E-Paper

সম্পাদক সমীপেষু: আজও নয়নমণি

যাঁদের কীর্তি আলোচিত, তাঁরা ছাড়াও বহু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বই ছিলেন আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে, যাঁদের সকলের নাম ও কীর্তির উল্লেখ এই সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়।

শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২৫ ০৬:৫৫

প্রগতিবাদী লেখক-শিল্পী সঙ্ঘের জন্ম থেকে ‘ইন্ডিয়ান পিপল’স থিয়েটার‌ অ্যাসোসিয়েশন’ (আইপিটিএ) অবধি বামপন্থী সাংস্কৃতিক আন্দোলনের যে পথ পরিক্রমার বৰ্ণনা মল্লারিকা সিংহ রায় তাঁর ‘ঠিকানা লেখা ঝড়ের কাছে’ (১২-৭) শীর্ষক প্ৰবন্ধে সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ করেছেন,সেই সব আন্দোলনের প্ৰয়োজনীয়তা স্বাধীন ভারতে ফুরোয়নি, বরং আজ দেশ জুড়ে যখন অনাচারের বিবিধ ঘটনা ঘটেই চলেছে এবং শান্ত, নিরীহ লোকজন প্রায় প্ৰতি দিনই যখন অন্যায়ের শিকার হচ্ছেন, তখন মনে হয় এই ধরনের আন্দোলন যেন আরও বেশি করেই দরকার ছিল বর্তমানের এই পঙ্কিল সমাজের প্রেক্ষাপটেও।

যাঁদের কীর্তি আলোচিত, তাঁরা ছাড়াও বহু উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্বই ছিলেন আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে, যাঁদের সকলের নাম ও কীর্তির উল্লেখ এই সীমিত পরিসরে সম্ভব নয়। সেই নামগুলির মধ্যে প্রথমেই যাঁর কথা মনে আসে, তিনি হলেন জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র, মানে, বটুকদা। ভারতীয় গণনাট্যের সঙ্ঘসঙ্গীত ‘এসো মুক্ত করো, মুক্ত করো, অন্ধকারের এই দ্বার’ তো তাঁরই রচনা এবং সুরারোপিত। এ ছাড়াও, আর একটি বিখ্যাত কবিতা, যা তৎকালীন সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের জীবন-সংগ্রামের মর্মস্পর্শী ছবি এঁকেছিল এবং শম্ভু মিত্রের অপূর্ব বাচনভঙ্গির কল্যাণে যে পঙ্‌ক্তিগুলো লোকের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত, সেই ‘মধুবংশীর গলি’ও ছিল তাঁরই রচনা। আবার গামছা বেঁধে গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে মানুষের জীবন-সংগ্রামের আর এক সহযাত্রী দেবব্রত বিশ্বাস, মানে, জর্জদা গাইতেন এই বটুকদারই লেখা ‘নবজীবনের গান’-এর পঙ্‌ক্তিগুলিই।

এই প্ৰসঙ্গে আর এক জনের কথা না বললেই নয়। তিনি হলেন বাঙালির অন্যতম প্রিয় সঙ্গীতশিল্পী, সুচিত্রা মিত্র। রবীন্দ্রনাথের ময়নাপাড়ার কৃষ্ণকলি, যে মেয়ে দেশভাগের বলি হয়ে সলিল চৌধুরীর কলমে ও সুরে ‘সেই মেয়ে’-তে পর্যবসিত হল, তাকেই কণ্ঠদান করলেন সুচিত্রা মিত্র, এই গান সেই সময়ে রবীন্দ্রভক্তদের মনে তীব্র ক্ষোভের জন্ম দিয়েছিল। পরবর্তী কালে অবশ্য সুচিত্রা মিত্র এই আক্রমণের জবাবও দিয়েছিলেন। লিখেছিলেন, আমি সে দিনও বলেছি, আজও বলছি, ‘সেই মেয়ে’ কৃষ্ণকলি প্যারোডি নয়।… রবীন্দ্রনাথ বেঁচে থাকলে সলিলের সঙ্গীতপ্রতিভাকে সম্মান জানাতেন, স্বীকৃতি দিতেন, এতে আমার সন্দেহ নেই।

গৌতম নারায়ণ দেব, কলকাতা-৭৪

ভ্রান্তি ও শক্তি

মল্লারিকা সিংহ রায়ের লেখা ‘ঠিকানা লেখা ঝড়ের কাছে’ আপাতত আশ্বস্ত করল, ‘ভয় নাই, ওরে ভয় নাই’। তবে এই আন্তর্জাতিক রণাঙ্গনে জাতীয় ইতিহাসকে যথোচিত গুরুত্ব দিতে হবে।

মানবসভ্যতার শৃঙ্খলে প্রতিটি শুরুরও শুরু থাকে। শিল্প বিপ্লবের প্রথম দুই পর্বের ভালমন্দ প্রভাব যা হয়তো এশিয়ায় বেশি দৃশ্যমান হয়েছে ভারতে। ফ্যাসিবাদে প্রথমেই আসে শিল্পপুঁজি থেকে লগ্নিপুঁজির আগ্রাসনের কথা। ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক লুণ্ঠনে দেশীয় অর্থনীতির বিপুল ক্ষতি হয়। দেশজননীর মুক্তি চাইলেন পঞ্চকবি— রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, নজরুল ইসলাম, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, অতুলপ্রসাদ সেন। ইউরোপীয় ও ব্রিটিশ অর্থনৈতিক শোষণ এবং সাংস্কৃতিক সভ্যকরণের মিশনের আগ্রাসনে সমূহ ক্ষয়ক্ষতির অপর পিঠে দ্বান্দ্বিক ভাবে কিছু লাভও হয়েছে। ইউরোপীয় নবজাগরণের তিন পর্বের অনেক কিছু ইতিমধ্যে আত্মস্থ করেছেন কিছু উচ্চশিক্ষিত সংস্কৃতিমান ভারতীয় ও বিশেষ করে বাঙালি। দেশের শত্রু বিদেশিদের অস্ত্র ও আক্রমণ বুঝতে শিখেছেন দেশবাসী।

পরে এর সাংস্কৃতিক প্রভাব দেখা গেল বাংলায় কবিতার জগতে ‘মডার্নিজ়ম’ আঙ্গিকে। যে-হেতু সমাজ যখন আহত হয় তখন কবির চোখে ঝরে জল এবং কবিতা হল ভাষা ও ভাব প্রকাশের সর্বোত্তম আঙ্গিক, তাই কবিতার অভিঘাত গভীর, গম্ভীর, দীর্ঘস্থায়ী। ‘আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক গণতন্ত্রী সঙ্ঘ’ বা ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব রাইটার্স ফর দ্য ডিফেন্স অব কালচার’-এর সম্মেলন চরিত্রে ছিল ফ্যাসিবাদ-বিরোধী ও নাৎসিবাদ-বিরোধী এবং বামপন্থী।

রাষ্ট্র নামক জাতীয় দেশীয় নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার মধ্যে স্বাধীনতার দাবি সঙ্ঘবদ্ধ হতে থাকে। রাজনীতির দক্ষিণ, বামপন্থার থেকে গুরুত্বপূর্ণ ছিল মধ্যপন্থী জাতীয় কংগ্রেস। বাংলা, অসম, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, মালাবার, মহারাষ্ট্র, পঞ্জাব ইত্যাদি জায়গায় সাংস্কৃতিক আন্দোলন বিকল্প রাজনৈতিক চেতনার দাবি করে।

প্রগতিশীল প্রতিটি সংগঠন তৈরি হয় পরে ভাঙবার জন্য। প্রবন্ধে আছে কমিউনিস্ট পার্টির ভাঙনের কথা। গণনাট্য সঙ্ঘের প্রথম ঘোষণাপত্রেই আছে অতীতের প্রগতিশীল ধারাকে অগ্রসর করা। কিন্তু সংস্কৃতির ভাষায় সাধারণের কাছে রাজনৈতিক ভাষ্য সহজবোধ্য হয়নি। পরের দিকে কমিউনিস্ট পার্টির ভিত গুণগত ভাবে শক্ত হয়নি। সংখ্যাগত ভাবে বাড়লেও দ্রুত জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। চল্লিশ থেকে ষাটের দশকে কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্র আন্দোলনের পরিচালনায় পার্টির সাংগঠনিক নেতৃত্ব স্পষ্ট ছিল না। তত্ত্বগত অনুসন্ধান, বিতর্ক এবং দিগ্‌নির্দেশনায় বিশেষজ্ঞ, নেতৃত্বের মতামতের উপর নির্ভরশীল ছিল সঙ্ঘ। জরুরি অবস্থার পর তো আইপিটিএ দুর্বল হয়ে গেল।

আরও কিছু মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল। যেমন ভারতের দেশীয় শিল্প-সংস্কৃতির জায়গায় আন্তর্জাতিক শিল্প-সংস্কৃতিকে অগ্রাধিকার দেওয়া। ভারতের শিল্পকলায় অনেক লৌকিক আবেদন আছে যেখানে ঐতিহাসিক কারণেই আধ্যাত্মিক ভাব, ভগবান, বিধি ইত্যাদি কিছু তথাকথিত অলৌকিক শব্দ সম্পৃক্ত হয়ে গেছে। এই ভারতীয় আদর্শকে উপেক্ষা করে সাধারণ ভারতীয়দের এক বিরাট অংশকে হারিয়েছে বামপন্থী সাংস্কৃতিক গণ-আন্দোলন।

গণনাট্য সঙ্ঘ কে তুলে দিল— এ নিয়ে বহু প্রশ্ন আছে। এ ভাবে কি আদৌ তুলে দেওয়া যায়? তা হলে আজ বিভিন্ন জায়গায় গণনাট্য সঙ্ঘ শাখা কী করে এমন প্রচণ্ড লড়াই করেও বেঁচে আছে? অর্থাৎ গণনাট্য সঙ্ঘ আছে, চলছে, চলবে।

শুভ্রাংশু কুমার রায়, চন্দননগর, হুগলি

হারিয়ে যায়নি

‘ঠিকানা লেখা ঝড়ের কাছে’ প্রবন্ধটি তথ্যসমৃদ্ধ এবং চিন্তার রসদ জোগায়। যে বিশেষ সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্পর্কে তিনি আলোকপাত করেছেন তার উৎস নিহিত আমাদের দেশ ও বিদেশের তৎকালীন এবং তৎপূর্ব সামাজিক প্রেক্ষাপটে। দেশের ক্রম-উত্তাল হয়ে ওঠা স্বাধীনতা সংগ্রাম, গান্ধী-সুভাষ প্রমুখের দৃষ্টিভঙ্গির মতপার্থক্য, দারিদ্র, খিদে আর ইংরেজের অত্যাচার এবং সাম্প্রদায়িকতার থাবার পাশাপাশি ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন-সহ রাশিয়ায় লেনিনের নেতৃত্বে বিপ্লব বিপুল প্রভাব ফেলে ভারতীয়দের মানসপটে। ধীরে ধীরে শিক্ষিত মানুষ জনতাকে সচেতন ও ঐক্যবদ্ধ করতে থাকেন। ফ্যাসিবাদ, সাম্রাজ্যবাদবিরোধী, সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী সংগঠন ও সঙ্ঘ গড়ে ওঠে।

এই আন্দোলনের গতি যে বর্তমানে স্তিমিত, সত্যের খাতিরে তা না মানলে সত্যটাকেই হয়তো অস্বীকার করা হয়। এক সময় এই সাংস্কৃতিক আন্দোলন এমন ভাবে রাজনৈতিক দল নিয়ন্ত্রিত হয়ে দাঁড়ায় যে অনেক গুণী মানুষ তাঁদের শৈল্পিক সত্তা ও স্বাধীনতা হারাতে হবে ভেবেছিলেন, ফলে তা মানতে না পেরে একে-একে সংস্রব ত্যাগ করেন। পরে দেশভাগ হলেও অনেক নতুন-নতুন সামাজিক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। বেকারত্ব বৃদ্ধি পায়, সামাজিক ও রাজনৈতিক বিন্যাসও বদলায়। সাম্প্রদায়িকতা মাথা তোলে। স্বাধীন মত প্রকাশের অধিকার খর্বিত হয়। সঙ্ঘ বা দলে ব্যক্তিত্ব ও দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। এক দল ভেঙে একাধিক হয়ে কার্যত আন্দোলন সমন্বয় ও শক্তি হারায়।

তবে, সাংস্কৃতিক আন্দোলন যে ঝড়ের রূপ ও গতি পেয়েছিল তার মূলে যে-যে কারণ দায়ী ছিল, এবং সবার উপরে প্রতিবাদী স্বরে মানুষের পক্ষে কথা বলার যে দাবি, সে সব তো এখনও যথেষ্ট প্রাসঙ্গিক। সম্প্রতি এক চিত্রপরিচালকের পর্যবেক্ষণ অনুসারে, যত দিন মানুষের খিদে থাকবে তত দিন মার্ক্সবাদ থাকবে। সেই নিরিখে বাম সাংস্কৃতিক আন্দোলন তো আজও অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েনি।

শান্তি প্রামাণিক, হাওড়া

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Theatres leftist

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy