এক দরিদ্র মহিলা চিকিৎসার জন্য এসেছিলেন, তাঁকে দেখে এলাম, খোঁজ নিয়ে এলাম কেমন আছেন।”
এই ভাবে ভাল-মন্দের মিশেলে এগিয়ে চলেছে দেশ, এগিয়ে চলেছে মানুষের জীবন যন্ত্রণার চালচিত্র। এর এক দিকে যেমন আছে এক শ্রেণির অমানবিক, চরম দুর্নীতিগ্রস্ত ডাক্তার, তেমনই অন্য দিকে আছেন অন্যায়-বিরোধী সৎ ডাক্তাররাও, যাঁদের মধ্যে এক জনকে নৃশংস ভাবে খুন হতে হয়েছে সেই অশুভ শক্তির যোগসাজশে।
প্রবন্ধের শেষে লেখা হয়েছে মৃত্যুপথযাত্রী ডাক্তার অগ্নীশ্বরের শেষ আকুতি— চিফ মিনিস্টারকে বোলো, এই গরিব মানুষগুলিকে একটু দেখতে। সেই আকুতি আজও সমান প্রাসঙ্গিক, ঠিক যেমন প্রাসঙ্গিক কর্মক্ষেত্রে প্রত্যেক চিকিৎসকের নিরাপত্তার সুবন্দোবস্ত করা।
সারনাথ হাজরা,হাওড়া
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy