Advertisement
১১ মে ২০২৪
Sand Mafia

বালির বাঁধ

স্তুত নদীর পাড়ে দাঁড়াইলে দৃষ্টিবিভ্রম হইতে পারে। তখন আইনের শাসন আর দুর্বৃত্তরাজ, এই দুইটিকে বিপরীত শক্তি না দেখিয়া, মনে হইতে পারে যেন একই মুদ্রার দুইটি দিক।

শেষ আপডেট: ০১ অগস্ট ২০২০ ০০:৩৫
Share: Save:

অজয়, দামোদর, ময়ূরাক্ষী, কংসাবতী, শিলাবতী, সুবর্ণরেখা— নদীগুলির তীরে রাষ্ট্র যেন থমকিয়া দাঁড়াইয়াছে। তাহার পরে বালি মাফিয়াদের রাজত্ব। সেখানে সরকারি বিধিনিয়ম প্রবেশ করিতেও ভয় পায়। পুলিশ নির্বিবাদে শত শত চোরাই বালির ট্রাক ছাড়িয়া দেয়। পরিণাম অজানা নহে। রাজস্বের কোটি কোটি টাকা ক্ষতি, নদীর জীবনীশক্তি হ্রাস, পাড়ের ভাঙন, নদীবাঁধের ক্ষয়। বালি-বোঝাই ট্রাকের অবিরাম যাতায়াতে রাস্তা ভাঙিতেছে, দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হইতেছে। বায়ু ও শব্দদূষণে এলাকাবাসীর জীবন দুর্বিষহ। বালিচোরদের দৌরাত্ম্য কিন্তু একটুও কমে নাই। সন্দেহ হয়, রাষ্ট্রযন্ত্রের পা দুইটি বালির। প্রলোভনের জল লাগিলেই গলিয়া যায়। দুর্বৃত্তরা সরকারি বিধিনিষেধ তাচ্ছিল্য করিলে তাঁহারা চক্ষু মুদিয়া থাকেন। বীরভূম, বর্ধমান, পশ্চিম মেদিনীপুরে কোথাও জেলাশাসক সাংবাদিকদের বলিয়াছেন অবৈধ বালিখাদানের অস্তিত্ব তিনি জানেন না; কোথাও পুলিশকর্তা আশ্বাস দিয়াছেন, দোষীদের জরিমানা হইবে, অবৈধ খাদান বন্ধ হইবে। সকলই অসার। শাস্তির নিশ্চয়তা থাকিলে দীর্ঘ দিন নিরবচ্ছিন্ন ভাবে প্রাকৃতিক সম্পদের লুণ্ঠন চলিতে পারিত না। প্রশাসন দুষ্কৃতীদের আড়াল করিতেছে বলিয়াই তাহা সম্ভব হইতেছে। বস্তুত নদীর পাড়ে দাঁড়াইলে দৃষ্টিবিভ্রম হইতে পারে। তখন আইনের শাসন আর দুর্বৃত্তরাজ, এই দুইটিকে বিপরীত শক্তি না দেখিয়া, মনে হইতে পারে যেন একই মুদ্রার দুইটি দিক। কিংবা দুই সমান্তরাল ব্যবস্থা। অতএব, ঘুষের রসিদ দেখিলে গাড়ি ছাড়িয়া দেয় পুলিশ।

এই দেশের দুর্ভাগ্য, তাহার রাজনীতির ধর্ম আর রাজধর্মের মধ্যে প্রায়ই সংঘাত বাধিয়া থাকে। বাংলার কয়লা খাদান, খোলামুখ কয়লা খনি, বালি খাদান, ইট ভাটা, মাছের ভেড়ি— এমন বেশ কিছু ক্ষেত্রে বৈধ ব্যবসার তুলনায় অবৈধ কারবারের দাপট অধিক। অভিযোগ, রাজনৈতিক নেতাদের একাংশের ছত্রচ্ছায়াতেই তাহা চলে। রাজস্ব ফাঁকি দিয়া সেই অর্থ নির্বাচনী রাজনীতির প্রয়োজন মিটাইতেছে, জনস্বার্থের হানি করিয়া জনসমর্থন ক্রয় করিতেছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও প্রকাশ্যে স্বীকার করিয়াছেন, প্রশাসনের কিছু ব্যক্তির সহিত যোগসাজশেই কাজ করিতেছে বালিমাফিয়ারা। রাজনৈতিক সংযোগের অভিযোগও প্রকাশ্যে আসিয়াছে বার বার, এমনকি বৈধ বালিখাদানের মালিকরা তাঁহাদের অভিযোগে রাজনৈতিক নেতা এবং অবৈধ কারবারিদের নামও করিয়াছেন। বালি পাচারের বিশদ বিবরণ, এবং তাহার জন্য সম্ভাব্য রাজস্ব ক্ষতির পরিমাণ হিসাব কষিয়া দিয়াছেন গড়বেতার বৈধ বালিখাদানের মালিকেরা। কিন্তু তাহার পরেও প্রশাসনের কোনও তরফই দুর্বৃত্তদের শাস্তির ব্যবস্থা করে নাই।

বালিচুরির ফলে নদীগুলির ক্ষতি হইয়া যে পরিস্থিতির উদ্ভব হইতেছে, তাহাতে সমগ্র দক্ষিণবঙ্গের মানুষকে ভুগিতে হইবে। বিশেষজ্ঞরা যথার্থই বলিয়াছেন যে, দামোদরের উপর ক্রমান্বয়ে ‘নির্যাতন’ চলিতেছে। নদীর তট হইতে তাহার প্রবাহ পর্যন্ত দুই-আড়াই কিলোমিটার গাড়ি যাতায়াতের সুবিধার জন্য পাকা রাস্তা অবধি নির্মাণ করিয়া ফেলিয়াছে মাফিয়ারা। ইহার পরিণাম ভয়ানক। কেবল অমূল্য প্রাকৃতিক সম্পদের ক্ষয় নহে, স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি হারাইয়া নদীও ক্রমে হারাইবে। রাষ্ট্রের শক্তিহীনতার মূল্য চুকাইতে হইবে নাগরিককে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Sand Mafia Ajay River Damodar River
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE