Advertisement
E-Paper

ভোট ও বাংলা সংবাদের ভাষা

আমি রোজ এমন কোনও কাজ করি না যাতে সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয় বা বিরক্ত হতে হয়। সে-দিক থেকে আমি আলস্যে ব্যস্ত থাকি বলাই ভাল। কিন্তু মুহূর্তে আমার আলস্য কেটে যায় ও আমি একা-একাই ফুর্তি পেতে শুরু করি

দেবেশ রায় 

শেষ আপডেট: ২৬ এপ্রিল ২০১৯ ০০:০৬

আমি রোজ এমন কোনও কাজ করি না যাতে সব সময় ব্যস্ত থাকতে হয় বা বিরক্ত হতে হয়। সে-দিক থেকে আমি আলস্যে ব্যস্ত থাকি বলাই ভাল। কিন্তু মুহূর্তে আমার আলস্য কেটে যায় ও আমি একা-একাই ফুর্তি পেতে শুরু করি, যদি কোথাও কোনও কারণে একটা সুন্দর বাংলা বাক্য পড়ে ফেলি বা কোনও গানের মোচড় শুনতে পাই। এর সঙ্গেই জুড়ে আছে আর এক স্বভাব— প্রশংসার কিছু পেলে আমি তারস্বরে সেটা সবাইকে তৎক্ষণাৎ জানাতে চাই। এতে বন্ধুমহলে এক সময় আমার বদনাম ছিল, আমি নাকি অনেকের মাথা খাই। খেয়ে থাকতে পারি কিন্তু এখনও তো বদহজমের কোনও লক্ষণ দেখি না।

এই লেখাটির অব্যবহিত উপলক্ষ— ভোট নিয়ে বাংলা সাংবাদিকতা। প্রতি দিন সারাটা সকাল আমার কেটে যায় গুনে-গুনে ছ’টা বাংলা কাগজ ও চারটে ইংরেজি কাগজে ভোটের খবর খুঁটিয়ে পড়তে। পড়ার বিষয় এতই বেশি থাকে, দু’চারটে ইংরেজি কাগজ ও ম্যাগাজ়িন পড়াটা বিকেলের দিকে চলে যায়।

বাংলা কাগজগুলো, প্রায় প্রত্যেক কাগজই, তাঁদের সাংবাদিকদের এক-একটি আসনের সংশ্লিষ্ট এলাকার একেবারে অভ্যন্তরে পাঠান। এমন বাছাইয়ের কারণ নিশ্চয়ই থাকে। কোনও জায়গায় বহু পুরনো অভিযোগের প্রতিকার না-হওয়ায় ভোটাররা বেঁকে বসেছেন। কোথাও-বা পারিবারিক পাকা আসন ও চলাফেরার আদবকায়দা

ভোটারদের পক্ষে বাধা হয়ে উঠছে। কোথাও-বা বাংলাদেশ সীমান্তের ভারতীয় গ্রামের টিনের চালে একাত্তরের খান-সেনাদের গুলির ফুটো। কোথাও-বা দুই স্বাধীন দেশকে স্বাধীন রেখে নীলফামারির দিকে ট্রেন চলে যাচ্ছে। নীলফামারি। নীলমণির হাট। লালমণির হাট। এক লুপ্ত মানচিত্রের চিরন্তনতা। বালুর ঘাট। আত্রেয়ী নদী।

আর সাংবাদিকরা লেখেন এমন ভাষায় যা কোনও সংবাদ দিতে চায় না, একটা জীবনযাত্রাকে তার প্রতি দিনে তুলে আনতে চায়। জায়গার নাম, মানুষের নাম, খালবিলের নাম দিয়ে যেন একটা গোটা দেশ নির্মিত হতে থাকে। একেবারে উপন্যাসের ভাষা, যা এতটাই আধুনিক ও চিত্রল যে, কোনও একটি ঘটনার অনুসরণের দায় থেকে মুক্ত। বাংলার ঔপন্যাসিকরা যদি সাংবাদিকদের এই লেখাগুলো থেকে একটু শিখে নিতে পারতেন আধুনিক উপন্যাসের ভাষা! খেলার রিপোর্ট করতে গিয়েই এই ভাষা রিপোর্টাররা আয়ত্ত করেছিলেন।

এমন রিপোর্টের পাশেই প্রত্যেকটি কাগজে থাকে— ভোটের তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ। যাঁরা তাত্ত্বিক হিসেবে নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত, তাঁদের লেখা কিছুতেই অনুবাদ-গন্ধ ছাড়তে পারে না। কিন্তু এমন অনেকে লেখেন যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম-করা ছাত্র, প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার বা অধ্যাপনার পথে না গিয়ে সাংবাদিকতায় এসেছেন, তবে পড়াশোনা ছাড়েননি। তাঁদের লেখাগুলোতে প্রয়োজনীয় তথ্যের উল্লেখ যে কোনও আন্তর্জাতিক সেমিনারের যোগ্য। সংবাদপত্রে এমন গুণসম্পন্ন লেখা ঘটত ‘প্রবাসী’র যুগে। এমন ঘটনাও বাংলা সংবাদপত্রে ঘটে চলেছে অনেক বছর ধরে, প্রতি সপ্তাহে, যে সেই সপ্তাহের জরুরিতম খবর নিয়ে এক-একটা লেখা প্রকাশিত হচ্ছে— নির্ভুল তথ্যে ও ইঙ্গিতে। নাম বলার লোভ সামলানো মুশকিল কিন্তু নাম বলাটা অসৌজন্য। তবে এটাও ভাবতে কষ্ট হচ্ছে— এই সব বিশিষ্ট ও মূল্যবান লেখার একমাত্র ভবিতব্য হারিয়ে যাওয়া। যে কাগজে বেরোচ্ছে, তাঁরাও তো বছরে একটা সঙ্কলন বার করতে পারেন।

কয়েকটি ইংরেজি পত্রিকায় এবং যাদের জাতীয় সংবাদপত্র বলা হয়ে থাকে সেই কাগজগুলোতে নিশ্চয়ই অনেকের অনেক ভাল লেখা বেরোয়। তাঁরাও অনেকে বিদ্বান, বিশেষজ্ঞ ও পায়ে-হেঁটে রিপোর্ট করার মতো পরিশ্রমী। তার সঙ্গে এটাও কিন্তু হিসেবে রাখতে হবে, তাঁদের প্রতিযোগিতা বিখ্যাত সব বিদেশি কাগজ ও ম্যাগাজ়িনের সঙ্গে। সেই প্রতিযোগিতায় তাঁরা খুব একটা জিততে পারবেন কি না সে প্রশ্ন থাকুক, কিন্তু আমাদের বাংলা সাংবাদিকতায় তো তেমন কোনও প্রতিযোগিতার জায়গাই নেই। তবু অনুশীলন ও আবিষ্কারের এই দায় তৈরি হয় নিজেদের এই অনুভব থেকে— আমরা বিশ্বমানেরই সংবাদিকতা করছি। সেটা যে কতই কঠিন তা বোঝা যায় আমাদের রাজনৈতিক নেতাদের বক্তৃতা ও বিভিন্ন বাংলা টিভি চ্যানেলে রাজনৈতিক বিতর্ক বা বিশ্লেষণ শুনলে। কোনও নতুন তথ্য নেই, কোনও নতুন ব্যাখ্যা নেই, শুধু আত্মসম্মানহীন বিড়ালের ঝগড়া— তোর বাবা আমার বাবার জল ঘোলা করেছিল।

এঁরা কি বাংলা কাগজ পড়েন না? তা হলে এঁদের ভাষা শিষ্ট ও নাগরিক হয় না কেন? কেন রাজনীতির যোগ্য হয় না? কেন হয়ে দাঁড়ায় শুধুই কোন্দল?

বাংলা সাংবাদিকতা কিন্তু সামাজিক বিনিময়ের শিক্ষক হয়ে উঠছে।

ইমেল-এ সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার জন্য প্রবন্ধ পাঠানোর ঠিকানা: editpage@abp.in
অনুগ্রহ করে সঙ্গে ফোন নম্বর জানাবেন।

Lok Sabha Election 2019 Politics Vote
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy