Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
মালয়েশিয়া ‘পদ্মাবত’ নিষিদ্ধ করল, ‘উলটো কারণ’ দেখিয়ে

বোধ ছাড়ো, ক্রোধ ধরো

অ্যাদ্দিন কিছু বুদ্ধিমান সমঝদার ব্যক্তি যা বলে আসছিলেন, তা প্রায় খাপে-খাপ প্রমাণিত: একটা শিল্প থেকে বহু লোকই আঘাত পেতে পারেন।

চন্দ্রিল ভট্টাচার্য
শেষ আপডেট: ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০০:০০
Share: Save:

এ বার মালয়েশিয়া ‘পদ্মাবত’ ব্যান করে দিল। সে দেশের সেন্সর বোর্ড বলল, এতে মুসলিমদের ধর্মীয় আবেগে আঘাত লাগতে পারে। এর বেশি কিছু তারা বলেনি, কিন্তু মনে হয়, এক জন মুসলিম শাসককে খুব খারাপ মানুষ হিসেবে দেখানো হয়েছে বলে মুসলিমদের অনুভূতি শক খাবে, ফলে দাঙ্গা-হাঙ্গামা বাধবে, মুসলিমপ্রধান দেশের সেন্সর বোর্ডের এমনটাই অনুমান। অর্থাৎ একই সিনেমা হিন্দুদের আঘাত করল, কারণ এক হিন্দু পূজনীয় নারীকে যে ভাবে দেখানো হয়েছে তা ঠিক নয় বলে অনেকের ধারণা, আবার মুসলিমদেরও আঘাত করল, কারণ মুসলিম শাসককে নিষ্ঠুর ও নারীলোলুপ হিসেবে দেখানো হয়েছে বলে সেন্সর বোর্ডের কত্তাদের ধারণা (খিলজিকে যে ভাবে দেখানো হয়েছে তা ইসলামোফোবিয়ার-ই প্রকাশ কি না তা নিয়ে অন্যত্রও বহু আলোচনা চলছে)। আবার নারীদের আঘাত করল, কারণ নারীর আত্মবিলোপকে মহিমান্বিত করা হয়েছে বলে অনেকের ধারণা, কেউ মনে করেছেন এতে নারীর এতগুলি দিক থাকতে শুধু তাঁর যোনিকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। নিশ্চয়ই খুঁটিয়ে খুঁজলে আরও অনেক গোষ্ঠীর আঘাতের উপাদান বের করা যাবে। সে-রকম পণ্ডিত হলে প্রাতরাশের আগেই অন্তত ছ’টি নীতি-বেঠিক পয়েন্ট যে কোনও শিল্প থেকে ছেনে বের করতে পারেন।

অ্যাদ্দিন কিছু বুদ্ধিমান সমঝদার ব্যক্তি যা বলে আসছিলেন, তা প্রায় খাপে-খাপ প্রমাণিত: একটা শিল্প থেকে বহু লোকই আঘাত পেতে পারেন। আঘাত পাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকলে তা আরও সহজ। শিল্প কাউকে আঘাত করবে না, এ মুচলেকা দেওয়া কারও পক্ষে সম্ভব নয়, উচিত তো নয়ই। তাই অশান্তি করতে চাইলে প্রায় সব সিনেমা নিয়েই করা যায়। এই যুগ নিজের অধিকার সম্পর্কে অতিরিক্ত সচেতন হওয়ার যুগ। সিনেমায় প্রতিটি চরিত্রকেই কোনও না কোনও গোষ্ঠীর প্রতিনিধি হিসেবে বিচার করে, তাকে কেন ঠিক এ ভাবে দেখানো হল বলে রইরই লাগিয়ে দেওয়া এখন টুইটার-সই আচরণ। যদি দেখানো হয় এক দলিত অনেককে খুন করছে, দলিতদের মনে হতে পারে তাঁদের সব্বার অমর্যাদা হল। যদি দেখানো হয় এক ব্রাহ্মণ সবাইকে খুন করছে, ব্রাহ্মণদের মনে হতে পারে তাঁদের সব্বার অমর্যাদা হল। সমাধান: হয় ফিল্মে কোনও চরিত্র কোনও খুন করবে না, অথবা ছ’ফুট লম্বা শ্যামলা সাবলটার্ন উঃমাঃ পাশ পুরুষ খুন করলে, পরের সিনেই আর এক জন ছ’ফুট লম্বা শ্যামলা সাবলটার্ন উঃমাঃ পাশ পুরুষ কারও প্রাণ বাঁচাবে।

তার মানে এই নয়, ভাই বিন্দাস হও, অত সিরিয়াসলি কিছুই নিয়ো না। যদিও সত্যি বলতে কী, একটা সিনেমা নিয়ে প্রকাণ্ড গোলমাল পাকিয়ে সেটাকে আরও হিট করিয়ে দেওয়ার চেয়ে, সেটাকে অতটা পাত্তাই না দেওয়া অধিক বাস্তববোধসম্পন্ন ও পরিণতমনস্ক আচরণ বলেও ধরা যায়, আর সমাজের ওপর শিল্পের তুমুল ফুলোফাঁপো প্রভাব আছে বলেও মনে হয় না, বিশেষ করে প্রতি মুহূর্তে ষাট হাজার শিল্পের জন্ম হয়ে চলেছে যে-যুগে; কিন্তু তা বলে অন্যায়কে চিহ্নিত করা হবে না কেন? নিজের অধিকার সম্পর্কে টনটনে হয়ে থাকা এবং নিরন্তর চৌকিদারি অবশ্যই প্রশংসনীয়। বিশেষ করে প্রান্তিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে, কারণ অতি সহজেই তাঁদের অপমান করে বেরিয়ে যাওয়া যায়। আগেকার হিন্দি ছবিতে টুনটুন যখন নায়ককে প্রেম নিবেদন করতেন, সবাই হেসে গড়িয়ে পড়ত, কারণ প্রচলিত মতে, অত মোটা মানুষ নিশ্চিত ভাবেই কুৎসিত, এবং কুৎসিত মানুষের নিশ্চয়ই সুন্দর মানুষকে প্রেম নিবেদন করার অধিকার থাকতে পারে না। এখনকার যুগ হলে, পরিচালক হয়তো সহজে ছাড় পেতেন না, মানুষকে শুধুমাত্র বাহ্যিক রূপ দিয়ে বিচার করার মধ্যে যে অশালীনতা রয়েছে, তা চোখে আঙুল গিয়ে দেখানো হত। এই ধরনের সূক্ষ্ম বিচার কিছু মানুষ করে চলেছেন বলেই শিল্পচর্চা এত উদ্দীপক ও ধীপূর্ণ, আর যে মানুষ অতটা খেয়াল না করেই সব দেখছিলেন-চাখছিলেন, তাঁকে ধাক্কা মেরে জাগাতেও সমর্থ।

মুশকিল হল, আতস কাচ নিয়ে ঝুঁকে পড়তে পড়তে অনেক সময় নাকটা একটা অংশে এমন প্রাণপণ চিপ্‌কে যায়, সমগ্রটা একেবারে হিসেবের বাইরে চলে যায়। গোটা ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’ ছবিতে একটিও নারীচরিত্র নেই কেন (দুধুভাতু দু’জন আছেন, যাঁদের শুধুমাত্র ‘পুরুষের প্রাইজ’ হিসেবে দেখানো হয়েছে, আর ‘রাজকন্যা কি কম পড়িতেছে?’ সংলাপে তো ব্যবহারবস্তুর সঙ্গে তাঁদের তুলনা স্পষ্ট) এই নারা তুলে হুলুস্থুলু বাধিয়ে দেওয়া যায় নির্ঘাত। তা খুব আকর্ষক তর্কেরও জন্ম দিতে পারে, এবং তা থেকে ফিল্মটার একটা দিক বা প্রবণতা উন্মোচিতও হতে পারে, কিন্তু শুধুমাত্র সেটায় নিবিষ্ট হয়ে পড়লে, অমন চমৎকার একটা ছবি অণুদর্শনের শিকার হয়ে পড়ে। ফিল্মটার মূল রসটাকে অস্বীকার করে, পূর্ণ ঝলমলেপনাটাকে দূরে ঠেলে দিয়ে, তার অ-প্রধান ণত্বষত্ব নিয়ে ঘোটালা পাকাবার নেশায় এমন ঝঞ্ঝাট ঘটে, যা
ছবি-বোঝাটাকেই অপমান করে একটা স্তরের পর। এখন যেন এই খণ্ডব্রতীদের রমরমা বেড়েছে। এরা কেউ চমকদার কথা বলার বেপরোয়া তাগিদে, কষ্টকল্পনা প্লাস ঝাপসাবাজি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কেউ লাঠির ব্যাকরণে, বিশ্লেষণ শিকেয় তুলে, অশিক্ষা বগলে তেড়ে আসছে। উভয়েরই ভেতর ফোঁসফোঁস করছে বেধড়ক ক্রোধ।

এত রাগ কিসের, রাস্তাঘাটে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় সকলেই রোজ এত ঝাঁঝিয়ে উঠছে কেন ও এই পরিমাণ গালাগাল না আছড়ালে তাদের ভাত হজম হচ্ছে না কেন, তা নিয়ে নিশ্চয়ই গবেষণা হতে পারে। এক বিশ্বখ্যাত তথ্যচিত্রে দেখানো হয়েছিল, একই সংখ্যক ইঁদুরকে যদি বিরাট খাঁচায় রাখা হয়, যেখানে প্রত্যেকের অনেকটা করে জায়গা, হাত পা ছড়িয়ে থাকার, খেলার; আর যদি ছোট্ট খাঁচায় রাখা হয়, যেখানে সাংঘাতিক গা-ঘেঁষাঘেঁষি ও ঘষাঘষি— তা হলে ছোট খাঁচার ইঁদুররা অচিরে কামড়াকামড়ি শুরু করে, বড় খাঁচার ইঁদুররা বন্ধুত্বপূর্ণ ভাবে জীবন কাটায়। কে বলতে পারে, ভিড়ের ঠেলায় কনুই পাঁজরায় গেঁথে যাচ্ছে বলেই আমরা এত খেঁকুরে কি না। এমন মতও থাকতে পারে, বহু সরকার অসহিষ্ণুতাকে সমর্থন করছে বলেই দেশগুলো অসহিষ্ণু হচ্ছে। তবে বড় কথা হল, রেগে উঠে অশান্তি করলে সহজে মনোযোগ টানা যায়। করণী সেনা যে জন্য এত খেপে উঠল। তাদের অস্তিত্বই কেউ জানত না, হঠাৎ ভাঙচুর গুন্ডামির চোটে চমকে গোটা দেশ নাম জপতে লাগল। আবার করণী সেনার ওপর যারা হালুম-খেপে উঠল, তারাও সব্বাই শিল্পের নিঃশর্ত স্বাধীনতায় বিশ্বাসী, বা সাংঘাতিক মৌলবাদ-বিরোধী, না-ও হতে পারে। হয়তো তাদের মধ্যে কেউ কেউ কষেছে: এটা বেশ নিরাপদ বিদ্রোহ, এই মুহূর্তে প্রগতিশীলদের ‘গুড বুক’-এ থাকার বিপ্লবও। অনেক সময় দেখা যায়, পশ্চিমবাংলায় থেকে বিজেপি-মার্কা ব্যাপারকে থুড়ে দেওয়া ঝুঁকিহীন অথচ গ্ল্যামারাস, আবার অনেক সময় দেখা যায় নারীবাদী হ্যাশট্যাগ এমন পতপতিয়ে উড়ছে যে সেই থিমে গাল পাড়তে পাড়তে রাগের কামরায় চড়ে পড়াটা চট-গ্রহণযোগ্য হয়ে ওঠার নিশ্চিত পদ্ধতি।

অবশ্য আসল (এবং ছ’কোটি বার বলা হয়ে যাওয়া) কথা স্রেফ এই: যত খুশি রেগে ওঠা যাবে, প্রতিবাদ জানানোও যাবে, কিন্তু হিংস্র আচরণ করা যাবে না। লেখো, চেঁচাও, কিন্তু বাস পুড়িয়ো না, কাচ ভেঙো না, মাথায় রড মেরো না। আর, পার্টিজান পোজিশনের উগ্র ঢাল বেয়ে গড়াতে গড়াতে, এবং ভিড়ের হাততালির ওম পোয়াবার লোভে, লক্ষ্যের প্রতি এমন ধর্ষকামী ইতর ছোবল হেনো না, যে, তুমি তোমার নিন্দাবস্তুর সমান অসঙ্গত হয়ে উঠলে।

তবে সর্বাধিক আসল কথা: মোদীর এখুনি মালয়েশিয়া গিয়ে উদ্দাম গলা-জড়াজড়ি উচিত। ভারত তবু ছবিটা দেখাতে দিয়েছে, এবং সরকার থেকে অশান্তিকে সরাসরি সমর্থন করে বিবৃতি দেওয়া হয়নি, ওই দেশ এ-সব সভ্য হাবভাবের ধার না ধেরে, ‘মানুষ দেখে নিজেরা বিচার করুক’-কে ম্যাপের ও-পারে উড়িয়ে দিয়ে, ছবিটাকে একেবারে দড়াম নিষিদ্ধ করে দিল। ভারতও আধা-গণতান্ত্রিক উঠোনে কিতকিত না খেলে, ঘোমটার তলায় বোমটা না বেঁধে, মালয়েশিয়ার সঙ্গে সাংস্কৃতিক মিলমিশ করে, বাজখাঁই স্বৈরতন্ত্রী বোর্ড গড়ুক, পহলাজ নিহলানিকে ফেরত আনুক, ডাইনে-বাঁয়ে ছবি ব্যান করে পেকো শিল্পীদের কান মুলে দিক। মালয়েশিয়ায় সেন্সর বোর্ড যা বলে, কেউ তা উলটে দিতে পারে না। কোর্টও না। এ দেশের সুদৃঢ় সংস্কৃতি-গার্জেনদের এই মিলিটারি জোশ-ই আমদানি করতে হবে, প্রসূন জোশীকে দিয়ে হবে না।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE