বার্ট্রান্ড রাসেলের একটা মজার গল্প আছে সংবাদমাধ্যমে।
গল্পটা এ রকম: এক পাল হাতি সুশৃঙ্খল ভাবে হেঁটে চলেছে এক প্রত্যন্ত জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। হঠাৎ মাথার উপরে প্রবল শব্দ করে একটি বিমান উড়তে থাকে। এই রকম একটা জন্তু হাতির দল কখনও দেখেনি। সেই কারণে তারা ভীষণ ভয় পেয়ে যায়। এমনিতে হাতিরা খুব শান্তিপ্রিয় এবং দল বেঁধে যাতায়াত করে। এ রকম এক অচেনা জন্তু দেখে হাতিদের মধ্যে প্রায় দাঙ্গা বেঁধে গেল। কয়েক মিনিটের ব্যাপার। মেঘের মধ্যে দিয়ে শব্দ করতে করতে উড়োজাহাজটি চলে গেলে। শব্দও মিলিয়ে গেল। তার পর হাতিরা আবার সারি দিয়ে নিঃশব্দে নীরবে সেই মাঠের মধ্য দিয়ে হাঁটতে লাগল।
রাসেল এই লেখাটা লিখে প্রশ্ন করেছেন, বলতে পারেন, কেন এমন একটা ঘটনা এত সহজে নিয়ন্ত্রণে চলে এল? কোনও গোলমাল বাধল না? এর জবাবটাও রাসেল নিজেই দিয়েছেন, ওই হাতির পালের মধ্যে কোনও সাংবাদিক হাতি ছিল না! কোনও একটা ঘটনাকে তিল থেকে তাল করা অনেক সময় নীতিবহির্গত ভাবে, কখনও বা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ভাবে সাংবাদিকেরা যে কাজ করেন না, এমন নয়। এ ব্যাপারে সংবাদমাধ্যমের এবং সাংবাদিকের একটা আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং নৈতিকতার প্রশ্ন নিশ্চয়ই থাকা প্রয়োজন। কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা, বিশেষত যখন তাঁরা ক্ষমতাসীন হন, তাঁরা যে ভাবে সংবাদপত্রের এবং সাংবাদিকদের উপর এক ভয়াবহ নিপীড়নের সংস্কৃতি তৈরি করেন, সেটাও কিন্তু ভারতের রাজনীতিতে নতুন নয়।
’৪৭ সালের স্বাধীনতার পর নেহরু যখন প্রধানমন্ত্রী হন, তখনও কাশ্মীর থেকে চিন, নানা বিষয়ে স্বাধীন সংবাদপত্র কঠোর সমালোচনার নিদর্শন রেখেছে। নিখিল চক্রবর্তীর লেখায় আছে, নেহরু সেই সময় সংবাদপত্রের মালিকদের তোয়াজ করতেও শুরু করেছিলেন। বিদেশ থেকে সংবাদপত্রের যন্ত্রাংশ যাতে কম শুল্ক দিয়ে আনা যায়, আরও নানা ভাবে সংবাদমাধ্যমকে অর্থকরী সুযোগ করে দেওয়া যায়, এই সবই নেহরু করেছিলেন। কিন্তু তাতে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম নতজানু হয়ে নেহরু ভজনাতেই ব্যস্ত থাকেনি। এমনকী, চিনের আগ্রাসনের পর সরকারি ব্যর্থতার সমালোচনা করে এই পত্রিকাগোষ্ঠী। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেনকে চিঠি দিয়ে নেহরু অনুরোধ করেছিলেন যাতে কলকাতার সংবাদমাধ্যম এমনটা না করে। তার পর প্রফুল্লচন্দ্র সেন প্রয়াত অশোক সরকারের সঙ্গে কথা বলে নেহরুকে আবার আর একটি চিঠি দিয়ে বলেন যে, তিনি অশোকবাবুকে নেহরুর অসন্তোষের কথা জানিয়েছেন। কিন্তু আনন্দবাজার কর্তৃপক্ষ সংবাদ পরিবেশনার ক্ষেত্রে সমালোচনার পথ ছেড়ে আপস করবেন, এমনটা প্রফুল্লবাবুর মনে হয়নি।
সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলেছে। এমন ঘটনাও ঘটেছে যে সাংবাদিক এন রাম দিল্লিতে সাংবাদিক বৈঠক করে তাঁর মালিক ও আত্মীয় কস্তুরীর বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে বলেছেন যে, বফর্স সংক্রান্ত কোনও খবর কস্তুরী হিন্দু পত্রিকায় ছাপছেন না। অরুণ শৌরির সঙ্গেও বিরাট বিতর্ক চিত্রা সুব্রহ্মণ্যমের। অরুণ নেহরুর চাপে কিছু খবর সম্পাদক হিসেবে অরুণ শৌরি ছাপতে রাজি হননি, এমন অভিযোগ তুলে চিত্রা ইস্তফা দিয়েছিলেন। কাজেই ব্যাপারটা যে সরকার বনাম সংবাদপত্র, তা নয়। অনেক সময় সম্পাদক, সাংবাদিক, আবার সংবাদপত্রের মালিকের সঙ্গে সম্পাদকের নানা স্তরে এই স্বাধীনতা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে।
অতীতে শুধু কংগ্রেস বলে নয়, মোরারজি দেশাই থেকে বিশ্বনাথপ্রতাপের মতো অ-বিজেপি, অ-কংগ্রেস জমানাতেও এই অসহিষ্ণুতা দেখা গিয়েছে। বিশ্বনাথপ্রতাপ সিংহ এবং বিজেপি-র মধ্যে যখন রামমন্দির এবং বাবরি মসজিদ নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়েছিল, ভারতের রাজনীতিতে চূড়ান্ত মেরুকরণ দেখা গিয়েছিল, তখন সেই সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য সে সময় রাজনৈতিক প্রভুরা খড়্গহস্ত হয়েছিলেন সংবাদমাধ্যমের উপর।
যখন তাঁদের পক্ষে খবর প্রকাশিত হয়, বিশেষত বিরোধী দল হিসেবে, তখন রাজনৈতিক নেতারা খুব খুশি হন। আবার তারাই যখন শাসক দলে পরিণত হয়, তখন তারা সেটি সহ্য করতে পারে না। প্রবীণ সাংবাদিক কেবল বর্মার রচনায় আছে, এক বার সাংবাদিক বৈঠকের মধ্যে এক সাংবাদিকের উপর রেগে গিয়ে ইন্দিরা গাঁধী বলেছিলেন, তোমার সংবাদপত্রের মালিককে আমি খুব ভাল করে চিনি। তাঁকে বলে আমি তোমায় চাকরি থেকে বরখাস্ত করে দেব। এই ঘটনার পরিণতি জরুরি অবস্থা। রাজীব গাঁধী প্রেস বিল করতে গিয়ে বাধাপ্রাপ্ত হন। এবং সেটি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।
এখন নরেন্দ্র মোদীর সরকারের এক বছর অতিবাহিত হয়েছে। এই এক বছরের মধ্যেই সংবাদপত্র খুব আক্রমণাত্মক। অসন্তোষের পারদ চড়ছে। মোদী সরকার আরও আক্রমণাত্মক হচ্ছে। সংবাদপত্রের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে। কিন্তু একটা কথা শাসক দল আবার ভুলে যাচ্ছে, সংবাদপত্রের ভূমিকা দর্পণের মতো। তারা যা করবে, সংবাদমাধ্যমে তার প্রতিফলন হবে। বড়জোর সংবাদমাধ্যম অনুঘটকের কাজ করতে পারে। তাই শুধুমাত্র মিডিয়া ম্যানেজমেন্ট বা স্টোরি ম্যানেজমেন্টের কৌশল নিয়ে এই সমস্যার সমাধান হয় না।
তবে এ কথা সত্য, আজকাল সাংবাদিকদের মধ্যেও পেশাদারি মানসিকতার বদলে এক ধরনের গোষ্ঠী সাংবাদিকতা বিকশিত হয়েছে। হয় কিছু সাংবাদিক কংগ্রেস, নয় বিজেপি, হয় সিপিএম, নয় তৃণমূল— এই ‘আইদার অর’ সাংবাদিকতার সমালোচনা করছেন অনেক চিন্তাবিদ, সমাজবিদেরা। সাংবাদিকদের মতাদর্শগত দায়বদ্ধতা থাকতে পারে। কিন্তু সাংবাদিকতার সময় যথাসম্ভব মূল্যনিরপেক্ষ প্রতিবেদন আশা করে সাধারণ পাঠক। ২০১৫-য় দাঁড়িয়ে তাই মনে হচ্ছে, এক দিকে রাজনৈতিক নেতাদের ও শাসক প্রভুদের চূড়ান্ত অসহিষ্ণুতা, আর কিছু সাংবাদিকের দায়িত্বজ্ঞানহীন প্যামপ্লেট সাংবাদিকতা, এই দুই চরম অবস্থানের মাঝখানে একটা সুস্থ পেশাদারি পরিসর খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করার দায়িত্ব কিন্তু আমাদেরই।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy