স্তম্ভিত হইয়াছেন পশ্চিমবঙ্গের শিশু অধিকার কমিশনের সদস্যরা। স্তম্ভিত হইবার মূলে একটি সমীক্ষার ফল। শিশুদের উপর গার্হস্থ্য হিংসার স্বরূপ বুঝিতে তাঁহারা দুইটি ওয়ার্ডের শিশুদের লইয়া একটি কমিটি গঠন করিয়াছিলেন। নব্বই শতাংশ শিশুই গার্হস্থ্য হিংসার প্রশ্নে তাহার আত্মীয়পরিজনের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করিয়াছে। বাহিরের কোনও শক্তিকে নহে, নিজ ঘরের লোককেই তাহাদের সর্বাধিক ভয়, এবং আপনজনদের হাতেই শিশুরা শারীরিক ভাবে সর্বাধিক নিগৃহীত হইয়া থাকে। কমিশনের সদস্যদের অত্যাশ্চর্য হইবার কারণ এই ‘নব্বই শতাংশ’-এর পরিসংখ্যানটি। অনুমান, শিশু নিগ্রহের ঘটনার অধিকাংশের জন্মই যে তাহার পরিচিত পরিবেশে, এমন একটি ধারণা তাঁহারাও পোষণ করিতেন। অন্যথায়, কমিটি গঠনের উদ্যোগ লওয়া হইত না। কিন্তু ‘অধিকাংশ’ বলিতে যে তাহা নব্বই শতাংশে গিয়া পৌঁছাইবে, সেই আন্দাজ তাঁহারা করিতে পারেন নাই।
খটকা এইখানেই লাগিতেছে। শিশুরা যে প্রধানত গার্হস্থ্য হিংসারই শিকার, ইহা বুঝিতে কোনও নূতন কমিটি বসাইবার প্রয়োজন পড়ে না। চারিপার্শ্বে নজর রাখিলেই প্রমাণ পাওয়া যায়। শিশু যে বয়সে দিনের অধিকাংশ সময়টাই গৃহের চার দেওয়ালের মধ্যে, পরিচিত পরিবেশে কাটাইয়া থাকে, নিগ্রহের ঘটনাগুলি সাধারণত সেই বয়সেই ঘটিয়া থাকে। শুধুমাত্র এইটুকু জানিলেই তো সম্ভাব্য অপরাধীদের চিনিতে কষ্ট হয় না। ইহা শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গের পরিবারগুলির সমস্যা নহে, সারা পৃথিবীর সমস্যা। এবং সময়ের সঙ্গে তাহা ক্রমশ বৃদ্ধি পাইতেছে। বিশ্বের সাপেক্ষে বিষয়টিকে দেখিলে ঘটনার ভয়াবহতার কিছুটা আন্দাজ পাওয়া যায়। দীর্ঘ দিন এই বিষয়ে নানা সমীক্ষা চলিয়াছে, সংবাদ পরিবেশিত হইয়াছে, আলোচনাচক্রেরও আয়োজন হইয়াছে। ইহা সত্ত্বেও পশ্চিমবঙ্গের সরকারি কর্তাদের বিস্ময়টি বিস্ময়কর। এই রাজ্যে যে শিশুঅধিকার অনেক ক্ষেত্রেই খাতায় কলমে রহিয়া গিয়াছে, সর্বত্র প্রযুক্ত হয় নাই, সেই তথ্য, পরিসংখ্যান-সহ তাঁহারা জানিয়া রাখিলে শিশুদের কিছু উপকার হইত।
শিশুদের আরও উপকার হইত, মা-বাবার শিশুর অধিকার সংক্রান্ত বিষয়গুলি লইয়া একটি স্পষ্ট ধারণা থাকিলে। বাস্তবে, তাহাও হয় নাই। শাসনের নামে যে নির্মম নির্যাতনের বহর অহরহ দেখা যায়, তাহাও যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, ইহাই বা কয়জন জানেন? অনেক পরিবারেই ভীতি প্রদর্শনের মাধ্যমে শিশুকে সহবত শিখাইবার সুপ্রাচীন পদ্ধতিটিই একমাত্র গ্রহণীয়। সম্ভাব্য শিশুনির্যাতনকারী আরও আছেন। অনেক সময়ই পেশার তাগিদে মা-বাবার অনুপস্থিতির সুযোগে কখনও বাড়ির পরিচারিকা, কখনও অন্য আত্মীয়রা এবং কখনও গৃহশিক্ষক তাহার উপর রীতিমতো শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার চালাইয়া থাকেন। কিছু কাল পূর্বে মুজফ্ফরপুরের হোম দেখাইয়া দিয়াছে, অনাথ শিশুদের আশ্রয়দাতাদের প্রকৃতি কী রূপ হইতে পারে। কিন্তু, নব্বই শতাংশ শিশু গার্হস্থ্য হিংসার শিকার বলিতে ইহা বুঝায় না যে, তাহারা বাহিরের পরিবেশে অধিক নিরাপদ। বাহিরের পরিবেশ তো বহু পূর্বেই তাহাদের শিকার বানাইয়াছে। গার্হস্থ্য হিংসার বাড়বাড়ন্ত এখন মাথার উপর হইতে তাহার নিরাপদ আচ্ছাদনটুকুও সরাইয়া লইতে উদ্যত।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy