এ বার মালয়েশিয়া ‘পদ্মাবত’ ব্যান করে দিল। সে দেশের সেন্সর বোর্ড বলল, এতে মুসলিমদের ধর্মীয় আবেগে আঘাত লাগতে পারে। এর বেশি কিছু তারা বলেনি, কিন্তু মনে হয়, এক জন মুসলিম শাসককে খুব খারাপ মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে বলে মুসলিমদের অনুভূতি শক খাবে, ফলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধবে, মুসলিমপ্রধান দেশের সেন্সর বোর্ডের এমনটাই অনুমান। অর্থাৎ একই সিনেমা হিন্দুদের আঘাত করল, কারণ এক হিন্দু পূজনীয় নারীকে যে ভাবে দেখানো হয়েছে তা ঠিক নয় বলে অনেকের ধারণা, আবার মুসলিমদেরও আঘাত করল, কারণ মুসলিম শাসককে নিষ্ঠুর ও নারীলোলুপ হিসেবে দেখানো হয়েছে বলে সেন্সর বোর্ডের কত্তাদের ধারণা (খিলজিকে যে ভাবে দেখানো হয়েছে তা ইসলামোফোবিয়ার-ই প্রকাশ কি না তা নিয়ে অন্যত্রও বহু আলোচনা চলছে)। আবার নারীদের আঘাত করল, কারণ নারীর আত্মবিলোপকে মহিমান্বিত করা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা, কেউ মনে করেছেন এতে নারীর এতগুলি দিক থাকতে শুধু তাঁর যোনিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই খুঁটিয়ে খুঁজলে আরও অনেক গোষ্ঠীর আঘাতের উপাদান বের করা যাবে। সে-রকম পণ্ডিত হলে প্রাতরাশের আগেই অন্তত ছ’টি নীতি-বেঠিক পয়েন্ট যে কোনও শিল্প থেকে ছেনে বের করতে পারেন।
অ্যাদ্দিন কিছু বুদ্ধিমান সমঝদার ব্যক্তি যা বলে আসছিলেন, তা প্রায় খাপে-খাপ প্রমাণিত: একটা শিল্প থেকে বহু লোকই আঘাত পেতে পারেন। আঘাত পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকলে তা আরও সহজ। শিল্প কাউকে আঘাত করবে না, এ মুচলেকা দেওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়, উচিত তো নয়ই। তাই অশান্তি করতে চাইলে প্রায় সব সিনেমা নিয়েই করা যায়। এই যুগ নিজের অধিকার সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন হওয়ার যুগ। সিনেমায় প্রতিটি চরিত্রকেই কোনও না কোনও গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে বিচার করে, তাকে কেন ঠিক এ ভাবে দেখানো হল বলে রইরই লাগিয়ে দেওয়া এখন টুইটার-সই আচরণ। যদি দেখানো হয় এক দলিত অনেককে খুন করছে, দলিতদের মনে হতে পারে তাঁদের সব্বার অমর্যাদা হল। যদি দেখানো হয় এক ব্রাহ্মণ সবাইকে খুন করছে, ব্রাহ্মণদের মনে হতে পারে তাঁদের সব্বার অমর্যাদা হল। সমাধান: হয় ফিল্মে কোনও চরিত্র কোনও খুন করবে না, অথবা ছ’ফুট লম্বা শ্যামলা সাবলটার্ন উঃমাঃ পাশ পুরুষ খুন করলে, পরের সিনেই আর এক জন ছ’ফুট লম্বা শ্যামলা সাবলটার্ন উঃমাঃ পাশ পুরুষ কারও প্রাণ বাঁচাবে।
তার মানে এই নয়, ভাই বিন্দাস হও, অত সিরিয়াসলি কিছুই নিয়ো না। যদিও সত্যি বলতে কী, একটা সিনেমা নিয়ে প্রকাণ্ড গোলমাল পাকিয়ে সেটাকে আরও হিট করিয়ে দেওয়ার চেয়ে, সেটাকে অতটা পাত্তাই না দেওয়া অধিক বাস্তববোধসম্পন্ন ও পরিণতমনস্ক আচরণ বলেও ধরা যায়, আর সমাজের ওপর শিল্পের তুমুল ফুলোফাঁপো প্রভাব আছে বলেও মনে হয় না, বিশেষ করে প্রতি মুহূর্তে ষাট হাজার শিল্পের জন্ম হয়ে চলেছে যে-যুগে; কিন্তু তা বলে অন্যায়কে চিহ্নিত করা হবে না কেন? নিজের অধিকার সম্পর্কে টনটনে হয়ে থাকা এবং নিরন্তর চৌকিদারি অবশ্যই প্রশংসনীয়। বিশেষ করে প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, কারণ অতি সহজেই তাঁদের অপমান করে বেরিয়ে যাওয়া যায়। আগেকার হিন্দি ছবিতে টুনটুন যখন নায়ককে প্রেম নিবেদন করতেন, সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ত, কারণ প্রচলিত মতে, অত মোটা মানুষ নিশ্চিত ভাবেই কুৎসিত, এবং কুৎসিত মানুষের নিশ্চয়ই সুন্দর মানুষকে প্রেম নিবেদন করার অধিকার থাকতে পারে না। এখনকার যুগ হলে, পরিচালক হয়তো সহজে ছাড় পেতেন না, মানুষকে শুধুমাত্র বাহ্যিক রূপ দিয়ে বিচার করার মধ্যে যে অশালীনতা রয়েছে, তা চোখে আঙুল গিয়ে দেখানো হত। এই ধরনের সূক্ষ্ম বিচার কিছু মানুষ করে চলেছেন বলেই শিল্পচর্চা এত উদ্দীপক ও ধীপূর্ণ, আর যে মানুষ অতটা খেয়াল না করেই সব দেখছিলেন-চাখছিলেন, তাঁকে ধাক্কা মেরে জাগাতেও সমর্থ।