Advertisement
E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: ‘গেল গেল’ তো হবেই

ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগে যদি প্রশিক্ষণের কোনও গুরুত্বই না থাকে, তা হলে এত টাকা খরচ করে এত লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়ে যে প্রশিক্ষণ নিয়ে এল, তারা কী দোষ করল? কেন নিয়োগে তাদের অগ্রাধিকার ঘোষিত হল না?

শেষ আপডেট: ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০১

সীমান্ত গুহঠাকুরতার ‘এমন গেল গেল রব কেন’ (১৯-২) প্রবন্ধে ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগের পক্ষে যে সব যুক্তির অবতারণা করা হয়েছে, সে বিষয়ে কয়েকটি প্রশ্ন।

প্রথমত, উচ্চশিক্ষিত বেকার ও সরকারি শিক্ষকসমূহ, কেউই যে ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগকে উদারমনস্ক দৃষ্টিতে দেখছেন না এই সহজ সত্যটা পরিলক্ষিত হয়েছে সাম্প্রতিক বিরোধিতায় ও সোশ্যাল মিডিয়ার বিদ্রুপে। প্রাবন্ধিক বলেছেন, সিভিক পুলিশের অনুকরণে নাম দেওয়া হয়েছে সিভিক টিচার।

প্রশ্ন হল— ইন্টার্ন কারা? যাঁরা কোনও কোর্স করতে করতে সেই পরিষেবায় যুক্ত হন। যেমন, ডাক্তারিবিদ্যায় ইন্টার্নশিপ কথাটা চালু। আবার বি এড এবং ডি এল এড ট্রেনিংয়ের সময়ও ইন্টার্নশিপ চলে এক মাস বা দেড় মাস ধরে। তখন তাঁদের বিনা বেতনে স্কুলে গিয়ে ক্লাস নিতে হয়। কিন্তু এখানে মাসিক দুই হাজার টাকার বিনিময়ে শিক্ষাদান করতে হবে ইন্টার্নদের। যেমন পুলিশের বেতনের বেসিক পে-র থেকে কম বেতন পেয়ে এত দিন যাঁরা ভলান্টিয়ার হিসেবে কাজ করে এসেছেন তাঁরা ‘সিভিক পুলিশ’ নামেই বেশি পরিচিত, একই ভাবে সহকারী শিক্ষকদের বেতনের গ্রেড-এর চেয়ে কম বেতন পাওয়া হবু ইন্টার্নদের ‘সিভিক টিচার’ বলাটা কি একেবারেই যুক্তিহীন?

দ্বিতীয়ত, রাজ্যের সমস্ত প্রশিক্ষিত শিক্ষক-শিক্ষিকা প্রশিক্ষণের কিচ্ছুটি মনে রাখেননি— এই সিদ্ধান্তে প্রাবন্ধিক কী ভাবে উপনীত হলেন? বেশির ভাগ শিক্ষক লেসন প্ল্যান না করে পড়ালেও, এখনও কিছু ব্যতিক্রমী শিক্ষক নিশ্চয়ই আছেন, যাঁরা নিয়মিত লেসন প্ল্যান ও লেসন ডায়েরি নিয়ে ক্লাসে যান। আর ভূগোল শিক্ষক নিয়মিত ভাবেই তাঁদের ক্লাসে চার্ট, ম্যাপ ও গ্লোব-এর ব্যবহার করেই ক্লাস করিয়ে থাকেন, কারণ ম্যাপ পয়েন্টিং বিষয়টা মাধ্যমিকে থাকে।

এ ছাড়াও এখন প্রতিটি উচ্চ বিদ্যালয়ে কম্পিউটার ও প্রজেক্টর আসার ফলে আদ্যিকালের ‘লেকচার মেথড’কে বাদ দিয়ে ‘ডেমনস্ট্রেট’ পদ্ধতিতে পাঠদান চলে। বিভিন্ন স্কুলে স্মার্ট ক্লাসরুম চালু হওয়ার পর তা আরও বেশি দেখা যাচ্ছে। এ ছাড়া এখন প্রতিটি শ্রেণিতে প্রজেক্ট বা প্রকল্প করতে হয় যার জন্য নির্দিষ্ট নম্বর বরাদ্দ থাকে, তাই শিক্ষকদের প্রজেক্ট পদ্ধতি অবলম্বন করতেই হয়।

তৃতীয়ত, প্রাবন্ধিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণহীন শিক্ষকদের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য নেই বলে বিষয়টা নিয়ে যতটা সম্ভব কম বলতে চেয়েছেন, কিন্তু এনসিটিই ২০১৪ সালে যে নিয়ম করেছে, তাতে শিক্ষক নিয়োগে প্রশিক্ষণকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এ ছাড়াও ২০১৯ সালের ৩১ মার্চের মধ্যে ‘দেশের সমস্ত অপ্রশিক্ষিত শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ সম্পূর্ণ করতেই হবে’— এই মর্মে নির্দেশিকা জারি করেছে মানব সম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রক, যার প্রশিক্ষণ চলছে ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ওপেন স্কুলিং-এর মাধ্যমে।

ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগে যদি প্রশিক্ষণের কোনও গুরুত্বই না থাকে, তা হলে এত টাকা খরচ করে এত লক্ষ লক্ষ ছেলে মেয়ে যে প্রশিক্ষণ নিয়ে এল, তারা কী দোষ করল? কেন নিয়োগে তাদের অগ্রাধিকার ঘোষিত হল না?

চতুর্থত, প্রাবন্ধিক স্কুলব্যবস্থাকে শুধুমাত্র পরীক্ষা দেওয়ার একটি মাধ্যম বলে দাবি করেছেন এবং শিক্ষায় স্কুল-শিক্ষকদের থেকে প্রাইভেট মাস্টারদের অনস্বীকার্য ভূমিকার কথা উল্লেখ করেছেন। তা হলে অভিজ্ঞতার কি কোনও দাম নেই? যে স্কুল-শিক্ষকরা বছরের পর বছর হাজার হাজার ছেলেমেয়েকে তৈরি করছেন, তাঁদের থেকে গুটিকয়েক শিক্ষার্থীর প্রাইভেট মাস্টার অনেক উচ্চমার্গের? এই একপেশে ধারণা সরকারি শিক্ষকদের মর্যাদাহানিকর বলেই মনে করছি।

একটা প্রশ্ন মনে রাখতে হবে, সিভিক পুলিশ নিয়োগে যেমন বহু ক্ষেত্রে যোগ্যতা বিচার না করেই মূলত শাসক-অনুগতদের সুযোগ দেওয়া হয়েছে, তেমন এখানেও সিভিক শিক্ষক নিয়োগ হবে না তো? সদ্য স্নাতকরা, যারা কিনা কলেজে ছাত্র সংসদের পদাধিকারী ছিল ও অধ্যক্ষ ঘেরাও করে রাখতেই বেশি সিদ্ধহস্ত ছিল, তারাই ছাত্রদের দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে ক্লাস রুমে বসবে না তো? তা হলে কিন্তু ঘোর বিপদ। গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় বেনোজল ঢুকে গিয়ে সমাজটাকে ভাসিয়ে দেবে। তাই ‘গেল গেল রব’ উঠতে বাধ্য।

প্রণয় ঘোষ

কালনা, পূর্ব বর্ধমান

অসম্মান

লেখক ইন্টার্ন টিচার নিয়োগের সমর্থনে যুক্তি দিতে গিয়ে, রাজ্যের সরকার পোষিত স্কুলের শিক্ষকদের সরাসরি অসম্মান করেছেন। দাবি করেছেন, স্কুলমাস্টাররা কিছুই পড়ান না, সব নাকি প্রাইভেট টিউটররা পড়ান। প্রাইভেট টিউটররা অনেকেই বেশ ভাল শিক্ষক, এ কথা ঠিকই। কিন্তু খোঁজ নিলে দেখা যাবে তাঁদের অনেকের রোজগার বরিষ্ঠ পোস্ট গ্র্যাজুয়েট শিক্ষকদের বেতনের কাছাকাছি, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তারও বেশি। অর্থাৎ তাঁরাও বিনা পয়সায় সমাজসেবা করেন না।

প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রাইভেট টিউটরের প্রয়োজন হচ্ছে কেন? এর উত্তর হল, উচ্চশিক্ষা এবং চাকরির বাজারে দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হয়ে ওঠা প্রতিযোগিতা। অভিভাবক চান, সন্তানের আরও আরও ভাল রেজ়াল্ট। তাই শুধু সরকার পোষিত স্কুলের নয়, নামীদামি বেসরকারি সাহেবি স্কুলে পড়া ছাত্রছাত্রীদেরও সাতটা সাবজেক্টের জন্য দশ জন প্রাইভেট টিউটরের কাছে পড়তে যেতে বাধ্য করা হয়।

কেননা অধিকাংশ অভিভাবকই মনে করেন, শিক্ষার্থীকে সারা দিন ধরে শুধু পড়তে বাধ্য করলেই সে ভাল রেজ়াল্ট করবে।

এর পর আসা যাক বি এড প্রশিক্ষণের বিষয়ে। শিক্ষকতার ব্যাপারে যাঁদের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে তাঁরাই জানেন যে, সব সাবজেক্ট একই মেথডে পড়ানো যায় না। বি এড-এ টিচিং এডস ব্যবহারের যে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, সেটা একটা জেনারেল গাইডলাইন। সব ক্ষেত্রে সেটা হুবহু মেনে চলা আকাশকুসুম কল্পনা মাত্র। যেমন, বিজ্ঞান পড়ানোর সময় বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এডস ব্যবহারের সুযোগ আছে, কিন্তু বাংলা বা ইংরেজি গদ্য অথবা ইতিহাসের একটা সমালোচনামূলক অধ্যায় পড়ানোর সময় লেকচার মেথডের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই।

লেখক মন্তব্য করেছেন, শিক্ষাবিজ্ঞান অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। কিন্তু তার কোন কেতাবের কত নম্বর পাতায় দু’হাজার টাকা দিয়ে ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগের পরামর্শ দেওয়া আছে, তা জানতে খুবই উদগ্রীব রইলাম।

এ বারে আসি বেতনের কথায়। লেখক এ বিষয়ে উল্টো বুঝেছেন। ইন্টার্ন শিক্ষকরা কম মাইনে পাবেন বলে পড়াতে পারবেন না— বিরোধিতার যুক্তি এটা মোটেই নয়। বরং যুক্তি এটাই যে, এত কম মাইনে দিয়ে এঁদের কাজ করতে বাধ্য করা হবে কেন?

ইন্টার্ন ডাক্তাররা ইন্টার্নশিপ শেষ হলে চাকরি নিতে পারেন বা প্রাইভেট প্র্যাক্টিসে বসতে পারেন। কিন্তু ইন্টার্ন শিক্ষকদের তো আর পরে পাকা চাকরি দেওয়া হবে না। তাঁদের রাস্তা দেখিয়ে দিয়ে আবার পরের ব্যাচকে নিয়োগ করা হবে।

আর যে হেতু বি এ, বি এসসি, বি কম পাশ যুবক-যুবতী প্রতি বছর হাজার হাজার বেরোবেন, তাই নতুন নতুন ব্যাচ ইন্টার্ন শিক্ষক নিয়োগ চলতেই থাকবে এবং এই ভাবে পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এবং স্থায়ী শিক্ষকপদ স্কুল থেকে অবলুপ্ত হয়ে যেতে পারে।

যে শিক্ষাবিদের মন্তব্য লেখক আত্মপক্ষ সমর্থনে উল্লেখ করেছেন, তাঁর অভিযোগও নতুন কিছু নয়। পুরোটাই শিক্ষকদের সম্পর্কে পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তিদের তাচ্ছিল্যের মনোভাব থেকে সৃষ্ট পুরনো

সামাজিক ব্যাধি।

এ দেশের স্বঘোষিত পণ্ডিতরা মনে করেন, নেহাত দয়া করে তাঁরা স্কুলে ঢুকলেন না, তাই মাস্টারগুলো ফোকটে এত টাকা কামাচ্ছে। তিনি এক বার চান্স পেলে দেখিয়ে দিতেন, পড়ানো কাকে বলে। অবশ্য তাঁরা নিজেরা কোথায়, কী দায়িত্বে, কত বেতনে আছেন, সেখানে সমাজকে বেতনের বিনিময়ে নিজে কতটুকু দিচ্ছেন জানতে পারলে ভাল হত। পার্থ ভট্টাচার্য

ভাটপাড়া, উত্তর ২৪ পরগনা

চিঠিপত্র পাঠানোর ঠিকানা

সম্পাদক সমীপেষু,

৬ প্রফুল্ল সরকার স্ট্রিট,

কলকাতা-৭০০০০১।

ইমেল: letters@abp.in

যোগাযোগের নম্বর থাকলে ভাল হয়। চিঠির শেষে পুরো ডাক-ঠিকানা উল্লেখ করুন, ইমেল-এ পাঠানো হলেও।

Intern Teacher Recruitment
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy