পাশাপাশি: কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী পদের দাবিদার এইচ ডি কুমারস্বামীকে বিএসপি নেত্রী মায়াবতীর অভিনন্দন। দিল্লি, ২১ মে। ছবি: পিটিআই
সে দিন ব্রেকফাস্টের টেবিলে এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর স্ত্রী বললেন, আপনারা মশাই ক্ষমতা রাখেন। মিডিয়া কী না পারে? জানলা দিয়ে সামনের বিস্তীর্ণ সবুজের দিকে তাকিয়ে সানি সাইড আপ ডিমের পোচে কাঁটা বসিয়ে সেই মন্ত্রী-জায়া আরও বললেন, কর্নাটকে পাশা উল্টে দিল আসলে মিডিয়া। আমি বললাম, মিডিয়াকে বাস্তবের চেয়ে বেশি ক্ষমতাবান ভাবাটা এ দেশের বহু মানুষের সাধারণ একটা ভুল। একদা এক প্রবীণ সাংবাদিক আমাকে বলেছিলেন, যে দল বা নেতা উঠছে তাকে তুমি টেনে নামাতে পারবে না। আবার যে নামছে তাকে তুমি ওপরে ওঠাতে পারবে না।
আসলে পতনোন্মুখ শক্তির পতনকে হয়তো আমরা কিঞ্চিৎ ত্বরান্বিত করতে পারি। আর যিনি উঠছেন তাঁকে ধাক্কা দিয়ে কিছুটা দ্রুত উপরে ওঠাতে পারি। ২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী যখন ভৈরব হরষে এগোচ্ছিলেন, তখন তাঁর যাত্রার ধ্বনি আমরা পাঠকের কাছে পৌঁছে দিয়েছিলাম। আবার গোরক্ষপুরের স্বভূমিতে যোগী আদিত্যনাথের যে ক্ষয়, তার পর নানা রাজ্যের উপনির্বাচনে বিজেপির দলীয় বিপর্যয়, এবং ১৫ মে দলের সদর কার্যালয়ে এসে প্রধানমন্ত্রীর তড়িঘড়ি কর্নাটক বিজয়ের সদম্ভ ঘোষণার পরও ইয়েদুরাপ্পার সরকার গঠনে ব্যর্থতা, সবই ভারতীয় রাজনীতির সাম্প্রতিক চালচিত্র। প্রকৃতির সূত্র। উত্থান যেমন সত্য তেমনই সত্য পতনও। মহাভারতের সঞ্জয়ের মতো আমরা যা হচ্ছে তা জানিয়ে চলেছি। কী রাজ্যে কী রাজধানীতে।
সেই ১৫ মে, কর্নাটকের ফল প্রকাশের দিন রাহুল গাঁধীর দ্রুত সিদ্ধান্ত: ‘আমরা সরকার গড়তে পারছি না, কিন্তু বিজেপিকে আটকাতে কুমারস্বামীকে মুখ্যমন্ত্রী করতে আমরা প্রস্তুত।’ এই একটি সিদ্ধান্ত ঘোষণা শুধু কর্নাটকে সরকার গঠন নয়, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে রাজ্যওয়ারি আঞ্চলিক দলগুলিকে এক মঞ্চে আনতে সাহায্য করল।
কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বললেন, সুপ্রিম কোর্টও একটা বড় ভূমিকা নিল সেটা মানবেন তো? পনেরো দিন সময় পেলে আমরা কিন্তু করে ফেলতাম। এতগুলো আসন পেয়েছি আমরা, আর পাঁচ-ছ’টা ম্যানেজ করা যেত না? তরমুজের সরবতটা খুব সুস্বাদু। চুমুক দিয়ে বললাম, সুপ্রিম কোর্ট কিন্তু রুল বুকের বাইরে যায়নি। আসলে ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে প্রোটেম স্পিকার মনোনয়ন নিয়েও সঙ্কোচহীন নীতিবিহর্গিত রাজনীতির নমুনা দেখে মানুষের অসন্তোষের পারদ যে ক্রমশ বাড়ছে সেটাই আপনারা বুঝছেন না। বলতে গেলেই ভাবছেন, এ সব মিডিয়ার বিজেপি-বিরোধী ষড়যন্ত্র! পৃথিবী জুড়ে গণতন্ত্রর ধীরে ধীরে মৃত্যু হচ্ছে— এ নিয়ে রাশি রাশি নিবন্ধ লেখা হচ্ছে। কিন্তু এই হতাশার পটভূমিতেও জনমতের এক অদৃশ্য শক্তি আজও আছে। ইথার তরঙ্গের মতো।
কর্নাটকে বিজেপির শেষরক্ষা না হওয়ায় সবচেয়ে বড় কী ক্ষতি মোদী এবং অমিত শাহের হল বলুন তো? আমার মনে হয় ২০১৪ সালের পর থেকে এই যে ধারণা হয়েছিল মোদী এবং অমিত শাহ, এই দ্বৈতশক্তি অপরাজেয়, অপ্রতিদ্বন্দ্বী— সেই চলতি ধারণায় এ এক মস্ত বড় ধাক্কা। মোদী জনপ্রিয় নেতা, এ কথা আজও আমি বলব দ্বিধাহীন ভাবেই। কিন্তু ২০১৪ সালের জনপ্রিয়তা যে ২০১৮ সালের শেষ বেলায় নেই, সে-ও বড় কঠিন সত্য। জিনিসপত্রের দাম কমছে না। চাকরি নেই। উন্নয়ন নেই। শিল্পায়ন অদৃশ্য। বিদেশি বিনিয়োগের হাল খারাপ। কৃষকের আত্মহত্যা চলছে। নোটবন্দি ও জিএসটির ফলে ক্ষুব্ধ দোকানদার ছোট ব্যবসায়ী। যারা বিজেপির ও জনপ্রিয় ‘বৈশ্য ভোটব্যাঙ্ক’। তা হলে কি মোদী কোনও ভাল কাজই করেননি? নিশ্চয়ই করেছেন। ক্ষমতায় এসে দ্রুত প্রকল্প রূপায়ণের চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ সরকারেও লাল ফিতের বাঁধন ভয়াবহ চেহারা নিয়েছে। মোদীর শক্তিশালী ‘হিন্দু হৃদয় সম্রাট’ ভাবমূর্তির পাশাপাশি আমরা জানতাম অমিত শাহ হলেন নরেন্দ্র মোদীর চিফ অপারেটিং অফিসার— সিওও। অমিত শাহ মানেই ইলেকশন ম্যানেজমেন্ট। তিনি হলেন এ যুগের কৌটিল্য, যেন তেন প্রকারেণ জেতাই তাঁর ধর্ম। তিনি হারতে শেখেননি। হারতে ভালবাসেন না তিনি। কর্নাটকের পরাজয় সেই গৌরবকেও ভূলুণ্ঠিত করল।
অ-বিজেপি আঞ্চলিক দলগুলি কর্নাটকের পর এই কারণেই আরও আশান্বিত হয়ে একত্রিত হবে এটাই স্বাভাবিক। তেলুগু দেশম এবং কংগ্রেসের মধ্যে বিরোধ যা-ই থাক, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং কমিউনিস্টদের মধ্যে রাজ্য স্তরে যে বিবাদই থাক, অখিলেশ ও মায়াবতীর মতোই এই রাজ্য স্তরের পরস্পরবিরোধী শক্তিগুলি মোদী হঠাও অভিযানে একত্রিত হবেই। এমনকি এখনও এনডিএ’তে থাকলেও শিবসেনা কংগ্রেস-জেডিএস জোট বেঁধে সরকার গঠনের চেষ্টাকে সমর্থন করে প্রশ্ন তোলে, গোয়ার জন্য এক রকম নির্দেশ আর কর্নাটকের জন্য রাজ্যপালের পরামর্শ অন্য রকম হবে কেন?
এ কথা বলতে পারি, ২০১৯ লোকসভা ভোট নরেন্দ্র মোদীর পক্ষে কঠিনতর হয়ে গেল। একে তো ভোটের দোরগোড়ায় দাঁড়ানো রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, ছত্তীসগঢ়ের মতো বিজেপি-শাসিত রাজ্যগুলিতে শাসক-বিরোধী জনমত এখন তীব্র। এ জন্য ওড়িশা, পশ্চিমবঙ্গর মতো রাজ্যে বিজেপি আরও আক্রমণাত্মক হয়ে আসনসংখ্যা বাড়াতে চাইছে। কিন্তু এ সব রাজ্যেও এগোতে সুবিধে হত যদি বিজেপি কর্নাটকে জয়লাভ করত। দক্ষিণ ও পূর্ব ভারতে চেষ্টা যতই করুক, কতটা সাফল্য বিজেপি পেতে পারে তা এখনও সংশায়াচ্ছন্ন।
রাহুল গাঁধীর নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা বহু আঞ্চলিক নেতার। মূল সমস্যা, আঞ্চলিক নেতারাও অনেকেই প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখেন। এ স্বপ্ন দেখায় কোনও অন্যায়ও নেই। এই নেতাদের সমস্যা রাহুল গাঁধীর সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রিত্ব নিয়ে। কর্নাটক- পরীক্ষা বুঝিয়ে দিয়েছে প্রধান বিরোধী দলের নেতা হিসাবে রাহুল গাঁধী কংগ্রেসের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হতে পারেন কিন্তু প্রয়োজনে মোদী-অমিত শাহকে আটকাতে আঞ্চলিক দলের নেতৃত্বকেও নির্দ্বিধায় মেনে নিতে প্রস্তুত। তাই রাজ্য স্তরে যদি রাহুল গাধীর প্ল্যান-বি থাকতে পারে তা হলে জাতীয় স্তরেও তা থাকবে না কেন?
আঞ্চলিক নেতারাও বুঝছেন বিজেপি মানেই অপরাজেয় নয়। বিকল্প সম্ভব। এটাও স্পষ্ট যে, কংগ্রেসকে বাদ দিয়ে শুধু আঞ্চলিক জোট করেও মোদীকে সরানো সম্ভব নয়। অবিরোধী-অকংগ্রেসি পৃথক জোট যেন বিজেপির সেফটি ভাল্ভ না হয়ে যায়। সেটা না বুঝলে বিপদ বিরোধীদেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy