Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

বিক্ষিপ্ত বিভাজনের গরম হাওয়া সাময়িক, উত্তরের ছন্দ একাত্মতারই

আজ লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গের দ্বিতীয় পর্ব। ব্যস্ততা সর্বত্র। ব্যস্ততা বুথ অফিসেও। চেনা পরিসরের বাইরে বুথ অফিসের অন্য ছবির কথা লিখছেন সোনালি ঘোষ

শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৯ ০৩:২০
Share: Save:

মাত্র একদিনের জন্যে একটা অফিস? ভোটের জন্য সেটাও হয়। তার পোশাকি নাম বুথ অফিস। যে কোনও ভোটগ্রহণ কেন্দ্র থেকে দু’শো মিটার দূরে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের জন্যে অতি সামান্য আচ্ছাদনে তৈরি করা হয় এই একদিনের অফিস। আজ, নির্বাচনের দ্বিতীয় দফাতেও যা শোভা পাচ্ছে উত্তরের তিন লোকসভা কেন্দ্রে।

ভোটকেন্দ্রে যাওয়ার আগে চোখে পড়বেই এই সব বুথ অফিস। টেবিল-চেয়ার পেতে এক এক বুথ অফিসে বসে আছেন সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলের কর্মীরা। বেশির ভাগ সময়ে এঁরা আমাদের খুব চেনা মুখ। অর্থাৎ, পাড়ারই লোকজন। ক্ষেত্রবিশেষে এঁদের সঙ্গে থাকেন পাশের পাড়ারও কেউ।

ভোট দিতে যাওয়া নাগরিককে সাহায্য করাই এঁদের কাজ। নিয়মানুযায়ী, সাহায্য বলতে, ভোটারকে ভোটার লিস্টের পার্ট-নম্বর, ক্রমিক সংখ্যা প্রভৃতি বলে দেওয়া। অনেক সময়ে একই জায়গায় কিছুটা দূরে পাশাপাশি দু’টো ঘরে ভোট দেওয়ার জন্য দু’টি বুথও তৈরি করা হয়। কোন ভোটার কোন ঘরে ভোট দেবেন, সে বিষয়েও সাহায্য করেন এঁরা।

দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯

বুথ অফিসের সৌজন্যে সায়মিক ভাবে পাড়ার বিভাজন ঘটে যায়। একই পাড়ার পাশাপাশি দু’বাড়ির দু’জন দুই ভিন্ন রাজনৈতিক দলের বুথ অফিসে বসে কাজ সামলাচ্ছেন— এটা খুবই চেনা ছবি। আবার, একটানা কাজ করতে করতে কেউ বেরিয়ে আসেন এক কাপ চায়ে গলাটা একটু ভিজিয়ে নিতে। তারপর হয়তো তাঁর দেখা হয়ে যায় পাশের বাড়ির সেই প্রতিবেশীর সঙ্গে। পরিচিত এই ছবিও।

আসলে, বিভাজন তো শুধু রাজনীতিতে। সখ্যে তো নয়! তাই দিব্যি জমে ওঠে আলাপচারিতাও। ভোটার কেমন আসছেন, ভোটের হাওয়া এ বার কোন দিকে বলে দাবি, কে আসতে পারে ক্ষমতায়— এ সব থেকে শুরু করে কাল রাতে হঠাৎ পাড়ার কোনও মেশোমশাইয়ের শরীর খারাপ হওয়া বা এখন তিনি কেমন আছেন সংক্রান্ত খোঁজখবর নেওয়া— বাদ পড়ে না কিছুই। চা খাওয়া শেষ হলে আবারও যে যাঁর বুথ অফিসে। যে যাঁর রাজনৈতিক পরিচয়ে বিভাজিত, আলাদা!

অফিসগুলো ঘিরে জমজমাট আড্ডাও তৈর হয় মাঝে মাঝে। তাতে অংশ নেন এ-পাড়া ও-পাড়ার লোকজন থেকে শুরু করে অফিসকর্মীদের পরিচিত মানুষজনও। ভোট কে কাকে দেবেন বা দিয়ে এলেন, তা ব্যক্তিগত বিষয়। তার জন্য আলাদা হয়ে যাওয়া শুধু ভোটগ্রহণ কেন্দ্রের মধ্যে ইভিএমের বোতাম ব্যবহারের নিভৃত নিভৃসময়টুকুতে। তা বলে বাইরেও? একেবারেই না! একটু দূরেই আরেকটা পার্টির বুথ অফিস। তার সামনে দাঁড়িয়ে সে পার্টির এক কর্মী। হঠাৎ তাঁর চোখ পড়ে, একটু দূরের বুথ অফিসটার সামনে আড্ডার দিকে। অচিরে নিজের উপস্থিতি সশব্দ জানান দেন তিনি— ‘আরে, এই যে! ভাগ্যিস, ভোটটা এল! এখন তো আর দেখাই পাওয়া যায় না!’ যাঁর উদ্দেশে বলা, হাসিমুখে তিনি এগিয়ে আসতে থাকেন বক্তার দিকে। ব্যতিক্রম থাকলেও মোটের উপর এটাই উত্তরবঙ্গের চেনা ছবি।

শুধু পুরুষই নন, মহিলারাও থাকেন বুথ অফিসে। পাড়ার এক মহিলা বসে রয়েছেন বুথ অফিসে। সামনে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন পাড়ারই এক বৌদি। তিনি কোন দলের কট্টর সমর্থক, পাড়ার সবাই সেটা জানেন। বুথ অফিসে বসে থাকা সেই মহিলা কর্মীটি খুব ভাল করেই জানেন যে, ভোটটা কোনও মতেই তাঁর দলের প্রার্থীকে দেবেন না হেঁটে আসা পাড়ার ওই মহিলা। কিন্তু তাঁকে দেখে চেঁচিয়ে ওঠেন বুথের মহিলা কর্মীটি, ‘ও বৌদি, একটা পান হবে না কি? অনেকক্ষণ খাইনি। এখান থেকে উঠতেও পারছি না! এখন একেবারে পিক আওয়ার!’ এক গাল হেসে দাঁড়িয়ে পড়েন সেই বৌদি। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে একটা পান বার করে বুথের দিকে এগিয়ে আসেন। বলেন, ‘এই নাও! তোমাদের ভোটটা দিতে না পারলেও পান দিতে কোনও অসুবিধা নেই!’ একযোগে হেসে ওঠেন দুই মহিলা।

এই সব আপাত-অকিঞ্চিৎকর ছোট ছোট ঘটনার সুতোয় সামাজিকতার মালাও গেঁথে রাখে ভোটের বুথ অফিসগুলো।

বেশ কয়েকটি নির্বাচনে বুথ অফিসে কাজ করেছেন, এমন এক রাজনৈতিক কর্মীর কথায়, ‘‘একটা ঘটনা এখনও মনে আছে। একবার বুথের সামনে ভিড় জমে যাওয়ায় এক বৃদ্ধাকে আমাদের বুথ অফিসের সামনে রিকশ থেকে নেমে যেতে হয়েছিল। তিনি ভাল করে হাঁটতে পারছিলেন না। আমি দৌড়ে গিয়ে তাঁর হাত ধরে এগিয়ে দিচ্ছিলাম। আমাদের অফিসের থেকে একটু দূরেই ছিল আরও দুই পার্টির বুথ অফিস। শেষ পর্যন্ত তিন রাজনৈতিক দলের তিন বুথ অফিসের তিন কর্মী মিলে তাঁকে পৌঁছে দিয়েছিলাম বুথে। ভোট দিয়ে ফেরার পর আমরা তিনজন মিলেই তাঁকে রিকশায় উঠিয়ে দিয়েছিলাম!’’

বুথ অফিস স্বাভাবিক ভাবেই একটার থেকে আরেকটা আলাদা। সে বুথ শহর, মফস্‌সল, গ্রাম— যেখানকারই হোক না কেন। কিন্তু এই ফারাক শুধুই রাজনৈতিক। শুধু বুথ অফিসই-বা কেন, ভোট ঘিরে যত প্রচার, মিটিং, মিছিল— সবই সেই রাজনৈতিক ফারাক। কিন্তু এই ফারাক, এ বিভাজন মোটের উপর অস্থায়ীই। সামাজিকতার প্রশ্নে গোটা উত্তরবঙ্গে আদতে কোনও বিভাজন নেই। বিক্ষিপ্ত ঘটনা, গোলমাল হচ্ছে, হয়তো হবেও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা উত্তরবঙ্গের চেনা ছবি নয়। চেনা ছবি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের নয়। সে ছবি সামাজিক মানবিকতারই।

(লেখক জলপাইগুড়ির ফুলবাড়ি হাইস্কুলের বাংলার শিক্ষক। মতামত ব্যক্তিগত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Lok Sabha Election 2019 North Bengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE