Advertisement
E-Paper

দুষ্টচক্রের হাত থেকে রাজনীতিকে স্বস্থানে ফেরান

ভাবলাম, এরা কারা? এরা কি জানে না কার মস্তক ছেদন করল? এ তো বাঙালির জাত্যাভিমানে আঘাত। জাত্যাভিমানে আঘাত করে কোন জাতির মন পাওয়া সম্ভব? লিখছেন দেবদাস আচার্য

শেষ আপডেট: ১৭ মে ২০১৯ ০৩:০৩

গত মঙ্গলবার (১৪-৫-১৯) সন্ধের সময় ঘরে বসে টিভিতে কলকাতায় অমিত শাহ রোড শো দেখছিলাম।

রোড শো যখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াচ্ছে তখন দেখলাম কিছু মানুষ কালো পতাকা দেখাচ্ছে এবং ‘গো ব্যাক’ ইত্যাদি স্লোগান দিচ্ছে। মনে করলাম, একটা সাধারণ ঘটনা। প্রতিপক্ষ এমন একটু-আধটু করেই থাকে। আমরা বরাবর দেখে আসছি। কিন্তু যেই বিদ্যাসাগর কলেজের দিকে এগোল রোড শো, উস্কানি একটু বাড়ল। ইট-পাথর পড়তে লাগল। ব্যাপারটা আর নিরামিষ থাকল না। পদযাত্রা বা রোড শো-র মিছিল থেকে কিছু মানুষ বেরিয়ে এসে শুরু করে দিল তাণ্ডব। ভাঙচুর, ইট-পাথর দিয়ে বেপরোয়া আক্রমণ। এবং কিছু ক্ষণের মধ্যেই বিদ্যাসাগর কলেজে একটা রণভূমি হয়ে উঠল। টিভির পর্দায় দেখলাম, বিদ্যাসাগরের মর্মর মূর্তি ভেঙে পড়ে আছে। তার মুণ্ডছেদন করা হয়েছে।

মর্মাহত হলাম তো বটেই, একেবারে হতভম্ব হয়ে পড়লাম। ভাবলাম, এরা কারা? এরা কি জানে না কার মস্তক ছেদন করল? এ তো বাঙালির জাত্যাভিমানে আঘাত। জাত্যাভিমানে আঘাত করে কোন জাতির মন পাওয়া সম্ভব? এই জ্ঞানটুকু কি তাদের নেই? যেহেতু অমিত শাহর রোড শো-র মিছিল থেকে বেরিয়ে এসে বেশ কিছু মানুষ এই তাণ্ডব চালাল, তাই ধরে নিতে পারি তারা বিজেপি দলেরই সমর্থক।

যদি তা না হয়, তবে বিজেপির দায়িত্ব প্রমাণ করা যে, তারা তাদের দলের কেউ নয়, চক্রান্ত করে তাদের মিছিলে ঢোকানো হয়েছে রোড শো ভণ্ডুল করার জন্য। যত উস্কানি থাকুক, কাণ্ডজ্ঞান হারাতে হবে?

এ রকম হতভম্ব হয়েছিলাম সত্তরের দশকে যখন সিপিআই (এমএল)-এর নামে ঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী, মনীষীদের মূর্তি ভাঙা চলছিল। আমি তখন তরুণ। নিজেও বামপন্থী মানসিকতা পোষণ করতাম। সাম্যবাদী সমাজের স্বপ্ন দেখতাম। তবু নীতিগত ভাবে ওই মূর্তি ভাঙার যুক্তি আমি মেনে নিতে পারিনি। মনীষীদের মূর্তির আড়ালে বুর্জোয়া সংস্কৃতি, অপসংস্কৃতির চর্চা হচ্ছে। ভাববাদী দর্শনের চক্রে মানুষকে ডুবিয়ে মারা হচ্ছে। অতএব, ভেঙে দাও তাদের স্মারক মূর্তি। যখন বিদ্যাসাগরের মূর্তির (কলেজ স্কোয়ার) মুণ্ডচ্ছেদ করা হল, আমি হতভম্ব হয়েছিলাম এই ভেবে যে, যাঁর ‘বর্ণপরিচয়’ হাতে বাঙালি জাতির ‘অ-আ-ক-খ’ শিক্ষা লাভ, যিনি বাংলা গদ্যভাষার জনক, আধুনিক গদ্য ভাষার কাঠামোটি তিনিই দাঁড় করিয়েছেন। আমরা কেবল সেই পথেই আমাদের ভাষা সম্পদ গড়ে তুলছি। তার মুণ্ডচ্ছেদ মেনে নিতে পারা সম্ভব নয়। কাণ্ডজ্ঞানহীন কাণ্ড।

তা ছাড়া, তার নানান প্রগতিশীল কর্মকাণ্ডের সুফল সমাজ ভোগ করছে। বিদ্যাসাগর এক আলোক স্তম্ভ। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙা তো নয়, এ বাঙালি জাত্যাভিমানে আঘাত করা। এর একটা বিহিত দরকার। সম্পূর্ণ রাজনীতি নিরপেক্ষ ভাবে তদন্ত করে সিসিটিভি দেখে চিহ্নিত করে আসল দোষীকে খুঁজে বের করা ও শাস্তি প্রদান করা। তদন্তের নামে প্রহসন এ ক্ষেত্রে যেন না হয়। এগুলো আর্থিক কেলেঙ্কারির মামলা নয়। বাঙালির জাত্যাভিমানের মামলা। তদন্ত করে দোষী কে, বাঙালি জনগণের দরবারে তার ছবি ও পরিচয় সহ প্রতিটি দৈনিক খবরের কাগজে গুরুত্ব দিয়ে চেপে পৌঁছে দেওয়া দরকার। মানুষের ঘৃণা তার উপর বর্ষিত হোক। এটাই তার আসল শাস্তি। আইনের শাস্তি কী বা কতটুকু হতে পারে, তা আমি জানি না। তবে মানুষের চোখে ক্ষমার অযোগ্য হয়ে চিহ্নিত থাকুক।

রাজনীতির বহু কৌণিক দিশা থাকে। কিন্তু তার প্রধান দু’টি দিক হল (এক) তাত্ত্বিক দিক, (দুই) প্রায়োগিক বা ফলিত দিক। তাত্ত্বিক দিক তো শুনতে বা পড়তে ভাল লাগে। গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র ইত্যাদি। এ সব তাত্ত্বিক দিক একটা রাষ্ট্রব্যবস্থার এটা ধর্ম বা চরিত্র। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে এত তাণ্ডব কেন? ভোটের সময় এলেই দলগুলি মারকুটে হয়ে উঠবে কেন? মানুষ ভোটের সময় ভয় পাবে কেন? কেনই বা এই সময়ে দুষ্কৃতীরা মূর্তি ভাঙবে? দুষ্কৃতীরা দাপিয়ে বেড়াবে? এই ব্যর্থ প্রায়োগিক দিকটির জন্য সমাজ জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। আর নয়, এ বার থামুন। দুষ্টচক্রের হাত থেকে রাজনীতিকে স্বস্থানে ফিরিয়ে আনুন।

আমার এই নিবেদন।

লেখক কবি

Lok Sabha Election 2019 Vioence Vidyasagar College Vandalization BJP Amit Shah
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy