Advertisement
E-Paper

আজবতন্ত্র

কেন অনেক মানুষ একসঙ্গে এমন ঘাতক হইয়া উঠে, কাহাকেও অপরাধী সন্দেহে ধরিবার পরে নিজেরাই একযোগে বিচারক এবং জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সেই প্রশ্ন বরাবর উঠিয়াছে।

শেষ আপডেট: ০৫ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:০৯
—প্রতীকী ছবি।

—প্রতীকী ছবি।

নব্বইয়ের দশকে ‘গণপিটুনির আজবতন্ত্র’ সম্পর্কে সুতীব্র ক্ষোভের গান বাঁধিয়াছিলেন কলিকাতার নাগরিক কবিয়াল। গণপিটুনি তাহার আগেও সংস্কৃতিগর্বে গর্বিত বঙ্গসমাজে বহু কাল ধরিয়া দেখা গিয়াছে। এবং তাহার দুই দশক পরেও, একবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় দশকের কাছাকাছি পৌঁছাইয়াও কেবলই সেই পৈশাচিক দৃশ্যের জন্ম হইতেছে। বৃহস্পতিবার সকালে হাওড়ায় যে যুবককে ‘চোর সন্দেহে’ বহু লোকে মিলিয়া বাঁশ, রড, লাঠি দিয়া উন্মত্তের মতো প্রহার করিয়াছে, তিনি সত্যই চুরি করিয়াছিলেন কি না তাহা তদন্তসাপেক্ষ, যে তদন্ত কোনও দিন সুসম্পন্ন হইবে বলিয়া ভরসা করা কঠিন— নাগরিক অভিজ্ঞতা তেমন ভরসা দেয় না। কিন্তু যাহারা তাঁহাকে এমন নৃশংস ভাবে মারিয়াছে, তাহারা তদন্ত, সাক্ষ্যপ্রমাণ, ইত্যাদির অপেক্ষায় ছিল না, তাহারা আইনেরও ধার ধারে নাই। গণপিটুনির নায়কদের নিকট বরাবর নিজেদের ধারণাই সাক্ষ্য, ধারণাই প্রমাণ। সুতরাং ‘মারো, মারো, মারো’।

কেন অনেক মানুষ একসঙ্গে এমন ঘাতক হইয়া উঠে, কাহাকেও অপরাধী সন্দেহে ধরিবার পরে নিজেরাই একযোগে বিচারক এবং জল্লাদের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়, সেই প্রশ্ন বরাবর উঠিয়াছে। সচরাচর তাহার যে উত্তরগুলি শোনা যায়, বৃহস্পতিবারের ঘটনাটির ক্ষেত্রেও তাহাই শোনা গিয়াছে। এই হিংস্র নৈরাজ্যের পরিচিত ব্যাখ্যা: পুলিশ প্রশাসনের উপর নাগরিকদের ভরসা নাই বলিয়াই তাঁহারা আইন নিজেদের হাতে তুলিয়া লন। ব্যাখ্যাটি অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। আইনের শাসন যাহাকে বলে, তাহা যদি যথেষ্ট জোরদার হইত, তাহা হইলে নিশ্চয়ই এত ‘স্বাভাবিক’ ভাবে মানুষ গণপিটুনিতে মাতিত না। হাওড়ার ঘটনাটিও তাহার নূতন প্রমাণ দিয়াছে— যাহারা এমন নৃশংস ভাবে যুবকটিকে প্রহার করিয়াছে, তাহাদের ছবি সমাজমাধ্যমে বহুলপ্রচারিত হওয়া সত্ত্বেও, ঘটনার অন্তত চব্বিশ ঘণ্টা পরেও এক জন দুষ্কৃতীকেও গ্রেফতার করা যায় নাই! আইনের শাসন কাজ না করিলে নৈরাজ্য কায়েম হইবে, তাহা অপ্রত্যাশিত নহে।

কিন্তু শুধু এই যুক্তি দিয়া গণপিটুনির সামাজিক ব্যাধির সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা হয় না। এই ব্যাধি সমাজের অন্তর্নিহিত হিংস্রতার পরিণামও বটে। সামাজিক হিংস্রতা নানা ভাবে অহরহ আপনাকে জাহির করিয়া চলিতেছে। গার্হস্থ্য হিংসা হইতে শুরু করিয়া রাজনৈতিক রক্তস্রোত— বিভিন্ন পরিসরেই পশ্চিমবঙ্গ এক অতি হিংস্র রাজ্য। আজ নহে, অনেক কাল। এই পরিব্যাপ্ত হিংস্রতা কী ভাবে দমন করা যায়, তাহা কঠিন প্রশ্ন, জটিল প্রশ্ন। কিন্তু তাহার উত্তর খুঁজিবার আগে প্রশ্নটিকে স্বীকার করিতে হইবে। স্বীকার করিবার দায় সমাজের, দায় প্রশাসনেরও। দুর্ভাগ্যের কথা, কেহই সেই দায় পালন করিতে উৎসাহী নহে। এমন ঘটনা আকছার ঘটে, কিন্তু কখনওই সমাজের বিশেষ কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা যায় না, এমনকী আজ আর কোনও নাগরিক কবিয়ালও এই নারকীয় আচরণ লইয়া গান বাঁধেন না। অথচ, অসীম আত্মপ্রবঞ্চনায়, এই সমাজ নিজেকে সচেতন বা সজাগ বলিয়া দাবি করে! আর, প্রশাসনের চালকরা? তাঁহারা বলেন পশ্চিমবঙ্গে হিংসার আধিপত্য লইয়া সমালোচনা আসলে অহেতুক আত্মনিন্দামাত্র, বাঙালি ভাল আছে, সুখে আছে। এমন রাজ্যে গণপিটুনির আজবতন্ত্রই কায়েম থাকিবে, তাহা আর বিচিত্র কী?

Lynching Violence Politics
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy