“সরকারি অবিমৃশ্যকারিতায় ভারতের পাহাড় এখন মৃত্যুফাঁদে পরিণত। ফেরার পথ আর সম্ভবত খোলা নেই।” ‘মৃত্যুফাঁদ’ (৯-৮) শীর্ষক সম্পাদকীয়তে উদ্ধৃত শেষ দু’টি বাক্যের মধ্যে প্রথম বাক্যটির সঙ্গে একশো শতাংশ সহমত হলেও দ্বিতীয় বাক্যটির ক্ষেত্রে কিছু ভিন্ন ভাবনা পোষণ করি। গত ৫ অগস্টে উত্তরকাশীর ধারালী জনপদটিকে ক্ষীরগঙ্গা নদীতে আসা হড়পা বান ভাসিয়ে দিয়েছে। সমাজমাধ্যমে সেই হাড়হিম করা ভিডিয়ো আমরা প্রত্যক্ষ করে শিউরে উঠেছি।
প্রায় চার দশক আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাকালীন গবেষণামূলক প্রকল্পের জন্য উত্তরকাশী জেলাটির নিবিড় ভূ-তাত্ত্বিক সমীক্ষক দলের সদস্য ছিলাম। পরেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের আকর্ষণে সেখানে একাধিক বার গিয়েছি ও দীর্ঘ দিন থেকেছি। গঙ্গোত্রী ও যমুনোত্রীর পর্যটকদের উত্তরকাশী হয়েই যেতে হয়। শীতকালীন তিন মাস বিরতি দিয়ে বছরের বাকি সময়ে এখানে পর্যটকদের ভিড় থাকে যথেষ্ট। কিন্তু অঞ্চলটির গঠন প্রক্রিয়া এখনও অসমাপ্ত বলে এমনিতেই ভূমিকম্পপ্রবণ। ১৯৯১ সালের ২০ অক্টোবর এখানে যে ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পটি হয়, তাতে কয়েক হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল। তার পরও বিভিন্ন সময়ে এখানে অল্পবিস্তর ভূমিকম্প হয়েছে। আর বিশ্ব-উষ্ণায়নের কারণে হিমবাহের গলনে এখানকার উচ্চ পার্বত্য এলাকায় তৈরি হয়েছে বেশ কিছু বড় হ্রদ। ছোটখাটো কম্পনে ওই হ্রদের জলরাশি তৈরি করছে ভয়ঙ্কর প্লাবন। তার ফলে হিমালয়ের এই অংশ আক্ষরিক ভাবেই মৃত্যুফাঁদে পরিণত হয়েছে। সমতল থেকে এখন অসংখ্য পর্যটক হিমালয়ে আসছেন। কিন্তু আগে তাঁরা হিমালয় দর্শনে আসতেন মূলত পায়ে হেঁটে; তীর্থযাত্রার মন আর শ্রদ্ধাশীল ভাব নিয়ে। কিন্তু গত কয়েক দশকে হিমালয় জুড়ে তৈরি হয়েছে অসংখ্য রাস্তা। তার জন্য যে শক্তিশালী ডিনামাইট বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে, তাতে শিলার সংযুক্তি দুর্বল হয়েছে। ছোট বড় নদীতে দেওয়া হয়েছে বাঁধ। তৈরি হয়েছে প্রচুর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প। অপরিকল্পিত ভাবে নির্মিত হয়েছে হোটেল। আগমন ঘটেছে ভারী ভারী পণ্যবোঝাই গাড়ির। সহনক্ষমতার চেয়ে বেশি চাপের ফলে হিমালয়ের স্বাভাবিক স্থিতিস্থাপকতা নষ্ট হচ্ছে। হিমালয়কে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে পরিবেশ-বিরোধী নির্মাণ বন্ধ করা দরকার। আবশ্যক পর্যটকদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রণও।
লোভ সংবরণ না করতে পারলে এমন ঘটনা বার বার ঘটতে থাকবে।
কৌশিক চিনা, মুন্সিরহাট, হাওড়া
বধ্যভূমি
জয়া মিত্রের ‘বিধ্বংসের দায় প্রকৃতির নয়’ (২০-৮) শীর্ষক প্রবন্ধটির সঙ্গে আমি সহমত। প্রসঙ্গত বলি, হাল আমলে দেশের অর্থনীতির চালিকাশক্তি হয়ে উঠছে নগরায়ণ। গ্রাম থেকে শহরে রূপান্তর এখন সমতল ছাপিয়ে পাহাড়কে গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে পাহাড়ে বাজার-অর্থনীতির শাখাপ্রশাখা হিসেবে হোটেল-হোমস্টে থেকে শুরু করে সড়ক-সেতুর নির্মাণযজ্ঞ চলছে। দুর্গম পাহাড়ি তীর্থক্ষেত্র সুগম করতে গিয়ে তৈরি হয়েছে চার লেনের ঝকঝকে রাস্তা পাহাড়ের বুক চিরে আর হাজার হাজার গাছ কেটে। পাহাড় ছেয়ে গিয়েছে ইট, কাঠ, সিমেন্ট, বালির চাদরে। এমন বিষাক্ত উন্নয়নযজ্ঞে ভয়াবহ ভাবে বিঘ্নিত হয়ে চলেছে পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্র। সড়ক নির্মাণের ধাক্কায় যেমন দুর্বল পর্বতে ভূমিধসের প্রবণতা বাড়ছে, তেমনই বাড়ছে পাহাড়ের ঢালে তৈরি হওয়া নির্মাণগুলির বিপদও। ভারী নির্মাণের স্থায়িত্ব নির্ভর করে সেই পাহাড়ে জমাট কাদামাটির শক্তি এবং তার ঘনত্বের উপরে। অতিবৃষ্টি কিংবা মেঘভাঙা বৃষ্টিতে পাহাড়ের পাথর মাটির স্তূপ আলগা হয়ে পাহাড়ের ঢাল বেয়ে ক্রমশ নীচে নামতে থাকে। শেষে সেই ঢালের শেষ প্রান্তে বয়ে চলা নদীতে সেই স্তূপ আছড়ে পড়লে উপচে পড়া জলের ধাক্কায় বিপর্যস্ত হতে পারে নদীখাত সংলগ্ন জনবসতিগুলি। অতিবৃষ্টি কিংবা হড়পা বানের সময় সেই নির্মাণ ক্ষেত্রই হয়ে ওঠে প্রকৃতির বধ্যভূমি। রবীন্দ্রনাথ অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিলেন নগরায়ণ এবং প্রকৃতির বিনাশ মানুষের জীবন আর পরিবেশের ভারসাম্যকে বিপদে ফেলবে। তার পরিপ্রেক্ষিতেই তিনি লিখেছিলেন “প্রকৃতিকে অতিক্রমণ কিছুদূর পর্যন্ত সয়, তার পরে আসে বিনাশের পালা।”
প্রদীপ কুমার সেনগুপ্ত, ব্যান্ডেল, হুগলি
বর্ষণক্লান্ত
‘বিপর্যয়ের মেঘ’ (২৭-৮) প্রসঙ্গে এই চিঠি। ভিক্টর হুগো লা মিজ়ারেবল-এ ঝোড়ো বৃষ্টিকে বর্ণনা করেন— যেন আকাশ নিজেই কাঁদছে, প্রকৃতি যেন মানুষের দুঃখকেও বহন করছে। হঠাৎ নেমে আসা মেঘ, বাজের গর্জন, অবিরাম বর্ষণ— এ যেন শুধু আকাশের কান্না নয়, মানুষের নিয়তিরও এক ভয়াবহ রূপ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পদ্মানদীর মাঝি-র কুবেরের সংলাপ, “হায় পদ্মা, তুই কত প্রাণ খেয়ে লইলি।” বাংলা সাহিত্যে বর্ষার সৌন্দর্যের পাশাপাশি ভয়াবহতা বোধ হয় সবচেয়ে বেশি প্রকাশিত হয়েছে বিভূতিভূষণের লেখায়। “অনেক রাত্রে সর্বজয়ার ঘুম ভাঙিয়া যায়— সর্বজয়া উঠিয়া আলো জ্বালে, বাহিরে ভয়ানক বৃষ্টির শব্দ হইতেছে। ফুটা ছাদ দিয়া সর্বত্র জল পড়িতেছে। দুর্গা অঘোর জ্বরে ঘুমাইয়া আছে... তাহার গায়ের কাঁথা ভিজিয়া সপসপ করিতেছে।... পুরো গা জলে ভিজিয়া ন্যাতা হইয়া যাইতেছে... সে কী করে? আর কত রাত আছে?” পথের পাঁচালী-তে বর্ণিত সর্বজয়ার অসহায়তা চোখ ভিজিয়ে দেয়।
সম্প্রতি, সংবাদপত্রে চোখে পড়ে মেঘভাঙা বর্ষণের খবর। এতে খুব অল্প সময়ের মধ্যে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় অস্বাভাবিক ও তীব্র বৃষ্টিপাত হয়। মেঘভাঙা বৃষ্টি সাধারণত পাহাড়ি এলাকায় বেশি ঘটে। তবে সমতল এলাকাতেও মৌসুমি বৃষ্টি, নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড়ের সময় পুরো শহর ভাসিয়ে দিয়ে যায়, যা অনেক সময় মেঘভাঙা বৃষ্টির মতোই প্রবল। প্রকৃতির এই হঠাৎ প্রলয় মনে করিয়ে দেয় আমাদের অনিশ্চয়তা এবং ন্যূনতম প্রস্তুতির গুরুত্ব। এক মুহূর্তে ভেসে যায় ঘরবাড়ি, পথঘাট, গাড়ি, মানুষ, ফসল। বর্ষার তেজ বাড়লে ঘর ডুবে যায়, উঠোন ভেসে যায়, রাস্তায় জমে কোমর জল। মাছ ভেসে ওঠে ডাঙায়। ভেঙে যায় পুকুর, বাঁধ, সাঁকো। এক-এক বেলায় ভেসে যায় আস্ত গ্রাম। কোলের শিশু, যৎসামান্য সম্বল নিয়ে উঠতে হয় ত্রাণশিবিরে। চোখের সামনে ডুবে যায় আস্ত সংসার। জল নামলে ঘোলাটে চোখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে এলাকার অর্থনীতি, সমাজনীতি, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি।
সুপ্রিয় দেবরায়, বরোদা, গুজরাত
আশাতীত
একই দিনে প্রকাশিত দু’টি প্রতিবেদন “টাকার অভাবে স্বাস্থ্যে ঘোর ‘অস্বাস্থ্য’” ও ‘পুজো অনুদান লাখে, মিড-ডে মিল ব্রাত্যই’ (২-৮) এবং সম্পাদকীয় ‘কে কত খুশি’ (৯-৮) প্রসঙ্গে কিছু কথা। সুপ্রিম কোর্টে আপাতত ডিএ মামলার শুনানি শেষে রায় সংরক্ষিত। কর্মচারীদের কেন্দ্রীয় হারে মহার্ঘ ভাতা দেওয়া সম্ভব নয়— জানিয়েছিল রাজ্য সরকার। কারণটা, অর্থনৈতিক। কিন্তু পুজোর অনুদান প্রদানে রাজ্য সরকার কার্পণ্য করছে না। পুজো কমিটিগুলিকে মুখ্যমন্ত্রী আশাতীত অনুদান দিচ্ছেন। কলকাতা এবং মফস্সলের বড় পুজোগুলি, যাদের বাজেট কোটির কাছাকাছি বা তারও অধিক, তারা কি অনুদানের উপর নির্ভর করে? অথচ, মিড-ডে মিলের বরাদ্দ বৃদ্ধি অতি নগণ্য, যাতে কোনও মতেই ছাত্রছাত্রীদের পাতে পুষ্টিকর খাবার দেওয়া সম্ভব নয়। সরকারি স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে, অর্থাভাবে ট্রমা কেয়ার সেন্টারের পরিকল্পনা থমকে, জীবনদায়ী ওষুধের জোগান কম, নানা রকম যন্ত্রপাতি সংস্কার না হওয়া, অ্যাম্বুল্যান্সের অপ্রতুলতা, শয্যাসংখ্যা বৃদ্ধি না হওয়া ইত্যাদি। দেখনদারি রাজনীতিতে অনুদানের বহর যে শুধুই ভোটকেন্দ্রিক, তা গুরুত্বপূর্ণ দফতরের পরিকাঠামো উন্নয়নের প্রতি চরম উদাসীনতাতেই প্রমাণিত।
স্বরাজ সাহা, কলকাতা-১৫০
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)