শাসকের ভুল হওয়া অস্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক ভাবে তার মোকাবিলা কাঙ্ক্ষিত। তা না করে শাসকের অনুপস্থিতিতে তাঁর প্রাসাদে ঢুকে পড়ে লুটতরাজ, নিরীহ সংখ্যালঘুদের ব্যবসাক্ষেত্রে, কি প্রার্থনাস্থলে অগ্নিসংযোগ, বিরোধী দলের কর্মীদের হত্যা করে ঝুলিয়ে দেওয়া, সভ্য মানুষের এমন আচরণ হতে পারে না। শাসকের উপর ক্ষোভ ফলাতে প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পিতা, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান— জাতির জন্মলাভে অবিসংবাদিত ভূমিকা ছিল বলে ‘জাতির পিতা’ হিসাবে মান্য করা হয় যাঁকে— তাঁর মূর্তির মাথায় পা রেখে পতাকা দোলানো হল। বঙ্গবন্ধুর মূর্তির গায়ে আঘাতের পর আঘাত করে তাকে ধূলিসাৎ করে ফেলা বামিয়ানের বুদ্ধমূর্তি ধ্বংসের কথা মনে করিয়ে দেয়। এ সব কোন চেতনার পরিচয় বহন করে?
আমাদের দেশেও জাতির পিতা এ দেশেরই এক মানুষের হাতে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। মহাত্মা গান্ধীর কাজ বা সিদ্ধান্তের যথার্থতা নিয়ে কারও ভিন্ন মত থাকতেই পারে। কিন্তু সর্বসমক্ষে জাতির পিতার এই জাতীয় অবমাননা ভাবনার বাইরে। এই উন্মাদনার নাম স্বাধীনতা?
অনেকে হয়তো যুক্তি দেবেন, বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতির ধারক-বাহক, মননশীল সুধীজনদের সঙ্গে এই দুষ্কৃতীদের যোগাযোগ নেই। বুঝলাম। তাঁরা হয়তো এই জনজোয়ারের সঙ্গে এঁটে উঠতে পারতেন না। কিন্তু এই বর্বরতার প্রতিবাদ করতে তো পারতেন। তা না করে তাঁরা কি উদ্ভূত পরিস্থিতির কাছে আত্মসমর্পণ করলেন না? আদর্শের জন্য রক্ত ঢালতে কার্পণ্য করার ঐতিহ্য ওঁদের ছিল না কোনও দিন। সেখান থেকে তাঁদের বিচ্যুতি আমাদের গভীরে কাঁপন ধরাচ্ছে। নতুন সরকার গঠন হলে এই জাতীয় দুষ্কর্ম বন্ধ হবে— এমনটাই আশা।
বিশ্বনাথ পাকড়াশি, শ্রীরামপুর, হুগলি
অপসংস্কৃতি
সম্প্রতি বাংলাদেশে সংরক্ষণকে কেন্দ্র করে ছাত্র আন্দোলনের ফলে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হল। এর জেরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিলেন। কিন্তু সেনাবাহিনীর হাতে বাংলাদেশের শাসনভার চলে যাওয়ার পরও যে ভাবে শেখ হাসিনার বাসভবন তছনছ করা হল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙা হল, সেই লজ্জা রাখার কোনও জায়গা আছে কি? বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রাণপুরুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙা কিসের ইঙ্গিত?
অনেকে বলছেন শেখ হাসিনার গণতন্ত্র লঙ্ঘন ও জবরদস্তিমূলক শাসনের জন্য আজ বাংলাদেশের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। আবার কেউ কেউ বলছেন, চিন ও পাকিস্তানের মদতের জন্য ভারতবন্ধু শেখ হাসিনাকে সরতে হল। ঘটনা যা-ই হোক, বিরোধীদের সম্মান করা, তাঁদের পরামর্শ মেনে দেশ চালানো, এটাই গণতন্ত্রের মূল আদর্শ। যারা সেটা মানবে না, তারা গণতন্ত্রকে অপমান করছে।
অভিজিৎ দত্ত, জিয়াগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ
ছাত্রের কাজ?
শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে দেশ ছাড়ার পরেই তাঁর বাসভবন ‘গণভবন’-এর দখল নিয়ে নেয় উন্মত্ত জনতা। চলল তাণ্ডব ও লুটতরাজ। প্রথম প্রথম ছাত্রদের ওই আন্দোলনকে আমার মতো অনেকেই হয়তো সমর্থন করেছিল। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে ঢুকে রাজহাঁস, ছাগল, বৈদ্যুতিন যন্ত্র, দামি শাড়ি, সুটকেস লুট করা হল। স্মার্ট টিভি, বালতির মধ্যে জামাকাপড় ভরে, মাথায় করে বিছানার তোশক, এমনকি মহিলাদের অন্তর্বাসও নিয়ে গেলেন অনেকে। সন্দেহ জাগে, সত্যিই কি এই আন্দোলন ছাত্রদের ছিল? স্বাধীনতা সংগ্রামী মুজিবুর রহমানের মূর্তি ভাঙচুর, সংসদ ভবনে হামলা, আন্দোলনের নামে জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করা— এ সব কি ছাত্রসুলভ আচরণ! আন্দোলনের নামে যারা এই কাজ করতে পারে, তারা কি ছাত্র, না সন্ত্রাসবাদী?
রতন চক্রবর্তী, উত্তর হাবড়া, উত্তর ২৪ পরগনা
নৈরাজ্য
১৫ অগস্ট, ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নৃশংস ভাবে হত্যা করে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখল করেছিল সে দেশের সেনাবাহিনী। ৫ অগস্ট, ২০২৪-এ বাংলাদেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মুজিব-কন্যা শেখ হাসিনা যদি বাংলাদেশ ত্যাগ না করতেন, তা হলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারত। ২০০৯ সাল থেকে টানা ১৫ বছরে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক এবং পরিকাঠামোগত অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার উপর বাংলাদেশের মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটল। তার কারণ, পর পর তিনটি সাধারণ নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছিল হাসিনা সরকার। প্রশাসনের সর্বোচ্চ স্তর থেকে আওয়ামী লীগের সাধারণ নেতা-কর্মীদের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতি, শেখ হাসিনার একনায়ক-সুলভ আচরণ তাঁকে ও তাঁর দলকে মানুষের থেকে ক্রমশ বিচ্ছিন্ন করছিল। সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারী ছাত্রদের উপরে নির্বিচারে গুলিচালনা ক্ষোভের আগুনে ঘি ঢালার কাজ করে। পরবর্তী কয়েক দিনে বাংলাদেশের রাজপথ মৌলবাদীদের ও ছিনতাইকারীদের দখলে চলে যায়। যে কোনও গণআন্দোলনে যদি সঠিক দিশা এবং বলিষ্ঠ নেতৃত্ব না থাকে, তবে তা নৈরাজ্যে পরিণত হয়। বাংলাদেশের পরিস্থিতি তার উদাহরণ।
শেষাদ্রি বন্দ্যোপাধ্যায়, ভদ্রেশ্বর, হুগলি
অশনিসঙ্কেত
‘হাসিনার পতন’ (৬-৮) শুধু বাংলাদেশের নয়, প্রতিবেশী ভারতের জন্যেও এক অশনিসঙ্কেত। পদত্যাগ করে হাসিনা কি দেশে থাকতে পারতেন না? কেন সেনাবাহিনী তাঁকে দেশে থাকার আশ্বাস দিল না? হাসিনা দেশ ছাড়ার পর গণভবন, সংসদ ভবনে লুট ও অগ্নিসংযোগ করা হল, সেনা ও পুলিশবাহিনী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর মূর্তি ভাঙা হল। আশঙ্কা হয়, মৌলবাদের আগুন না থাকলে এ ভাবে জাতির পিতার মূর্তি ভাঙা সম্ভবপর নয়। সে ভাবেই, ইন্দিরা গান্ধী কালচারাল সেন্টার পোড়ানোর মধ্যে ভারত-বিরোধিতার আভাস পাওয়া যায়।
মিহির কানুনগো, কলকাতা-৮১
আলোর ফুলকি
‘রাতভর মন্দির পাহারায় এলাকার মুসলিমেরা’ (৭-৮) আশাব্যঞ্জক সংবাদটি পড়লাম। বাংলাদেশে যে নৈরাজ্য চলেছে, তা ভয়াবহ। লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ, ভাঙচুর, আওয়ামী লীগের সমর্থকদের খুন করে লাশ ঝুলিয়ে দেওয়া, হোটেলে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে মারা, পুলিশহত্যা-সহ নানা অমানবিক কাজ চলেছে। তালিবানি ছায়া দেখা গিয়েছে সর্বত্র। এর আগে দেখা গিয়েছে, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতার সময় সে দেশের হিন্দুদের উপর নেমে আসে অভিশাপ। এ বারও তার ব্যতিক্রম হল না। তবে এ বার কিছু কিছু এলাকায় দেখা গেল, মুসলিম ভাইয়েরা হিন্দুদের বাড়িঘর, মন্দির রক্ষা করতে এগিয়ে এসেছেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের পক্ষ থেকে হিন্দুদের উপর আক্রমণ বন্ধের বার্তা এসেছে। তবে দোষীদের শাস্তি না হলে দুষ্কৃতীরা সাহস পায়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রাণ ও সম্পত্তি বাঁচাতে হিন্দুদের মুসলিম পরিচয় দিয়ে বসবাস করতে হয়েছিল। বাড়িতে হিন্দুদের সব চিহ্ন মুছে ফেলতে হয়েছিল। আমাদের বাড়িতেও সেই সময় এই ব্যবস্থা হয়েছিল। বাবা ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি পরতেন। ঘরের দেওয়ালে কাগজে আরবি হরফে কোরান, হাদিসের অংশবিশেষ লিখে সাঁটানো হয়েছিল। মা হাতে শাঁখা-পলা, কপালে সিঁদুর পরা বন্ধ রেখেছিলেন। বাড়িতে পুজো বন্ধ ছিল। তবে মুক্তিযুদ্ধের একটা সময় প্রাণ বাঁচাতে বাবা আমাদের নিয়ে বিক্রমপুরে পালিয়ে যাওয়ার সময়ে এক মুসলিম প্রৌঢ় দম্পতি আমাদের বাড়ি, ঘর, জমি, গোলাভর্তি ধান, খেতের ফসল, গোয়ালের গরু রক্ষার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। সে কথা আজও ভুলিনি। সে ছবি আজও দেখলাম— বাংলাদেশে হিন্দুদের জীবন-সম্পত্তি বাঁচাতে মুসলিমরা এগিয়ে এসেছেন। এই ধরনের সংবাদে সমাজে অন্ধকারের মাঝে আলোর ফুলকি দেখতে পাই।
অতীশচন্দ্র ভাওয়াল, কোন্নগর, হুগলি
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy