Advertisement
E-Paper

মল্লভূমের রামায়ণ-প্রীতি

মল্লভূমে প্রাপ্ত পুথিপত্রের মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত ও নানা পালার পুথির সংখ্যা প্রচুর, তবে রামায়ণের পুথির সংখ্যাই সবথেকে বেশি। শুধু শঙ্কর কবিচন্দ্র, জগদ্রাম, রামপ্রসাদের রামায়ণ নয়, বহু পালাকার রামায়ণের নানা পালা রচনা করে গিয়েছেন। লিখছেন নবগোপাল রায় মল্লভূমে প্রাপ্ত পুথিপত্রের মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত ও নানা পালার পুথির সংখ্যা প্রচুর, তবে রামায়ণের পুথির সংখ্যাই সবথেকে বেশি। শুধু শঙ্কর কবিচন্দ্র, জগদ্রাম, রামপ্রসাদের রামায়ণ নয়, বহু পালাকার রামায়ণের নানা পালা রচনা করে গিয়েছেন।

শেষ আপডেট: ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০১:১৭
 মল্লভূমে প্রাপ্ত পুথিগুলির একটি। ছবি: লেখক

মল্লভূমে প্রাপ্ত পুথিগুলির একটি। ছবি: লেখক

বাংলার ঘরে ঘরে হলদে কাগজের বান্ডিল লালচে-কালো হয়ে গিয়েছে, চারধারে একটু করে ক্ষয়েও গিয়েছে। কোনওটার উপরে থাকা কাঠও কিছুটা ভেঙে কাগজ থেকে খসে গিয়েছে। খুব যত্ন করে ধরতে হয়, কিন্তু খুলতে অনেকেই সাহস করতেন না। কাগজগুলো সাবধানে না ধরলে ছিঁড়ে যায়। আড়াআড়ি করে লেখা এই কাগজে কালির কলমে হাতে লেখা আছে দূর অতীতের ধর্মকথা।

সেই কবে, ইংরেজদের বাংলা শেখানোর জন্য হ্যালহেড সাহেব (ন্যাথানিয়েল ব্রাসি হ্যালহেড) ব্যাকরণ (১৭৭৮) লিখে বসলেন। বাংলার উদাহরণ হিসেবে তুলে আনলেন এ ধরনের বিভিন্ন পুথির পঙ‌্ক্তি। যাতে বাংলা সাহিত্যের উদাহরণ দেওয়া যায়, একই সঙ্গে এই সংস্কৃতির সঙ্গেও পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায় নব্যশিক্ষিত তথা ব্যবসা করতে আসা ইংরেজ জনতাকে।

সুষ্ঠু সংরক্ষণের অভাবে বিরল এই পুথি-সম্পদ নষ্ট হয়েছে অনেকদিন ধরেই। জলে, আগুনে,অযত্নে বা চুরি করেও নিয়ে গেছেন অনেকে। এগুলিকেই আকর করে ধরেছিলেন বিদেশিরা। বাঙালির এই ইতিহাস-অস্বীকারের দিকটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন ইংরেজ মিশনারিরা। হ্যালহেড সাহেবের ব্যাকরণ ছাপার বহু আগে থেকেই ইউরোপীয় বিদ্বজন বাংলার গ্রামে ঘরে থাকা এই পুথি সংগ্রহ করে প্রাচ্য ভাষা-সাহিত্য-সমাজের চর্চা শুরু করে দিয়েছিলেন।

রামায়ণের প্রাপ্ত পুথির সংখ্যা দেখে নিশ্চয় আগ্রহ বেড়েছিল, তাই রামায়ণের সম্পূর্ণ পুথি প্রথম মুদ্রণসৌভাগ্য লাভ করল সেই ইংরেজদের হাত ধরেই। হ্যালহেডের গ্রন্থে নানাগ্রন্থের পঙ্‌ক্তি উদ্ধৃত হলেও, উইলিয়ম কেরির উদ্যোগে পাঁচ খণ্ডের রামায়ণ প্রকাশ পেল। পরবর্তী বটতলা থেকে মুদ্রিত রামায়ণ বাজার ছেয়ে ফেলল। কিন্তু সবই যে আসল রচনা এ কথা নিশ্চিত করে বলা যায় না। সারা বাংলাতেই রামায়ণ রচনা ও রামায়ণ গানের পালাটি বেশ পরিপুষ্ট হয়ে উঠেছিল। কিন্তু কলকাতা শহরের থেকে প্রকাশিত রামায়ণ কাব্য তালিকায় মল্লভূমের কবিরা ব্রাত্যই রয়ে গেলেন। অথচ, অনেকেই দাবি করে বসেন, রামায়ণের সেনানীরা রাঢ়বঙ্গের এই পথ ধরেই এগিয়েছিলেন, চুপিসাড়ে গ্রাম-নামে অযোধ্যার ব্যবহার এই রাম-প্রীতিকেই মনে করিয়ে দেয় বোধ করি।

প্রাচীন বাংলার পাঁচটি ভূমের অন্যতম মল্লভূম। এই ভূমের অধীশ্বর ছিলেন মল্লরাজারা। স্থাপিত হয় বিভিন্ন মন্দির, পুরাকীর্তি, রচিত হয় বিভিন্ন সাহিত্যকীর্তি। মল্লভূমে কিন্তু একটি বলিষ্ঠ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য চলে আসছিল বীর হাম্বিরের সময় থেকেই, পরবর্তী মল্লরাজাগণ ও রাজ্যের মানুষজন সংস্কৃতির এই ধারাটিকে বয়ে নিয়ে চলেন। মল্লভূমে সাহিত্য-সংস্কৃতি যে কতটা বিস্তার লাভ করেছিল, তার প্রমাণ আমরা পাই মল্লভূমে প্রাপ্ত পুথির প্রাচুর্য দেখে। মল্লভূমে প্রাপ্ত পুথিপত্রের মধ্যে রামায়ণ, মহাভারত ও নানা পালার পুথির সংখ্যা প্রচুর, তবে রামায়ণের পুথির সংখ্যাই সবথেকে বেশি। শুধু শঙ্কর কবিচন্দ্র, জগদ্রাম, রামপ্রসাদের রামায়ণ নয়, বহু পালাকার রামায়ণের নানা পালা রচনা করে গিয়েছেন। কিন্তু বঙ্গ সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দুর্ভাগ্যের বিষয় মল্লভূমে রচিত রামায়ণের প্রতি যথার্থ আলোকপাত হয়নি। পানুয়া নিবাসী শঙ্করকবিচন্দ্র, যার গ্রন্থ ‘বিষ্ণুপুরীরামায়ণ’ নামে বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। এ ছাড়া, কবিচন্দ্রের ভণিতাযুক্ত রামায়ণের অনেকগুলি পালা বিভিন্ন পুথিশালাতে আছে। ভুলুইগ্রামের জগদ্রাম রায় রচনা করেন নবম খণ্ডের আধ্যাত্ম রামায়ণ। দ্বিজ সাফল্যরাম, দ্বিজ ধনঞ্জয়, দ্বিজ সীতাসুত, খোশলশর্মা, দ্বিজ দর্পনারায়ণ, ভিখন শুক্ল দাস, দ্বিজ নিধিরাম প্রমুখ কবির ভণিতায় প্রভূত রামায়ণ রচনার ধারাটি পাওয়া যায়।

মল্লরাজাদের যখন বহিঃশত্রুর আক্রমণের ভয় যখন থাকল না, তখন তাঁরা পেলেন প্রচুর অবকাশ৷ এই অবকাশ তাঁরা উৎসর্গ করেছিলেন মল্লভূমের সাহিত্য ও সংস্কৃতির শ্রীবৃদ্ধিতে৷ একই সঙ্গে প্রজা মনোরঞ্জন, পাশাপাশি, শান্তভূমির পরিবেশে গান শোনার ইচ্ছাটাও রাজাদের কম ছিল না বোধ হয়। বৈষ্ণব আচার্য শ্রীনিবাসের আগমনে মল্লরাজা ও তাঁর সঙ্গে জনসাধারণের মধ্যে বৈষ্ণবধর্মের গভীর প্রভাব সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে নতুন দৃষ্টিভঙ্গির উন্মোচন করেছিল৷

এক দিন যে জনজাতি ছিল সবার অলক্ষ্যে, প্রান্তিক সেই জনজাতি তার সীমানার বেড়া অতিক্রম করে বাংলা তথা ভারতের বৃহত্তর জনসমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে যোগাযোগ করতে পেরেছিল৷ অনিবার্য ভাবেই তাই রাঢ়ের এই প্রত্যন্তভূমের সাহিত্যধারাতে প্রবেশ ঘটেছিল অনুবাদ সাহিত্যের। শুধু রামায়ণ নয়, সঙ্গে মহাভারত অনুবাদের ধারাটিও চলেছিল রাজসভার বাইরেও। বৃহত্তর মল্লভূমের জনসমাজে সর্বস্তরে এই প্রভাব পড়েছিল৷ সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় তাঁর ‘ভারতসংস্কৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন, ‘আমাদের বাঙালীদের এই হিসাবে দুর্ভাগ্য-কাশী বা মাদুরা, জয়পুর বা আগরার মত কলা নগরী বাংলাদেশে গড়িয়া উঠিল না৷ এইরূপ একটি মাত্র নগরী সারা বাংলাদেশের মধ্যে দেখা যায়, সেটি হইতেছে বিষ্ণুপুর, বিষ্ণুপুরের প্রাচীন মন্দিরে ও নানাবিধ শিল্পকার্যে বাংলাদেশের সমস্ত নগরগুলির শীর্ষস্থানীয়৷ কিন্তু বিষ্ণুপুরকে বাঙালী জনসাধারণ চিনিল না, আদর করিতে শিখিল না৷’’ বাঙালির এই আদর না শিখতে পারার আক্ষেপটি থেকেই গেল, অতীতের ধূলি-ধূসর পাতা ঘেঁটে মল্লভূমের রামায়ণী কথা পড়বে কে? মাছরাঙার ছোঁ, তার গায়ের রঙের কথা, মণ্ডুক অর্থাৎ ব্যাঙের ছয় মাস যোগধ্যানে চুপচাপ থাকার কথা, সেতুবন্ধনে কাঠবেড়ালির কাজে তুষ্ট হয়ে রামচন্দ্রের বর প্রদান ও কাঠবেড়ালির গায়ের উপর রামের আঙুলের দাগ, মন্দোদরীর কাছ থেকে রাবণের মৃত্যুবাণ হরণ— এই উপকাহিনিগুলি আজও মল্লভূমের মানুষের গল্প কাহিনিতে প্রবহমান, যা একান্ত ভাবেই মল্লভূমের লোককাহিনি সর্বসাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছিল৷ এগুলির উৎস আধ্যাত্ম রামায়ণ বা অন্য কোন কাব্য হলেও মল্লভূমের মানুষের কাছে এই সব কাহিনি জনপ্রিয় হয়েছিল মল্লভূমে রচিত রামায়ণের পালাগুলির মাধ্যমেই৷ লোকমানসের কল্পনাকে প্রশ্রয় দিয়েই মল্লভূমের রামায়ণ পালার যাত্রা।

লেখক সিধো-কানহো-বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলার শিক্ষক

Manuscript Ramayan
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy