Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪

‘এমন পাজি কাজ ভূ-ভারতে আর নেই’

পঞ্চাননবাবু নিজের পরিচয় দিলে ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলেন, ‘সে কী, আপনি পুলিশ অফিসার! আমি তো ভেবেছিলাম ভদ্রলোক।’লিখছেন সুদীপ জোয়ারদার

শেষ আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০১৯ ০২:০৩
Share: Save:

প্রতিটি বুথে চাই কেন্দ্রীয় বাহিনী।’ শুধু ভোটকর্মী নয়, এ বারের লোকসভা ভোটে এমন দাবি এ রাজ্যের বহু জনতারও। রাজ্যের নিজস্ব রক্ষী বাহিনী কি তা হলে মানুষের আস্থা হারাল? প্রতিবাদী মানুষগুলোর এমন দাবির নেপথ্যে হয়তো রয়েছে গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের কিছু স্মৃতি। কিন্তু সাধারণ ভাবে বাংলার রক্ষী বাহিনীর উপর মানুষের আস্থা কোনও দিনই কি সে ভাবে ছিল? আমাদের সাহিত্যে, স্মৃতিকথায় তো অনাস্থার চিত্রই ছড়িয়ে রয়েছে নানা ভাবে।

রবীন্দ্রনাথ দিয়েই শুরু করা যাক। পঞ্চানন ঘোষাল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, লেখক হিসাবে তিনি এক বার দেখা করতে গিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে। পঞ্চানননবাবুর পুলিশ পরিচয় শুনে রবীন্দ্রনাথ তাঁকে অপরাধ জগৎ নিয়ে লিখতে বলেন এবং সেই সঙ্গে পুলিশ সম্পর্কে মন্তব্য করেন, ‘পুলিশ যদি কারুর পা-ও জড়িয়ে ধরে তো লোকে মনে করে যে পুলিশ তার জুতো জোড়াটা সরাবার মতলব করছে।’ রবীন্দ্রনাথ পঞ্চাননবাবুকে লোকের মনে করার কথা বলেছেন। নিজের মনেও কিন্তু পুলিশ সম্পর্কে উচ্চ ধারণা ছিল না। যে কারণে তাঁর লেখা উপন্যাস ‘গোরা’তে গরিব সন্তানের পক্ষে পিতামাতার শ্রাদ্ধ করাটা কতটা কঠিন সে প্রসঙ্গে উপমা দিতে গিয়ে টেনে আনেন পুলিশকে। এবং তাদের বিদ্ধও করেন কঠোর ভাবে। লেখেন, ‘যেমন ডাকাতির অপেক্ষা পুলিশ-তদন্ত গ্রামের পক্ষে গুরুতর দুর্ঘটনা, তেমনি মা–বাপের মৃত্যুর অপেক্ষা মা-বাপের শ্রাদ্ধ করাটা দুর্ভাগ্যের কারণ হইয়া উঠে।’

পুলিশ থেকে নায়ক হওয়া ধীরাজ ভট্টাচার্য তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘পুলিশের নাম শুনলেই লোকে ঘৃণায় ভ্রু কুঁচকে প্রকাশ্যে গালাগাল দিতে শুরু করে।’ আর পুলিশ-লেখক পঞ্চানন ঘোষাল শুনিয়েছেন তাঁর এ রকমই এক অভিজ্ঞতার কথা। এক বার ট্রেনে আসার সময় একটি পরিবারের সঙ্গে পঞ্চাননবাবুর ঘনিষ্ঠতা হয়। পরিবারের কর্তাটি তাঁর বালিগঞ্জের বাড়িতে পঞ্চাননবাবুকে এক বার পায়ের ধুলো দিতে বলেন। এর পরে হাওড়া স্টেশনে নামার পরে ভদ্রলোক বলেন, ‘আপনার সঙ্গে আলাপ করে ভালো লাগল। কিন্তু মশাই কী করেন তা জানা হল না।’ পঞ্চাননবাবু নিজের পরিচয় দিলে ভদ্রলোক অবাক হয়ে বলেন, ‘সে কী, আপনি পুলিশ অফিসার! আমি তো ভেবেছিলাম ভদ্রলোক।’

পুলিশের এই ‘ইমেজ’ পুলিশেরই তৈরি। আমাদের সাহিত্যে ছড়িয়ে আছে পুলিশের নানা অত্যাচার অসততার কথা। ভুবনমোহন মুখোপাধ্যায়ের ‘হরিদাসের গুপ্তকথা’র দারোগা খড়গরামকে দিয়েই শুরু করা যাক। পদ্মনগরের কেষ্টহরি ভট্টাচার্যের একমাত্র ছেলে সর্পদষ্ট হয়ে মারা গিয়েছে শুনে দারোগা খড়গরাম দলবল নিয়ে ওখানে হাজির হয়ে বলে, ‘তোদের ঘরে সাপ ছিল, তাকে তাড়াসনি, থানাতেও খবর দিসনি, ইচ্ছে করে সাপ দিয়ে কাটিয়ে ছেলেকে খুন করেছিস, ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য লাস চালান দিতে হবে। তোকে আর তোর বউকেও ছাড়ব না।’ দারোগার মুখে এমন কথা শুনে কেষ্টহরি তো তাজ্জব। এমন অভিযোগের আসল উদ্দেশ্যটি কেষ্টহরি বোঝেন একটু পরেই। এক যজমানের কাছে থেকে পাঁচটি টাকা ভিক্ষে করে নিয়ে খড়গরামকে দেন এবং ছেলের মৃতদেহ সৎকারের অনুমতি লাভ করেন।

লক্ষ্মীনারায়ণ দাশের ‘মোহন্তের এই কি কাজ’ প্রহসনে লালগোবিন নামের কনস্টেবলটি আসামীর বুকে পা দিয়ে একটি চিমটার সাহায্যে তার চুল টেনে কথা বার করার চেষ্টা করে। রবীন্দ্রনাথের ‘দুর্বুদ্ধি’ গল্প আমাদের সবারই পড়া। দারোগা ললিত চক্রবর্তী এ গল্পে পাড়াগেঁয়ে নেটিভ ডাক্তারটিকে ভিটে ছাড়া করে। অপরাধ? সে দারোগার মুখের উপর তাঁর অমানবিক আচরণ দেখে বলেছিল, ‘আপনি মানুষ না পিশাচ?’ বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘মুক্তি’ গল্পের তুলসী দারোগা আবার আর এক কাঠি সরেস। হয়কে নয় করাতে ওস্তাদ এই দারোগার চরিত্রের দোষও বিলক্ষণ। সুন্দরী গ্রাম্যবধূ নিস্তারিণীর উপর তার কুনজর পড়ে। বিভূতিভূষণের ‘ইছামতী’ উপন্যাসের দারোগা নীলকুঠীর নুন খেয়ে তাদের হয়েই কাজ করে। রামকানাই কবিরাজকে রামু বাগদি খুনের ঘটনায় মিথ্যে সাক্ষী দেওয়ার জন্য দারোগা নীলকুঠির হয়ে চাপ দেয়। এবং সফল না হয়ে নীলকুঠির দেওয়ান রাজারামকে বলে যায়, ‘দেওয়ানজি, কবিরাজ বুড়ো বড় তেঁদড়। ওকে হাত করতে হবে। ডাবের জল খাওয়ান ভালো করে।’

বঙ্কিমচন্দ্রের ‘রজনী’ উপন্যাসে মহাদেব দারোগার সঙ্গে বাঙালি পাঠকের পরিচয় অনেক আগেই হয়েছে। রজনীর বাবা হরেকৃষ্ণ দাস বাড়িতে একাকী মারা গেলে মহাদেব দারোগা দলবল নিয়ে এসে হরেকৃষ্ণ দাসের ঘরের সব কিছু হস্তগত করে। মৃত্যুকালে হরেকৃষ্ণ গোবিন্দকান্ত দত্তের কাছে কিছু অলঙ্কার রেখে গিয়েছিলেন। মহাদেব দারোগা সে খবর জানতে পেরে তাকে ডাকিয়ে এনে সেগুলোও করায়ত্ত করেন। হরেকৃষ্ণ দাসের কন্যা রয়েছে এ খবরকে মহাদেব পাত্তা না দিয়ে অলঙ্কারগুলো নিজের মেয়ের ব্যবহারের জন্য পাঠিয়ে দেয় বাড়িতে।

সাহিত্যে পুলিশের এমন চরিত্র চিত্রণ নিশ্চয়ই বানানো নয়। হুতোম অনেক আগেই তাঁর নকশায় লিখেছেন, ‘পুলিশের সার্জন দারোগা জমাদার প্রভৃতি গরিবের যমেরা রোঁদ সেরে মস্মস করে থানায় ফিরে যাচ্ছেন; সকলেরই সিকি, আধুলি পয়সা ও টাকায় ট্যাঁক ও পকেট পরিপূর্ণ।’ এ তো ঘুষের গল্প। আর অত্যাচার? ১২৮৪ বঙ্গাব্দের ৩২ জ্যৈষ্ঠ ‘বিশ্বসুহৃদ’ নামের একটি পত্রিকা খোলাখুলি লেখে, ‘এই সংসারে যত প্রকার অত্যাচার আছে, তন্মধ্যে বঙ্গীয় পুলিশের অত্যাচারই সর্বাপেক্ষা কঠোর, নিষ্ঠুর ও নৃশংস।’ নগেন্দ্রনাথ সেনের ১৮৭৩ সালে লেখা ‘নাপিতেশ্বর’ নাটকের শেষে লর্ড নর্থব্রুকের উদ্দেশে একটি প্রার্থনা আছে, ‘দোহাই তোমার লার্ড এই নিবেদন/পুলিশের অত্যাচার কর নিবারণ/…পুলিশ হয়েছে যত অনর্থের গোড়া/ছারখার কৈল দেশ যেন ঘরপোড়া।’

কম বেতন এবং এদেশীয়দের জন্য পদোন্নতির কম সুযোগ স্বাধীনতার আগে ভদ্র ও শিক্ষিত যুবকদের পুলিশের চাকরিতে খুব একটা প্রলোভিত করত না। ফলে শিক্ষাদীক্ষাহীন সুযোগসন্ধানী মানুষেরাই এই চাকরিতে ঢুকতেন। কিন্তু এখন অবস্থা পাল্টেছে। অন্য আর পাঁচটা সরকারি চাকরির মতো পুলিশের চাকরিও লোভনীয় এবং দুর্লভ। শিক্ষিত ভদ্রজনেদের পুলিশের চাকরি নিয়ে নাক সিঁটকানোর দিন আর নেই। কিন্তু তাদের অবাধ প্রবেশ সত্ত্বেও রাজের পুলিশদের সম্পর্কে সাধারণ মানুষের ধারণা তেমন উজ্জ্বল হয়নি। তাই ‘বকুল’ (নজরুল ইসলাম) এর মতো সামান্য কিছু জায়গা ছাড়া, স্বাধীনতার পরের গল্প উপন্যাসেও সেই একই পুলিশি অত্যাচারের গল্প এবং তাঁদের প্রতি মানুষের সেই চিরাচরিত অনাস্থারই কথা। এর জন্য পুলিশের নিজস্ব লোভ লালসা হয়ত কিছুটা দায়ী। কিছুটা দায়ী পুলিশের কাজের ধরনটাও। কিন্তু বেশিরভাগটাই দায়ী পুলিশের উপর নেতা উপনেতা এবং মন্ত্রীকুলের চাপ।

এ প্রসঙ্গে ‘পথের দাবী’র নিমাইবাবুর সেই কথাটা আজও প্রাসঙ্গিক। ‘বাইরে থেকে তোরা পুলিশকে যত মন্দ মনে করিস সবাই তা নয়, কিন্তু মুখ বুজে যত দুঃখ আমাদের পোহাতে হয় তা যদি জানতে তো তোমার এই দারোগা কাকাবাবুটিকে অতো ঘৃণা করতে পারতে না অপূর্ব।’

আসলে রাজা বদল হয়, কিন্তু বদলায় না শাসনের রীতি ও পথ। তাই আজও অনেকক্ষেত্রেই তাদের মুখবুজে সব সয়ে যেতে হয় আর রাগে বেদনায় নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘মহানন্দা’ উপন্যাসের দারোগা মফিজর রহমানের মতো বলতে হয়, ‘পুলিশের চাকরি, এমন পাজি কাজ ভূ-ভারতে আর নেই।’

শিক্ষক, ভগবানগোলা হাইস্কুল

তথ্যঋণ: ‘বাংলার পুলিশ’/ স্বপন বসু

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE