Advertisement
E-Paper

কথাগুলো অন্তত স্বস্তি দেয়

সব ইস্তাহারের একটা সুর থাকে। সে বারের সুরটা ছিল রক্ষণাত্মক। প্রতিশ্রুতি শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধিতে তার সাক্ষাৎ প্রমাণ।

সেমন্তী ঘোষ

শেষ আপডেট: ০৫ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০১

মোটের ওপর ভদ্রলোকের এক কথা, মানে, এক ইস্তাহার। ২০১৪ সালের কংগ্রেস ইস্তাহারটি বার করে মিলিয়ে দেখলে দেখব এ বছরেরটার সঙ্গে বেশ অনেকটা মিল। সেই চাপা স্বরে অল্প প্রতিশ্রুতি। সেই ‘ন্যায়’ আর ‘অধিকার’-এর আখ্যান। সেই যুবসমাজ আর মেয়েদের ‘ইসু’গুলির উপর জোর। সেই শিক্ষা ও কর্মসংস্থান বাড়ানোর কথা। সেই গ্রামসমাজ ও কৃষি উন্নয়নের ভাবনা। সব মিলিয়ে, সেই ‘ইনক্লুসিভ’ বা যোগাত্মক সমাজের লক্ষ্য।

কেউ কেউ শব্দ-গণনা করে বিশ্লেষণের চেষ্টা করেন, যাকে বলে ওয়ার্ড ফ্রিকোয়েন্সি অ্যানালিসিস। কোন শব্দ কত বার ব্যবহার হয়েছে তার ধারণা দেয় এই বিশ্লেষণ। পদ্ধতিটা যান্ত্রিক হলেও কিছু ইঙ্গিত তাতে পাওয়া যেতে পারে। যেমন ২০১৪ সালে ‘প্রতিশ্রুতি’ কথাটা ব্যবহার হয়েছিল মাত্র ৭ বার, আর ২০১৯ সালে ২৩৩ বার। ‘অর্থনীতি’ শব্দটাও ৭ বারের জায়গায় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩২ বার।

সব ইস্তাহারের একটা সুর থাকে। সে বারের সুরটা ছিল রক্ষণাত্মক। প্রতিশ্রুতি শব্দের ব্যবহার বৃদ্ধিতে তার সাক্ষাৎ প্রমাণ। দুই পর্বে ইউপিএ সরকারের বিরুদ্ধে বেশ কিছু দুর্নীতি আর ব্যর্থতার অভিযোগ উঠেছিল, তাই সে বার রক্ষণে মন না দিয়ে উপায় ছিল না। এ বার অন্য সুর। ‘আমাদের শপথ: চাকরি, চাকরি, চাকরি’, এই বাক্যকে আক্রমণাত্মক না বললেও রক্ষণের গোত্রে ফেলা মুশকিল।

বিরোধী দলের অবস্থান হিসেবে ভাবলে অবশ্য এই ঈষৎ উচ্চগ্রামের সুরটাকেও শেষ পর্যন্ত চাপা-ই শোনাচ্ছে। ফেসবুক-এ দেখছি, অনেকেই এই চাপা সুরের প্রশংসা করছেন: মনের শান্তি, কানের আরাম। তবে সে কৃতিত্ব কংগ্রেসকে দেওয়া যাবে না, পরোক্ষে এটা বর্তমান সরকারের ঘাড়েই বর্তাবে। সিংহপুরুষ নরেন্দ্র মোদী ও অমিতবিক্রম অমিত শাহের অবদান— অন্য যে কারও কথাই আজকাল কেমন মধুর শোনায়। সব কিছুই আপেক্ষিক কি না!

আর একটা সুরের উল্লেখ করতেই হবে। সেই সুরটা আপেক্ষিক নয়, আক্রমণ-রক্ষণের গোত্রেও তার বিচার হয় না। এবং এই সুরটি দুই বছরের কংগ্রেস ইস্তাহারে একই রকম। তা হল, মূল সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রশ্নগুলিতে ফিরে যাওয়া। সত্যি, কত দিন পর স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও ক্লাসরুমের কথা কাগজের প্রথম পাতায় পড়লাম! জলাশয় বা পতিত জমি ইত্যাদি যে এই ভারতে আছে, গরু আর মন্দিরের চোটে গত পাঁচ বছরে তা ভুলে যাওয়ার জো হয়েছিল। দেশীয় সমাজের কথা বলতে এত দিন আমরা খালি মেক ইন ইন্ডিয়া-র বাগাড়ম্বর শুনতাম। আবার, এই ইস্তাহারে মাটির কাছাকাছি কথাগুলোর পাশাপাশি মেক ফর ওয়ার্ল্ড-এর মতো খোলামেলা কথাও কিন্তু পাওয়া গেল।

রাহুল গাঁধীর উদ্দেশে আবেগাশ্রু বওয়ানোর দরকার নেই। আমরা জানি, নেতারা নেতাই, রাজনীতি রাজনীতিই। ভোটের আগে অনেক কথা, যাকে বলে, আজেন্ডা, শোনাতে হয় এঁদের। ক্ষমতায় এলে যে তাঁরা সেই সব কথা মনে রাখবেন, এই প্রত্যাশা বোকামানুষি। আমরা জানি, এগুলোর নাম ‘রেটরিক’। রাজনীতির অলঙ্কার হিসেবে এরা আসে, ভাসে, মিলিয়ে যায়। তবে কিনা, কে কী ভাসাচ্ছেন, সেটাও খুব লক্ষণীয়। সেই দিক দিয়ে কংগ্রেস দলের ইস্তাহারের মধ্যে যে একটা ধারাবাহিকতা আছে, সেটাই এখানে বক্তব্য।

পরিস্থিতি গুরুতর। প্রচারে নেমে শাসক দল যদি ক্রমাগত হিন্দু অহিন্দু জঙ্গি ইত্যাদি শব্দের ফুলকি ছড়াতে থাকে, তবে তার উল্টো দিকে বিরোধী ইস্তাহারের রেটরিকগুলোকে অতিরিক্ত গুরুত্ব দিয়ে খেয়াল করতেই হয়। ২০১৪ সালে ‘বিকাশপুরুষ’ হিসেবে আবির্ভূত হয়ে প্রধান শাসক যদি পাঁচ বছর রাজত্ব করে ২০১৯ সালে নিজেকে এবং সবাইকে ‘চৌকিদার’ ঘোষণা করেন, তাঁর শাসনে ‘বিকাশ’-এর কী হাল হল, সেই তদন্ত না করে উপায় থাকে না। চির কাল ভারতের অন্দরে সেনাবাহিনী এবং বাইরে পাকিস্তান ছিল— তাও কেন ২০১৯-এর সরকারি দলের সব প্রচারবক্তৃতায় প্রায় বাধ্যতামূলক ‘রেটরিক’ হিসেবে তা উপস্থিত থাকছে, সেটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবতে হয়। আর ক্রুদ্ধ হতে হয় শুনে যে, রাহুল গাঁধী অমেঠীর সঙ্গে কেরলের ওয়েনাড থেকেও প্রার্থী হচ্ছেন শুনে মোদী সমালোচনা করছেন এই বলে— যে নির্বাচনী কেন্দ্রে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের মানুষ বেশি, সেখান থেকে ভোটে লড়তে রাহুল ভয় পাচ্ছেন! কোনও প্রধানমন্ত্রী যখন ক্রমাগত দেশের নাগরিককে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর আয়নায় বিচার করেন, তখন ভোটের আগে সেই প্রধানমন্ত্রী বিষয়ে একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হয়।

এবং বুঝতে হয়, কেন অরুণ জেটলির মতো নেতাদের মনে হল যে এই কংগ্রেস ইস্তাহার ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’-এর কীর্তি। অমিত শাহ বলেছেন, ভারতের ‘ব্রেভ সোলজার’দের অপমান আছে এর মধ্যে। আর মোদীর মনে হয়েছে, এই ইস্তাহারকে ‘ঘোষণাপত্র’ না বলে ‘ঢকোসলাপত্র’ বলা উচিত, এর মধ্যে আছে ধোঁকা বা লোক-ঠকানোর বন্দোবস্ত, অ্যান্টি-ন্যাশনাল পাকিস্তান-প্রেম। অর্থাৎ বিজেপি নেতারা ঠিক করে নিয়েছেন যে, কর্মসংস্থানের প্রতিশ্রুতি আর উন্নয়ন পরিকল্পনার মোকাবিলা তাঁদের সাধ্যের বাইরে। তাঁরা যদি এর বিরোধিতা করেন, লোকে মন্দ বলবে, ব্যঙ্গোক্তি ধেয়ে আসারও সম্ভাবনা। এমন সমালোচনা করতে হবে যেটা বুমেরাং হয়ে ফেরত আসবে না, তাঁদের রিপোর্ট কার্ডের কথা কাউকে মনে করাবে না। সুতরাং সবচেয়ে নিরাপদ— দেশভক্তির লাইনে খেলা, কংগ্রেসের ‘অ্যান্টি-ন্যাশনালিজ়ম’-এর দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া। মোদীরা জানেন, এই তাসটা কখনও ভুল খেলা হবে না। ভাবেন, দেশের মানুষের মনে এই ধারণাটা গেঁথে গিয়েছে যে ‘ন্যাশনালিজ়ম’ মানেই বিজেপি, আর বাকিরা পাকিস্তানি, দেশদ্রোহী!

কংগ্রেসের ইস্তাহারের যে লাইনগুলোর জন্য বিজেপির এই সমালোচনা, সেই লাইনসমূহের অনেকটাই অবশ্য এ বারের সংযোজন। তার মধ্যে আছে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদ দেশের সংসদের কাছে দায়বদ্ধ থাকার কথা, আফস্পা বা সামরিক বাহিনীর বিশেষ ক্ষমতা আইন সংশোধন করার কথা, রাষ্ট্রদ্রোহ আইন তুলে দেওয়ার কথা। এর প্রতিটি নিয়েই বিস্তারিত আলোচনা সম্ভব, কিন্তু তার মধ্যে না গিয়ে আপাতত এটুকু বলা যায় যে, এর প্রতিটিই অত্যন্ত সঙ্গত ও বহুপ্রতীক্ষিত। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনটি যে ঔপনিবেশিক আমলের উত্তরাধিকার এবং প্রবল ভাবে সংস্কারযোগ্য, তা নিয়ে রাষ্ট্রনীতিবিদরা অনেক কথা বলেছেন ইতিমধ্যে। দেশের পক্ষে বিপজ্জনক কাজ করলে অন্য আইনেও তাকে শাস্তি দেওয়া সম্ভব। বিচার ছাড়া পুলিশের আটক করার ক্ষমতা তুলে দেওয়া— যে কোনও গণতন্ত্রের দায়িত্ব বলে গণ্য করা হয়। আর আফস্পা? এই অনৈতিক সামরিক আইনটি কখনও কখনও প্রয়োজন হতে পারে, কিন্তু লাগাতার ভাবে একে জারি করে রাখা অমানবিক, মৌলিক অধিকার-বিরোধী। ইস্তাহারের ৩৫ নম্বর পাতাটিতে এই সব কথা আছে, সে পৃষ্ঠাটা খুলে ধরে জেটলি তাতে আলাদা নজর দিতে বলেছেন। দুঃখিত অর্থমন্ত্রী, খুলে ধরে দেখে বলছি, এই দাবিগুলি গণতান্ত্রিক এবং শুভবুদ্ধিপ্রসূত।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

অর্থমন্ত্রীর বিবেচনাবোধের স্বল্পতা অবশ্য আর একটি প্রসঙ্গেও প্রকট হচ্ছে। তাঁর কাশ্মীর বিষয়ক আপত্তি বিজেপির সেই আজেন্ডার মধ্যে পড়ে, যা ইতিমধ্যেই ভয়ানক ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। আফস্পা কমানোর কংগ্রেসি প্রতিশ্রুতিটি উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, সেনার উপস্থিতি কমলে পাথর মেরেও কেউ অনায়াসে রেহাই পেয়ে যেতে পারে। সত্যিই কি তাই? ভারতের অন্য কোনও প্রদেশে কেউ যদি কাউকে লাগাতার পাথর মেরে আক্রমণ করে, তারা কি রেহাই পেয়ে যায়? পুলিশ তাদের ধরে না? আসলে বহু দিনের কাশ্মীর-বিষয়ক ঔদাসীন্যের চোটে জেটলিরা একটা কথা ভুলেই গিয়েছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষার কাজটা আসলে পুলিশেরই, সেনাবাহিনীর নয়। কাশ্মীরের নাগরিক সমাজকেও কিন্তু সে রাজ্যের পুলিশ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, কড়া হাতেই। বিচ্ছিন্নতাবাদী বা জঙ্গি আক্রমণ দেখা দিলে তখন পরিস্থিতিসাপেক্ষে সেনাবাহিনী নামতে পারে। কিন্তু ২৪ x ৩৬৫ সেনাশাসন কোনও জনগোষ্ঠীর জন্য বাঞ্ছনীয় নয়, বিশেষত যে জনগোষ্ঠীকে দেশের নাগরিক হিসেবে প্রতিপন্ন করতে সরকার মরিয়া।

ভোট-ঋতুতে এই ইস্তাহার তাই একাধিক উপকার করল। ভারত নামের দেশটা যে কিসের জন্য বানানো হয়েছিল, নানা জঞ্জাল ও বাগাড়ম্বরে সেটা ভুলে যাওয়ার জোগাড় হয়েছিল। চটি বইটি আর এক বার তা মনে করিয়ে দিল। দুই, এই ইস্তাহারের সমালোচনা থেকে সমালোচকদের সম্পর্কে কী কী সিদ্ধান্ত করা যায়, সেটা আরও এক বার খেয়াল করিয়ে দিল। একটু আলাদা অর্থে ‘ধোঁকা (বিষয়ক) পত্র’ তাই একে বলাই যেতে পারে।

Congress Lok Sabha Election 2019 Election Manifesto
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy