Advertisement
২৫ এপ্রিল ২০২৪
সম্পাদকীয় ২

সরণি দ্বিধা হও

হিজিবিজ্‌বিজ‌্‌ যে লোকটির গল্প বলিয়াছিল, তাহার মাথার ব্যারাম ছিল, ফলে সে সব কিছুর নামকরণ করিত। ভাগ্যিস সে আমলে কেহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শোনে নাই। কে বলিতে পারে, হয়তো সুকুমার রায়ের বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা দায়ের হইত। অভিযোগ উঠিত, তিনি বঙ্গেশ্বরীকে নকল করিয়াই সেই চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছিলেন, যে গাড়ুর নাম দিত পরমকল্যাণবরেষু।

শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৬ ০০:৪০
Share: Save:

হিজিবিজ্‌বিজ‌্‌ যে লোকটির গল্প বলিয়াছিল, তাহার মাথার ব্যারাম ছিল, ফলে সে সব কিছুর নামকরণ করিত। ভাগ্যিস সে আমলে কেহ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম শোনে নাই। কে বলিতে পারে, হয়তো সুকুমার রায়ের বিরুদ্ধে মানহানির মোকদ্দমা দায়ের হইত। অভিযোগ উঠিত, তিনি বঙ্গেশ্বরীকে নকল করিয়াই সেই চরিত্র সৃষ্টি করিয়াছিলেন, যে গাড়ুর নাম দিত পরমকল্যাণবরেষু। তাহার পর কী হইত, জানে শ্যামলাল, মতান্তরে অম্বিকেশ মহাপাত্র। মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী কেন নামকরণ করিতে ভালবাসেন, সেই কারণ সন্ধানের প্রয়োজন নাই। তিনি মেট্রো স্টেশনের নাম দেন মহানায়ক উত্তমকুমার, জলের ট্যাঙ্ককে ডাকেন রামকৃষ্ণ পরমহংস। তাঁহার ফ্লাইওভারের নাম মা, অফিসের নাম নবান্ন, ট্রেনের নাম দুরন্ত (এবং সাঁওতাল বিদ্রোহের নায়কের নাম ডহরবাবু)। বলিতেই হইবে, তাঁহার নজর উঁচু। যতই দলের কাজে আসুন, এখনও অবধি কোনও বাস স্ট্যান্ড অথবা ফুচকার গাড়ির নাম তিনি অনুব্রত বা আরাবুল দেন নাই। শিশুপাঠ্য জীবনীগ্রন্থে নাম না ওঠা পর্যন্ত তাঁহার নামকরণের তালিকায় ঠাঁই পাওয়া মুশকিল।

সত্যজিৎ রায় বাদ পড়িয়াছিলেন। কিন্তু, হিন্দিতে বলে, ‘দের আয়ে, দুরস্ত আয়ে’। মুখ্যমন্ত্রী লি রোডের নাম বদলাইয়া করিয়া দিলেন ‘সত্যজিৎ রায় ধরণী’। দেরির ক্ষতিপূরণ, সম্ভবত। বঙ্গেশ্বরী অবশ্য মুখে বলিয়াছেন, সরণি অনেক হইয়াছে, এই বার ধরণী হউক। মোক্ষম। মগনলাল মেঘরাজ থাকিলে হাঁকিতেন, ‘নাজুক’। বিশ্ব জুড়িয়া যাঁহার খ্যাতি, তাঁহার জন্য ধরণীই প্রযোজ্য, সরণিতে তাঁহাকে সম্ভবত যথেষ্ট স্মরণ করা যায় না। দুর্জনে মুখ্যমন্ত্রীর এই নামকরণ দেখিয়া হাসিতেছে। কোনও নিন্দক বলিতেছেন, তিনি অর্থ না বুঝিয়াই শুধু অন্ত্যমিলের খাতিরে এমন নাম রাখিয়া বসিলেন। কেহ ‘হীরক রাজার দেশে’-র প্রসঙ্গ টানিতেছেন। কিন্তু, যাঁহারা মুখ্যমন্ত্রীর খুঁত ধরিতে ব্যস্ত, তাঁহারা বুঝিলেন না, এই নামকরণ আসলে এক দার্শনিক প্রজ্ঞার চুটকি-প্রকাশ। গণেশ যখন মায়ের চারিপার্শ্বে ঘুরিয়াই বিশ্বভ্রমণ সম্পূর্ণ করিবার দাবি করিয়াছিলেন, তাহা কি মিথ্যা ছিল? ধরণী বলিতে কি শুধু সাড়ে ছয় হাজার কিলোমিটার ব্যাসার্ধবিশিষ্ট গোলকটিকেই বুঝায়? এই সিদ্ধান্তে মুখ্যমন্ত্রী বুঝাইয়া দিলেন, ক্ষমতা তাঁহার মাথাটি ঘুরাইয়া দেয় নাই। তিনি ধরাকে সরা নহে, বরং সরণিকে ধরা জ্ঞান করিতেছেন।

বৃহত্তর অর্থে, তিনি একটি জেহাদ আরম্ভ করিয়াছেন। হাস্যরসের বিরুদ্ধে জেহাদ। ব্যঙ্গচিত্র আঁকিবার শর্তই হইল, প্রকৃত ছবিটির কোনও একটি বৈশিষ্ট্যকে অস্বাভাবিক মাত্রায় বাড়াইয়া তোলা, যাহাতে হাস্যরসের উদ্রেক হয়। মুখ্যমন্ত্রী ব্যঙ্গচিত্র দেখিয়া হাসিবার বদলে পুলিশ লেলাইয়া দেন বটে, কিন্তু তাহার শৈলীটি বিলক্ষণ রপ্ত করিয়া লইয়াছেন। হাস্যরসের কারবারিরা পেশাদারি তাগিদে বাস্তবকে যে ভাবে দুমড়াইয়া উপস্থাপিত করেন, মুখ্যমন্ত্রী স্বভাবতই তাহা করিয়া থাকেন। ফলে, তাঁহার জমানায় কৌতুকশিল্পীদের ঘোর বিপদ। তাঁহারা মুখ্যমন্ত্রীর ব্যঙ্গচিত্র হিসাবে যাহা পেশ করিতে পারিতেন, মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং বাস্তবেই তাহার অধিক করিয়া রাখেন। ফলে, এই জমানায় বাস্তবই ব্যঙ্গচিত্রের তুলনায় হাস্যকরতর। মুখ্যমন্ত্রীর অভিধানে ‘অসম্ভব’ শব্দটি নাই। তিনি সবই পারেন। তিনি ধর্ষণকে ‘সাজানো’ বলিতে পারেন, তেলেভাজাকে ‘শিল্প’ বলিতে পারেন, বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সীমান্ত বলিতে পারেন। রাস্তার নাম ধরণী রাখা তো তুশ্চু।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

satyajit ray dharani mamata bandopadhay
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE