ঠিক যেন ছেলেবেলার স্কুলের ক্লাসঘর। বাড়ির পড়া না করিয়া আসা দুই ছাত্র ধরা পড়িয়া গেল শিক্ষিকার হাতে। তাহার পর? তিরস্কার। লেখাপড়া করিয়া ক্লাসে আসিবার মর্মে ধমক। ফারাক শুধু এইটুকুই, যে দুই জন ধরা পড়িলেন, তাঁহাদের ছাত্রবেলা কাটিয়াছে বেশ কয়েক দশক পূর্বেই। এখন তাঁহারা রাজ্যের মন্ত্রী। ধরা পড়িলেন যাঁহার হাতে, তিনি মুখ্যমন্ত্রী। আর ঘটনাটি ক্লাসরুমে নহে, ঘটিল বিধানসভায়। পলাশির সৌন্দর্যায়নে রাজ্য সরকার কী করিতেছে, পর্যটনমন্ত্রীর জানা ছিল না। তিনি ‘ভাবিয়া দেখিতে হইবে’ বলিয়া পাশ কাটাইবার চেষ্টা করিয়া মুখ্যমন্ত্রীর ধমক খাইয়াছেন। আর বনমন্ত্রী বিজয় বর্মন ধরা পড়িয়াছেন এক প্রশ্নের জবাবে অন্য উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করিতে গিয়া— ছাত্ররা যাহাকে ‘গরুর রচনা’ হিসাবে জানে। বনাঞ্চলে গাছ কাটা ঠেকাইতে কী ব্যবস্থা লওয়া হইতেছে, বনমন্ত্রী জানিতেন না। ঘটনাক্রমে, দুইটি প্রশ্নের উত্তরই মুখ্যমন্ত্রীর নিকট ছিল। না-ই থাকিতে পারিত— প্রতিটি দফতরের খুঁটিনাটি খবর রাখা মুখ্যমন্ত্রীর কাজ নহে, তাহার জন্যই বিভাগীয় মন্ত্রীরা আছেন। কিন্তু, মন্ত্রীরা নহেন, উত্তরগুলি দিলেন মুখ্যমন্ত্রী। সংশ্লিষ্ট দুই জন, এবং অন্য মন্ত্রীরাও, কোনও শিক্ষা গ্রহণ করিলেন কি? মন্ত্রী হওয়া যে রাজনৈতিক সাফল্যের পুরস্কার নহে, বরং একটি বড় দায়িত্ব, এই প্রাথমিক কথাটি কি তাঁহারা বুঝিয়া লইলেন? না কি, প্রধান শিক্ষিকার তরফে নজরদারি ও তিরস্কার চালাইয়া যাওয়াই বিধেয়?
এই দুই মন্ত্রী কি ব্যতিক্রমী? না কি, আরও এমন মন্ত্রী আছেন, দফতরের কাজ বিষয়ে প্রশ্ন আসিলে যাঁহারা একই রকম খাবি খাইবেন? হাঁড়ির চাল টিপিবার উপমা ব্যবহার করিলে একটি উত্তর পাওয়া যায়। কিন্তু, জল্পনা থাকুক। মন্ত্রীদের দায়িত্বের কথা এই প্রসঙ্গে আরও এক বার স্মরণ করাইয়া দেওয়া যাউক। পার্থ চট্টোপাধ্যায় নির্ঘাত দ্বিমত হইবেন, কিন্তু মন্ত্রীদের কাজ দখলদারি করা নহে। তাঁহারা নীতি নির্ধারক। তাহার জন্য নিজস্ব দফতরের প্রতিটি বিষয় তাঁহাদের জানা থাকা বিধেয়। মন্ত্রীকে সহায়তা করিবার জন্যই সচিবরা আছেন, গোটা দফতর আছে। কিন্তু, মন্ত্রীকে জানিতে হইবে। কোনও একটি নীতি নির্ধারণ করিবার সময় শেষ মুহূর্তের জানা নহে, খবর রাখিবার কাজটি সব সময়ই করিয়া চলিতে হইবে। নচেৎ, ঠিক কোথায় সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন, তাহা বুঝিয়া উঠা অসম্ভব হইবে। এবং, কোনও উত্তর জানা না থাকিলে তাহা স্বীকার করিবার সাহসও থাকা প্রয়োজন, যেমন থাকা প্রয়োজন জানিয়া লওয়ার তাগিদটিও। গৌতমবাবু তবুও এক রকম ভাবে স্বীকার করিয়াছিলেন যে প্রশ্নটির উত্তর তিনি জানেন না। বিজয়বাবু অন্য কথায় নিজের অজ্ঞানতা ঢাকিতে চেষ্টা করিতেছিলেন। কাজটি মারাত্মক। কোন দফতর কেমন ভাবে চলিবে, তাহা বহুলাংশে নির্ভর করে দফতরের শীর্ষ কর্তার উপর। স্বয়ং মন্ত্রীই যদি খবর না রাখেন, তবে সেই শিথিলতা গোটা দফতরের শিরা-উপশিরায় ছড়াইয়া যায়। তাহার ফল, কাজের গয়ংগচ্ছ ভঙ্গি। অধিকাংশ সরকারি কাজই যে ভাবে হয়। ছবিটির বদল প্রয়োজন। মুখ্যমন্ত্রী পথ দেখাইয়াছেন। তিনি ভর্ৎসনা করিয়া জানিতে চাহিয়াছেন, তিনি প্রশ্ন করিলেও মন্ত্রীরা এমন দায়সারা উত্তর দিতেন কি না? কিন্তু, সাধারণ মানুষ প্রশ্ন করিলে মন্ত্রীরা কী উত্তর দিবেন, এ ক্ষেত্রে তাহাই বিবেচ্য হওয়ার কথা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy