শুভব্রত নন্দীর ‘দেখা না-দেখায় মেশা’ (১-৬) শীর্ষক প্রবন্ধ প্রসঙ্গে কিছু কথা। বিমূর্ত শিল্পের চলনশীলতা কিন্তু ভারী সন্দেহজনক। সাধারণ মানুষের মনের কোণে এমন আশঙ্কা জাগে যে, তা হলে কি কতিপয় তথাকথিত বোদ্ধা যা বলবেন, সমস্ত জনসাধারণকে তাই মেনে নিতে হবে বিনম্র শ্রদ্ধায়? নিজের বোধবুদ্ধি দিয়ে মেপে প্রশ্ন তুললেই আক্রমণ আসবে, ‘তুমি শিল্পের কী বোঝো হে’! এ বিষয়ে প্রশ্ন, সবাই যখন বোঝে না, তাকে দিয়ে সর্বসাধারণের যখন কোনও উপকার হয় না, তা হলে তাকে সর্বজনীন ও সার্বজনিক করার কী প্রয়োজন? সে থাক না তার গজদন্তমিনারে!
ভিনসেন্ট ভ্যান গখের জীবদ্দশায় (১৮৫৩-১৮৯০) তাঁর হাতেগোনা চিত্রকর্ম বিক্রি হয়েছিল। জানা যায়, সেও যৎসামান্য অর্থের বিনিময়ে। সেই ভ্যান গখেরই চিত্রকর্ম (ছবিতে তার অংশবিশেষ) একশো বছর পরে ক্রিস্টি’জ়-এ বিক্রি হয় ৮২.৫ মিলিয়ন ডলারে, সেই সময়ে বিশ্বের সবচেয়ে ব্যয়বহুল চিত্রকর্ম। আজও ভ্যান গখের এক-একটি চিত্রকর্মের আকাশছোঁয়া দাম। তা হলে কি এমন ধরে নেওয়া ঠিক হবে যে তাঁর সময়ের মানুষেরা কেউ শিল্প বুঝতেন না, কিন্তু এখনকার লোক শিল্পবোদ্ধা? না কি পুরোটাই প্রচারের ফল? ১৯৩৪-এ আরভিং স্টোনের লেখা ভ্যান গখের জীবনী লাস্ট ফর লাইফ উপন্যাস প্রকাশের ফল? না কি ভ্যান গখ, অথবা অন্য ইমপ্রেশনিস্ট বা পোস্ট-ইমপ্রেশনিস্ট শিল্পীর গ্রহণযোগ্যতা ভিক্টোরিয়ান যুগের শেষের দিকের পরিপ্রেক্ষিতে ধরতে হবে; সেই যখন ফ্রয়েড স্বপ্নের কারিকুরি নিয়ে ভাবছেন, কিন্তু বই লিখে উঠতে পারেননি। আমাদের শিল্পকর্ম দেখার চোখ কি তা হলে ফ্রয়েডের অবদান? বিজ্ঞানের মতো শিল্পেও কি তা হলে ‘চূড়ান্ত বা শাশ্বত সত্য’ বলে কিছু নেই— এটাই সত্য?
শেষ নাহি যে, কিন্তু শেষ কথা কে বলবে?
তপন পাল, কলকাতা-১৪০
রবির চিত্রজাগরণ
শুভব্রত নন্দী ‘দেখা না-দেখায় মেশা’ শীর্ষক প্রবন্ধে অসাধারণ এক বিষয়ের অবতারণা করেছেন। সত্যিই তো, আজকের জটিল সময়ের প্রেক্ষিতে ‘আর্ট থেরাপি’র ক্ষেত্রে বিমূর্ত শিল্পের প্রয়োগ ঘটানো জরুরি। মনস্তাত্ত্বিক গবেষণায় দেখা গিয়েছে, অচেনা আকার বা রঙের ব্যবহার অর্থাৎ বিমূর্ত দৃশ্যপট মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতিবিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিতে পারে। অবশ্য তা গবেষণা ও আলোচনা সাপেক্ষ। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, মূর্ত বা বিমূর্ত সব শিল্পের সঙ্গেই মানুষের মনের এক সম্পর্ক স্বাভাবিক ভাবেই গড়ে ওঠে। মনের মধ্যে ঘটে চলে অবিরল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার ঢেউ। হতে পারে চিত্তের জাগরণ।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও শেষ জীবনে এসে ছবির মধ্যে তাঁর সাহিত্যের অতৃপ্ত আর্তির ভূমা খুঁজেছিলেন। রেখা, আকার-বোধ ও রঙের চলমানতার ক্ষেত্রে তিনি তুলনারহিত দৃষ্টান্ত রেখে গেছেন। রক্তকরবী-র পাতায়, পূরবী-র পাণ্ডুলিপির কাটাকুটিতে তিনি গড়ে তুলেছিলেন নতুন রকমের এক আকার। রবীন্দ্রনাথ এক চিঠিতে জানান, “আজকাল রেখায় আমাকে পেয়ে বসেছে— তার হাত ছাড়তে পারছিনে। কেবলই তার পরিচয় পাচ্চি নতুন নতুন ভঙ্গির মধ্যে দিয়ে।” এক সময় রেখার মায়াজালে তাঁর সমস্ত মন জড়িয়ে পড়ে। আকাশবাতাস থেকে ভেসে আসা সুর ও কথার পরিবর্তে রেখা ও আকারের জয়োল্লাসে তিনি মেতে উঠতে চান। আর এই আকারের মহাযাত্রার ফসল তাঁর কালিকলমে তৈরি অত্যাশ্চর্য সব চিত্রাবলি। এ তাঁর বিমূর্ত যাত্রা, অবচেতন মনের সৃষ্টি।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর পড়ন্ত প্রৌঢ়ত্বে রঙের রেখায় ও বর্ণের নানা আকারের অপর্যাপ্ত এই সৃষ্টিতে মেতে উঠেছিলেন। যেখানে দুঃসাহসী বর্ণপ্রয়োগও চোখে পড়ে। এক সময় নির্বস্তুক রূপের প্রতি তিনি প্রবল আত্মতা অনুভব করেন। তিনি আকারে ও বর্ণের জগতে বিপ্লব ঘটান। স্বাধীন বর্ণপ্রয়োগ করেন।
ছবির জগতে পুরোপুরি আসার আগে রবীন্দ্রনাথ বিশ্বের নানা দেশে ভ্রমণ করেছেন। প্যারিসে নানা গোত্রের আধুনিকদের ছবির প্রদর্শনী দেখেছেন। শোনা যায় পরের বছর কলকাতায় পাশ্চাত্যশিল্পীদের অভিনব ছবির যে প্রদর্শনী হয়েছিল, তার উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন রবীন্দ্রনাথ। ক্রমশ ছবির আধুনিকতা বিষয়ে তাঁর ধারণা প্রকট হয়। নিজের কল্পনার অসামান্য ছন্দোময় শক্তিতে রেখা ও রঙের ব্যবহার আশ্চর্য রকমে তিনি আয়ত্ত করেন। ফলে তাঁর ছবি রেখা, রঙে ও ভাবে হয়ে ওঠে বিস্ময়কর। বর্ণময় তার অভিব্যক্তি, সেই সঙ্গে ছিল অসম্ভব চিন্তা-উদ্বোধক।
আশ্চর্যজনক ভাবে রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাষা তাঁর জীবদ্দশায় বুঝতে পারেননি স্বদেশবাসী। রবীন্দ্রনাথ নিজে মনে করতেন, এ দেশের দর্শক বা চিত্র-সমালোচকদের মধ্যে রয়েছে ‘চিত্র দর্শনের... অভিজ্ঞতা’র অভাব। রবীন্দ্র-চিত্রকলার অদ্ভুত অন্তর্মুখী সেই আবেগ আজও শুধু মনোবিজ্ঞানী কেন, সাধারণ মানুষের কাছেও গভীর চর্চার বিষয়। শিল্পগুরু অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতে, রবীন্দ্র-চিত্রকলার স্বকীয়, স্বতন্ত্র ধারা ছবির জগতে ‘যেন অগ্নিগিরির অগ্ন্যুৎসার’।
রেখার ঋজু নির্ভীক প্রয়োগ ও আকারের স্পষ্ট সুশৃঙ্খল বিন্যাসে রবীন্দ্রনাথের ছবি ছিল প্রাণবন্ত ও বিশেষ আধুনিক। রেখার খেলায় রবীন্দ্রনাথ নিজে পেতেন অপরিমিত মুক্তির স্পর্শ। শিল্পাচার্য নন্দলাল বসুর মতে, রবীন্দ্রনাথ যা কিছু এঁকেছেন তার ছন্দে এই প্রাণস্পন্দন এই প্রাণশক্তি এমনই প্রবল এবং প্রচুর যে, এ যুগের খ্যাতিমান শ্রেষ্ঠ শিল্পীদের রূপাকৃতিও তার পাশে কতকটা নিষ্প্রভ ও নিষ্প্রাণ মনে হয়। প্রাণের প্রথম জাগরণ, প্রাণশক্তির অব্যর্থ স্ফুরণ— এ ছবির আসল বিষয়বস্তু। তিনি বলেছিলেন, এটি রবীন্দ্র-চিত্রকলার নিজস্ব বস্তু এবং ভারতীয় রূপকলার ঐতিহ্যেও এটি গুরুদেবের বিশেষ দান। অথচ বিদেশে রবীন্দ্রনাথের ছবি বিস্তর প্রশংসা পেলেও স্বদেশ তাঁর চিত্রাবলিকে তাঁর ঈপ্সিত অভ্যর্থনা দেয়নি। এ আমাদের দীনতা ছাড়া আর কী!
সুদেব মাল, তিসা, হুগলি
শাস্তিও দেখান
এই রাজ্যে বেশির ভাগ সিঙ্গল স্ক্রিন সিনেমাহল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ও মাল্টিপ্লেক্স-এ টিকিটের দাম চড়া হওয়ায় সমাজের কিছু বিশেষ ক্ষেত্রের মানুষ এখন টিভি সিরিয়াল-নির্ভর হয়ে পড়েছেন। কয়েকটি সিরিয়ালে যে সব হত্যা, ষড়যন্ত্র দেখানো হয় সেগুলো যে সমাজে ঘটে না, তা নয়। কিন্তু চরিত্রদের চরম শাস্তি না দেখিয়ে অপরাধগুলোকে অত্যন্ত লঘু করেই দেখানো হয়। ফলে অপরাধপ্রবণ মানুষ অবশ্যই এর দ্বারা প্রভাবিত হতে পারে এবং মনে করতে পারে যে এই সব অপরাধ করলেও পার পেয়ে যাওয়া যাবে।
কিছু দিন আগে একটি সিরিয়ালে দেখলাম, এক জন মহিলা আইনজীবী নারীর সম্মানহানি হলে রুখে দাঁড়াচ্ছেন এবং নিজের জীবন বাজি রেখে তাঁদের রক্ষার চেষ্টা করছেন। দুর্বৃত্তদেরকে শায়েস্তা করতে তাদের মারছেনও। অথচ অদ্ভুত ভাবে তাঁর নিজের দিদি বহু ষড়যন্ত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও তাঁর প্রতি নির্বিকার থাকছিলেন। যেন নিজের পরিবারের কেউ অপরাধ করলে সেটা ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। এর আগেও ওই পরিবারে কোনও অপরাধ হলেও তা বাইরে না এনে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য বাড়ির কর্তা অন্য এক নামকরা পুরুষ আইনজীবীকে উদ্যোগ করতে দেখা গিয়েছিল।
এ ভাবে ঘৃণ্য অপরাধগুলোকে লঘু করে দেখালে বর্তমানে যে ধরনের সামাজিক পরিস্থিতি, তাতে অপরাধপ্রবণতা বাড়বে বই কমবে না। সিরিয়ালের টিআরপি বাড়াতে গিয়ে সমাজবিরোধিতাকে প্রশ্রয় দেওয়া একেবারেই কাম্য নয়। যদি বারে বারে অপরাধীর চরম শাস্তি দেখানো হয় তা হলে সমাজে অপরাধ বন্ধ হয়ে যাবে তা হয়তো নয়, তবে তা প্রশ্রয় পাবে না। কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক এই বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশিকা জারি করলে নির্মাতারা বিষয়টিতে সতর্ক হবেন বলে মনে করি।
দেবজ্যোতি চৌধুরী, কলকাতা-৫৯
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)