জয়া মিত্রের ‘বিধ্বংসের দায় প্রকৃতির নয়’ (২০-৮) প্রবন্ধের পরিপ্রেক্ষিতে এই চিঠি। আবার প্রকৃতির তাণ্ডবের মুখে দেবভূমি উত্তরাখণ্ড। গত অগস্টে ভয়ঙ্কর হড়পা বান আর কাদার স্রোতে তলিয়ে গিয়েছে উত্তরকাশী জেলার ধারালী গ্রাম। হরশিল সেনাশিবির থেকে মাত্র কয়েক কিলোমিটার দূরের পাহাড়ি এই জনপদে বহু মানুষ ভেসে গিয়েছেন বলে সরকারি সূত্রে খবর পাওয়া গিয়েছিল। বিপর্যয়ের ধাক্কায় ধারালী ও হরশিলের মাঝে এক কৃত্রিম হ্রদ তৈরি হয়ে গিয়েছে। ফলে অপেক্ষাকৃত নিচু এলাকাগুলি ফের বিপদে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা।
২০১৩ সালে কেদারনাথে মেঘভাঙা বৃষ্টির জেরে ভয়াবহ বিপর্যয় ঘটেছিল, সরকারি মতে মৃত্যু হয়েছিল অন্তত চার হাজার মানুষের। ২০২৪ সালে হড়পা বান হয়েছে উত্তরাখণ্ড এবং হিমাচল প্রদেশে। দেবভূমির এই অঞ্চলে ভাগীরথী, অলকানন্দা, মন্দাকিনী, ধৌলিগঙ্গার মতো নদী উপত্যকার মধ্য দিয়ে রাজ্য জুড়ে প্রবাহিত। হিমবাহ দ্বারা পুষ্ট নদীগুলি বর্ষাকালে তীব্র বৃষ্টিপাত এবং হিমবাহ গলে যাওয়ার কারণে ফুলেফেঁপে ওঠে। এর সঙ্গে বিপর্যয়ের ঝুঁকি বাড়াচ্ছে নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস, পাহাড় কেটে রাস্তা নির্মাণ এবং অনিয়ন্ত্রিত উন্নয়ন। তার কারণেই গোটা এলাকার ভূমির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
হিসাব বলছে, গত দশ বছরে হিমালয়ের এই অংশে হড়পা বান ও মেঘভাঙা বৃষ্টির পরিমাণ উল্লেখযোগ্য ভাবে বেড়ে গিয়েছে। পরিবেশবিদদের অনেকের মতে, তার একটা কারণ যদি প্রকৃতি বদল হয়, অন্য কারণ হিসাবে অবশ্যই মানুষকে দায়ী করা যায়। এই সমস্ত দুর্বল এলাকায় এমন কিছু নির্মাণ কাজ হচ্ছে, যেগুলির কারণে ভূপ্রকৃতির উপর চাপ পড়ছে। এই বাজার অর্থনীতির যুগে যদি পাহাড়ের উন্নয়ন স্রেফ বাজারের নিয়ম মেনে হয়, তা হলে পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্রের এই বিপদ রোখা কার্যত অসম্ভব। প্রতি বছর বর্ষা এলেই, ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে দেশের পাহাড়ি গ্রামগুলি। এক দিকে সভ্যতার অহঙ্কার, অন্য দিকে প্রকৃতির রুদ্ররূপের জাঁতাকলে পড়ে, বিপর্যয় থেকে এই সব অঞ্চলের মুক্তি নেই।
রবীন রায়, শ্যামনগর, উত্তর ২৪ পরগনা
লোভের ফল
জয়া মিত্রের ‘বিধ্বংসের দায় প্রকৃতির নয়’ প্রবন্ধটি বর্তমান সময়ের একটি অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপর আলোকপাত। এই ভাবেই হিমালয়ের চরম রোষে ধ্বংস হয়ে যাবে অনেক জনপদ, প্রাচীন ধর্মস্থান এবং তাকে ঘিরে গড়ে ওঠা অজস্র মঠ, বহুতল, হোটেল, ধর্মশালা, বাসস্থান। জীবনযাত্রার মান যত বেড়েছে, তত বেড়েছে প্রয়োজন ও আকাঙ্ক্ষা। মানুষ নির্বিচারে ধ্বংস করেছে প্রকৃতিকে। পাহাড়ের বুকে হাজার-হাজার গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। মানেনি কোনও বাধা-নিষেধ। প্রায় একশো চল্লিশ বছর আগে অ্যাটকিনস রিপোর্টে জানানো হয়েছিল প্রাচীন এক ভূমিধসের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে উত্তরাখণ্ডের চামোলি জেলার জোশীমঠ। ঘোষিত হয়েছিল সাবধানবাণী। ১৯৭৬ সালে জোশীমঠকে কেন্দ্র করে গঠিত মিশ্র কমিশনের রিপোর্টও জানিয়েছিল সেই একই কথা। ধসের উপর যে এলাকা দাঁড়িয়ে আছে তাকে কতটা যত্নের সঙ্গে রক্ষা করতে হবে, তার নির্দেশ কমিশনের রিপোর্টে দেওয়া আছে। এই মঠের চার দিক দিয়ে বয়ে চলেছে নদী। মিশ্র কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়েছিল, এখানকার পাথর মাটি ধরে রাখতে পারে না। পাহাড়ের উপর থেকে জল চুইয়ে মাটিকে আরও নরম করে দেয়। জোশীমঠের নিকাশি ব্যবস্থাও খুব খারাপ। জমা জল মাটিকে নরম করে দিচ্ছে। এখানে ধসের ঘটনা প্রায়ই ঘটে। ভৌগোলিক ভাবে এটি ভূকম্পপ্রবণ এলাকা। ২০১৩-র জুন এবং ২০২১-এর ফেব্রুয়ারির বন্যায় এলাকার প্রভূত ক্ষতি হয়েছে। এর পর যদি ভূমিকম্পের কবলে পড়ে, তবে এলাকাটি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
নানা দিক দিয়ে জোশীমঠ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এটি একটি প্রাচীন ধর্মীয় জনপথ ও পর্যটন কেন্দ্র। জোশীমঠ থেকে চিনের প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা বেশি দূরে নয়। তাই দেশের নিরাপত্তার প্রশ্নে জায়গাটি স্পর্শকাতর। কিন্তু সভ্যতার উন্নয়ন ও মানুষের লোভ, উন্নত শহর নির্মাণ করতে গিয়ে কেটে ফেলেছে অনেক বড় বড় গাছ, যে গাছ মাটি ধরে রাখে। ভূতাত্ত্বিক ভাবে সংবেদনশীল জেনেও চারধাম যুক্ত করার জন্য জাতীয় সড়ক চওড়া করার কাজ জোরকদমে চলছে। বদ্রীনাথ যাওয়ার জন্য যে রাস্তা বানানো হচ্ছে, সেখানে অনেক ভারী ভারী যন্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সুড়ঙ্গ নির্মাণের জন্য চলছে অবিরাম বিস্ফোরণ। এর ফলে পাহাড়ের পাথর এবং মাটি আলগা হয়ে গেছে। কয়েক বছর আগেই পাহাড়ের ঢালে গজিয়ে ওঠা বাড়িগুলোতে ফাটল দেখা দিয়েছিল। উপগ্ৰহ চিত্র থেকে জানা গিয়েছিল, প্রায় চার হাজার বাড়ি সেখানে বিপজ্জনক অবস্থায় আছে। হেলে পড়েছে অনেক বাড়ি, হোটেল। ভেঙে পড়েছে মন্দিরও।
২০২১ সালেই এই ফাটলের কথা সরকারের নজরে আনা হয়েছিল। আতঙ্কিত মানুষ তহসিল অফিসে বিক্ষোভ দেখিয়েছিলেন। সতর্ক করা সত্ত্বেও টনক নড়েনি সরকারের। হিমালয়ের বুকে যখন কোনও বিপজ্জনক ঘটনা ঘটে, তখন নানা বিশেষজ্ঞ কমিটি সেখানে যায়। কিন্তু তাদের সবার বক্তব্য প্রায় একই। দীর্ঘ দিন ধরে প্রকৃতির উপর নির্বিচার অত্যাচারের পরিণতি বর্তমানের এই ঘটনাপ্রবাহ। পাহাড় রক্ষার জন্য বার বার আদালতের নির্দেশ ও বিভিন্ন কমিটির নির্দেশ স্বয়ং সরকার অমান্য করছে। অমান্য করছে পুঁজিপতি ব্যবসায়ীরা, বিভিন্ন কোম্পানি, সাধারণ মানুষও। কবে আমাদের চেতনা হবে, কবে আমরা প্রকৃতির আপন গতিতে চলায় বাধা দেব না— এটা এখন গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন!
এক দিন হয়তো আমাদের লোভে ও অবহেলায় পাহাড় হারিয়ে যাবে ভূপৃষ্ঠ থেকে। ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাওয়া জোশীমঠ হয়তো এই প্রক্রিয়ার একটি সূচনামাত্র। হিমালয়ের বুকে নৈনীতাল, উত্তরকাশী, পিথোরাগড়ের মতো একাধিক পাহাড়ি জনপদ পরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রিত নির্মাণ ভাবনার অভাবে ক্রমশ ধ্বংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে আমাদের রাজ্যের দার্জিলিং, কালিম্পং, পড়শি রাজ্য সিকিমও রয়েছে। তাই এই মুহূর্তে বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী সব রকম সতর্কতামূলক ব্যবস্থা করে এই অঞ্চলগুলি বাঁচাতে সরকার ও জনগণকে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।
গৌতম পতিতমলুক, পূর্ব মেদিনীপুর
যৎসামান্য
‘এক-দেড় হাজার টাকায় কী কী হয়, জবাব দিক কেন্দ্র’ (২২-৮) প্রতিবেদন প্রসঙ্গে কিছু বক্তব্য। অবাক লাগে, আজকের আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধির বাজারে বেসরকারি সংস্থা থেকে অবসর নেওয়া অসহায় প্রবীণ নাগরিকদের পেনশন বহু যুগ আগের ১,০০০-১,৫০০ টাকায় আটকে রয়েছে। এ নিয়ে প্রচুর দরবার হয়েছে। কিন্তু সরকার এঁদের অসহায়তার কথা ভেবে ন্যূনতম পেনশন বৃদ্ধির ধারেকাছেও যায়নি। প্রতি বারই পেনশন বৃদ্ধি না হওয়ার কারণ হিসেবে সরকারের পেনশন তহবিলের ঘাটতিকেই দেখানো হয়েছে।
বিষয়টা মানা যেত, যদি আমরা দেখতাম সরকার বিভিন্ন খাতে অপ্রয়োজনীয় ব্যয় বৃদ্ধি বন্ধ রেখেছে। খুশি হতাম, যদি দেশের আর্থিক অবস্থার কথা মাথায় রেখে মন্ত্রী, সাংসদ, বিধায়করা নিজেদের সুবিধামতো সময়ে ভাতা, বেতন এবং অন্যান্য সুবিধা বাড়িয়ে না নিতেন। এ বিষয়ে সরকার বা বিরোধীদের কোনও সংঘাত লক্ষ করিনি। অর্থাৎ, যতই অমানবিক হোক, ইপিএফ-এর পেনশনভোগীদের ক্ষেত্রেই শুধু সরকারের ভাঁড়ারে টান পড়ে। মনে রাখা ভাল যে, আজকের মৃত্যুপথযাত্রী বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত প্রবীণরাও কিন্তু এক দিন দেশের উন্নয়নে যথেষ্ট অবদান রেখেছেন। বিভিন্ন উৎপাদনের ক্ষেত্রে তাঁদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মূল্যও কিছু কম নয়। তাই, স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে চিকিৎসা এবং ন্যূনতম দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটানোর জন্য কি তাঁরা একটা ভদ্রস্থ পেনশন আশা করতে পারেন না? সরকারকে একটু মানবিক হতে অনুরোধ জানাই।
তনয় রাউত, কলকাতা-১০৯
এই খবরটি পড়ার জন্য সাবস্ক্রাইব করুন
5,148
1,999
429
169
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)