সার্থক: অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ ফাইনাল উপলক্ষে কেন্দ্র ও রাজ্যের ক্রীড়ামন্ত্রী, রাজ্য অর্থমন্ত্রী প্রমুখের সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। অক্টোবর ’১৭
ঠাট্টা হলেও সত্যি! শনিবার সন্ধ্যার যুবভারতী স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপ ফুটবল ফাইনালের আসর তখন জমজমাট। গ্যালারি কানায় কানায় পূর্ণ। চোখ-ধাঁধানো আয়োজনে মুগ্ধ সবাই। ফিফার কর্তা থেকে শুরু করে দেশি-বিদেশি অতিথি, অভ্যাগতেরা সকলেই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। এমন সময় একটি চিমটি দিলেন প্রফুল্ল পটেল।
রাজনীতির পাকা খেলোয়াড় প্রফুল্ল তখনও ভারতীয় ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি (আদালতের নির্দেশে সদ্য ‘অপসারিত’)। যুবভারতীর দিকে তাকিয়ে পাশে দাঁড়ানো কেন্দ্রীয় ক্রীড়ামন্ত্রী রাজ্যবর্ধন রাঠৌরকে তিনি বললেন, ‘‘কী করছ তোমরা! দিল্লির নেহরু স্টেডিয়ামে একটু নজর দাও!! হালটা একটু বদলাও!’’ সেখানেই ছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে দেখিয়ে রাঠৌরের স্বতঃস্ফূর্ত জবাব: ‘‘দিদির হাতে পড়লেই সব হয়ে যাবে!’’ হেসে উঠলেন তিন জনই।
রাজনীতিতে রাজ্যবর্ধন এখনও বাকি দু’জনের তুলনায় অপরিণত। তাঁর ওই রসিক মন্তব্যের পিছনে অন্য অর্থ খোঁজাও ঠিক নয়। কিন্তু মজাটুকু সরিয়ে রাখলে কথার ভিতর থেকে বাস্তব ছবিটি ফুটে ওঠে। অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ ফুটবলের আয়োজনে কলকাতা যা করে দেখাল, এককথায় অভাবনীয়। মমতার সরকার সেই কৃতিত্বের অবিসংবাদী দাবিদার।
সাফল্যের এই ঝলকের মধ্যেই আবার রাজ্যে ডেঙ্গির প্রকোপ নিয়ে উদ্বেগও বেশ ছড়িয়েছে। আলোচনা সর্বত্র। এই মরশুমে এখন পর্যন্ত ডেঙ্গিতে কত জনের মৃত্যু হয়েছে তার সরকারি হিসেবের সঙ্গে বেসরকারি দাবির ফারাক আকাশপাতাল। অঙ্ক মিলছে না। ফলে বাড়ছে বিতর্ক। সেই সঙ্গে সাধারণের মধ্যে আতঙ্কও।
বিভিন্ন মহল প্রশ্ন তুলছে, কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে ডেঙ্গির ‘প্রকৃত অবস্থা’ আড়াল করা হচ্ছে কেন? বাস্তবকে স্বীকার না করলে আখেরে লাভ কার? অভিজ্ঞেরা এমনও বলছেন, ডেঙ্গির মতো কোনও রোগ যদি ছড়াতে থাকে, তবে তার মোকাবিলা করার জন্যই যথাযথ পরিস্থিতি জানা একান্ত জরুরি। বিরোধ-বিতর্ক এ ক্ষেত্রে অর্থহীন। বরং কতটা এলাকা আক্রান্ত, কোথায় কত রোগীর মৃত্যু হয়েছে— এ সব তথ্য যত নির্দিষ্ট ও স্বচ্ছ ভাবে সরকারের সামনে থাকবে, ততই পরবর্তী পদক্ষেপ করার সুবিধা হবে। এটাই বাস্তববুদ্ধি।
সবাই জানেন, মমতার বাস্তববোধ বড় কম নয়। দূরদর্শিতাও অপরিসীম। তিনি অনেক দূর পর্যন্ত ভাবতে পারেন। সেই ভাবনাকে বাস্তবে পরিণত করতেও জানেন। তাঁর জেদ, সাহস, পরিশ্রম করার ক্ষমতা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে দৃ়ঢ়তা বার বার তাঁকে এগিয়ে দেয়।
অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপের কথাই ধরুন না! দিল্লি, মুম্বই-সহ এতগুলি শহরে খেলা হল। কিন্তু দাগ কাটল শুধু কলকাতা। মমতা বুঝেছিলেন, পশ্চিমবঙ্গকে জগৎসভায় তুলে ধরার লক্ষ্যে এমন একটি আন্তর্জাতিক পরিসরকে সব রকমে কাজে লাগানো যেতে পারে। দীর্ঘদিন ধরে এর প্রস্তুতি চলেছে সর্বস্তরে। নবান্ন থেকে পাড়ায় পাড়ায়। শুধু স্টেডিয়াম সংস্কারই নয়, খেলাকে কেন্দ্র করে শহরের বিস্তীর্ণ এলাকাকে যে ভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে তোলা হয়েছিল, তা সবার প্রশংসা পেয়েছে। এই কাজে কোনও রকম বাধা মানতে চাননি মুখ্যমন্ত্রী। যেমন, স্টেডিয়ামের কাছে বাইপাসের উপর গজিয়ে ওঠা ঝুপড়ি উচ্ছেদ। সাধারণত জবরদখল ঝুপড়ি তুলতে কালঘাম ছুটে যায়। রাজনীতির কারবারিরা রে রে করে নেমে পড়েন। কিন্তু এ ক্ষেত্রে প্রশাসনিক দৃঢ়তা ও বাস্তববুদ্ধির জয় হয়েছে। বিধাননগর পুরসভাকে দিয়ে ঝুপড়ি হটিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বাস্তববুদ্ধি কাজে লাগিয়েই মাত্র দশ মিনিটের সিদ্ধান্তে সেমিফাইনাল ম্যাচটিও কলকাতায় লুফে নেন মমতা। হাতে ছিল একটা দিন। ২৩ অক্টোবর বিকেলে ক্রীড়ামন্ত্রী অরূপ বিশ্বাস মুখ্যমন্ত্রীকে ফোনে জানান, গুয়াহাটির মাঠ অনুপযুক্ত হওয়ায় খেলা কলকাতায় করাতে চায় ফিফা। কী করণীয়? অরূপের দিকে বল ঠেলে দিয়ে মমতার ভোকাল টনিক: ‘‘কী রে, পারবি না! এত বড় সুযোগ ছেড়ে দেওয়া কি উচিত হবে?’’ বাকিটুকু মেশিনের তৎপরতায় সম্পন্ন হয়ে গেল। টিকিট বিতরণ থেকে শুরু করে সব কিছু হল যথাবিধি। ম্যাচের আগের দিনও প্রায় সারা রাত মাঠে বসে তদারকি করলেন ক্রীড়ামন্ত্রী। ২৫ অক্টোবর গ্যালারি ভর্তি দর্শক।
রাজারহাটের ইকো পার্কই বলুন বা সদ্য উদ্বোধন হওয়া কনভেনশন সেন্টার— সবই মমতার দূরদৃষ্টির ফসল। এক দিন বিমানবন্দর থেকে ফেরার পথে রাজারহাটের রাস্তায় জলাজঙ্গলে ভরা বিশাল জায়গাটি দেখে গাড়ি থেকে নেমে পড়েছিলেন তিনি। বলেছিলেন, এই জমিতে কিছু একটা করতে হবে। সেটাই ইকো পার্কের ইতিকথা। আলিপুর জেলের চার পাশে উন্নয়নের যে সব কাজ চলছে মুখ্যমন্ত্রী তারও রূপকার। উদাহরণ আছে আরও।
সাতকাহন করে এ সব বলার উদ্দেশ্য এটা বোঝানো যে, মমতা ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে জানেন। বাস্তব পরিস্থিতি বুঝে কখনও প্রয়োজন হলে দৃঢ় পদক্ষেপও করেন তিনি। সেখানে আপস নেই। অনেক আপাতকঠিন কাজ সমাধা করাও তাই তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়।
এহেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ডেঙ্গি নিয়ে টালবাহানা করছেন— এমন অভিযোগ তাই তাঁর চেনা ভাবমূর্তির সঙ্গে কিছুতেই মেলে না। তবু অভিযোগ উঠছে। যার মূল কথা হল, নিজেদের ‘ব্যর্থতা’ ঢাকতে সরকার মৃতের সংখ্যা কমিয়ে দেখাতে চায়।
অভিযোগ যতই থাক, মশাবাহিত রোগে অন্যান্য কয়েকটি রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে মৃতের সংখ্যা যে অনেক কম, তা নিয়ে এখন পর্যন্ত তেমন কোনও সংশয় বা প্রশ্ন শোনা যায়নি। তবে সংখ্যাটি ১৩-তে থেমে নেই, এটাও ঘটনা।
একটি প্রশ্ন তবু থেকেই যায়। মৃতের সংখ্যা নিয়ে সরকার আরও একটু ‘উদার’ হলে ক্ষতি কী? প্রতিটি মৃত্যুই দুঃখের। তবে সওয়া ন’কোটির রাজ্যে মৃত্যু ১৩ জনেরই হয়ে থাকুক, বা ৩০-৪০-৫০, তার জন্য কেউ মমতাকে দোষ দিয়ে বলবে না, তিনি ঘরে ঘরে মশা ঢুকিয়ে দিচ্ছেন।
কিন্তু মৃত্যু-বিতর্কের বাইরেও একটি বিষয় স্পষ্ট। তা হল, রাজ্যে ডেঙ্গি আক্রান্তের সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি। এবং মুখ্যমন্ত্রী নিজে সে ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। টাকা বরাদ্দ করে এবং পুরসভা, পঞ্চায়েত, চিকিৎসক সংগঠন সকলকে কোমর বেঁধে নেমে পড়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি আসলে পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝিয়ে দিতে চেয়েছেন। মশা দমনে গাফিলতি দেখলে পুরসভা বা পঞ্চায়েত ভেঙে দেওয়ার হুমকিও দিয়ে রেখেছেন আগাম। অতএব বাস্তবকে অস্বীকার করে তিনি একেবারে উদাসীন বসে রয়েছেন বললে অবশ্যই সত্যের অপলাপ হবে।
মমতা চ্যালেঞ্জ নিতে ভালবাসেন। চ্যালে়ঞ্জের মোকাবিলা করে জিততেও। বিশ্বকাপ আয়োজনে সাফল্য তার সর্বশেষ নিদর্শন। এ বার চ্যালেঞ্জ ডেঙ্গি দমনের। মানুষ এতেও তাঁর জয় দেখতে চায়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy