এমন এক আন্দোলন মিটু (#MeToo), যার নামের মধ্যেই আছে এক সহমর্মিতার বোধ ও দলবদ্ধতার সম্ভাবনা যে, তোমার একার এ রকম হয়নি, কাজের জায়গায় যৌন নির্যাতনের অভিজ্ঞতা আমারও হয়েছে, আজ আমিও বলছি, শোনো। আর এত দিন পরে এসে বলছি, কারণ নিজেকে যৌন নিগৃহীত হিসেবে পেশ করতে পারার শক্তি অর্জন করতে সময় লেগেছে। তবে, এই স্বেচ্ছা-জবানবন্দি দিতে শুরু করেছেন বিনোদন ও মিডিয়ার কর্মরত মহিলারা, আর সে জন্য তাঁরা বেছে নিয়েছেন সোশ্যাল মিডিয়া, তাই যাঁরা এই মাধ্যম ব্যবহার করেন না, সেই মহিলাদের নির্যাতনের কথা আজও অজানা। কর্মক্ষেত্রে মেয়েদের যৌন হয়রানি যে শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এ তথ্যটিই সেই মহিলাদের অধিকাংশের জানা নেই। আমরা ইতিমধ্যে শুনে ফেলা কাহিনিগুলি থেকে বুঝে গিয়েছি, তথ্য জানা থাকলেও সুরাহা পাওয়ার উপায় নেই। অথচ যৌন নির্যাতন এমন বহু মানুষ ও মহিলার জীবনেও অত্যন্ত রূঢ় সত্যি, যা ঘটে তিনি নিচু জাতের বলে, জনজাতি বলে, সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর বলে, যৌনতায় বা লিঙ্গপরিচয়ে প্রান্তিক বলে, একা পথে নেমে কাজ করেন বলে।
এ তো স্পষ্টই যে, সামাজিক দিক থেকে এগিয়ে থাকা মহিলারাই যখন এই সবে বলতে পারছেন যে কাজের জায়গায় তাঁদের কী ভাবে যৌন হেনস্থা করা হয়, অবিচারের প্রতিকার না হয়ে কী ভাবে তিনি নিজে বরখাস্ত বা চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হন, তখন ছোট কারখানায়, ইটভাটায়, খনিখাদানে, সেলাইকলে বা পরের বাড়ি কাজ করা, সব্জিবেচা, আয়া, সাফাইকর্মী, অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী, একশো দিন কাজ করা মেয়ে, পালস পোলিয়ো-র কর্মী মহিলারা, রূপান্তরকামীরা, হিজড়ারা কিসের মধ্যে দিয়ে যান, সে কথা তাঁদের পক্ষে বলা সহজ নয়। সামাজিক প্রান্তিকতার কারণেই তাঁদের পক্ষে সুবিচার চাওয়ার ধক জোগাড় করাই তো অসম্ভব। নিজেই নিজেকে রক্ষা করতে ‘মির্চ মসালা’ ছবিতে গুঁড়ো মশলা কারখানার সোনবাই সুবেদারকে লাল লঙ্কার গুঁড়ো ছুড়ে মেরেছিলেন আর মহাশ্বেতা দেবীর ‘শিকার’ গল্পে মেরি ওরাওঁ দা’ দিয়ে কুপিয়েছিলেন তহশিলদারকে। ভয়ডরহীন একক নারীপ্রতিরোধ চলতেই থাকে যৌন নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে।
কোথায় ব্যক্তিমানুষের প্রাপ্য সামাজিক ন্যায়? নারী বা যৌনলিঙ্গপ্রান্তিক হওয়ার কারণে কর্মক্ষেত্রে যৌন নির্যাতন থেকে মুক্তি? নির্যাতিতা অভিযোগ দায়ের করার জন্য সুরক্ষিত বোধ করবেন কবে? নির্যাতনকারীর বিরুদ্ধে কবে তৈরি হবে সামাজিক স্বর? কাজেই আশু প্রশ্ন, #মিটু আন্দোলন কী করে শহরের চৌহদ্দির বাইরে বেরিয়ে নানা ধরনের মানুষের উপর যৌন নির্যাতনের কথা বলতে পারবে? অন্যদের করতে পারবে এই বিপ্লবে শামিল?
কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের বিরুদ্ধে যৌন হিংসা বিরোধী বিলটি এসেছিল রাজস্থানের ভাঁওরি দেবীর উপর ঘটা যৌন হিংসার প্রেক্ষিতে। রাজস্থানের গ্রামের সমাজকর্মী ভাঁওরি বাল্যবিবাহ প্রতিরোধে নেমেছিলেন, উচ্চবর্ণের পুরুষরা তাঁকে গণধর্ষণ করে। জাতপাত পিতৃতন্ত্রের বেড়াজালে তিনি সুবিচার পান না, কিন্তু ২২ বছরের বেশি চলতে থাকা এ মামলার সূত্রে আমাদের দেশে নারীবাদ এক বৈপ্লবিক মোড় নেয়। ভাঁওরি দেবীর ধর্ষণকে কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি হিসেবে চিহ্নিত করে তৈরি হয় বিশাখা গাইডলাইন (১৯৯৭), তার ভিত্তিতে প্রস্তুত হয় কর্মক্ষেত্রে মহিলাদের যৌন হয়রানি (প্রতিরোধ, নিষিদ্ধকরণ ও প্রতিকার) আইন (২০১৩)। সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে আইন মাফিক অভিযোগ দায়ের সেল (আইসিসি) আবশ্যিক হয়ে যায়। ভাবা হয় যে, এই সেলটির মাধ্যমে প্রতিরোধ, নিষিদ্ধকরণ ও প্রতিকার হবে। কিন্তু #মিটু জানিয়ে দিল, হয় সেই সেল গঠনই হয়নি, হলেও খাতায় কলমে রয়েছে, একটা অচল টাকার মতো তা কাজে লাগে না। কর্মী মহিলাদের যৌন হয়রানি চলছেই— খুলে-আম বা চোরাগোপ্তা।
আর অসংগঠিত কর্মক্ষেত্র? সে বাংলা ছবির জগৎ, গ্রুপ থিয়েটার, মডেলিং এজেন্সি থেকে যা যা তথাকথিত গায়েগতরে খাটার খুচরো জায়গা, সবগুলিই এই আইনে কাজের ক্ষেত্র হিসেবে চিহ্নিত হলেও সেখানে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অভ্যন্তরীণ অভিযোগ সেল নেই। স্থানীয় অভিযোগ কমিটি থাকলেও, ঠিকমতো কাজ করছে না। দেখা গিয়েছে অনেক মহিলা ঠিক করে জানেনই না, কোথায় যাবেন, বা গেলেও এগুলি আসলে ঘুঘুর বাসা— যাঁরা বসে আছেন তাঁদের লিঙ্গ-সংবেদনশীলতা তো নেইই, পুরো বিষয়টিকে ক্ষমতার খেলা ভাবার বা নির্যাতিতার অভিজ্ঞতা যত্ন নিয়ে শোনার প্রশিক্ষণ নেই। বরং তাঁরা অধিকাংশ সময়েই নিজেদের গোঁড়ামি, পুরুষ-বসের পদমর্যাদা, জাত ও রাজনৈতিক যোগাযোগের প্রভাবে পড়ে থাকেন।
নানা কথাই শোনা গেল সম্প্রতি একটি নারীবাদী সংগঠনের আলোচনা চক্রে। ভাবা হচ্ছিল, #মিটু-র জন্য যে একটা ঝাঁকুনি লেগেছে, একটি ভিন্ন সচেতনতা তৈরি হয়েছে সমাজে, সেই মুহূর্তে কী ভাবে এই প্রান্তিক মহিলারাও নিজেদের যৌন হেনস্থার কথা ভাগ করে নিতে পারবেন, দায়ের করতে পারবেন অভিযোগ। পাবেন প্রতিকার। বোঝা গেল, কী ভাবে এক জন নির্যাতিতা নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলে উঠতে পারবেন তা নিয়ে ভাবতে হবে। এক নারীবাদী সংস্থা পরিচালিত স্বনির্ভর প্রকল্পে অনগ্রসর শ্রেণির যে মহিলারা গাড়ি চালানোর প্রশিক্ষণ পান তাঁরা #মিটু’র কথা শুনে মন্তব্য করেছেন, কেউ যদি আলাদা করে একা বসে শোনেন, তবে অনেক মহিলাই ভরসা করে বলবেন। সবাই একই রকম খোলাখুলি বলতে পারেন না, কারণ সমাজে জানাজানির ভয় থাকে। কোনও মেয়ের সঙ্গে অশালীন যৌন আচরণ হয়েছে, এটা জানা গেলে তার পর হেনস্থাকারী বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াক বা শাস্তি পাক, মেয়েটি চিহ্নিত হয়ে যাবেন নিগৃহীত বলে আর তাঁর পরিবার একঘরে হয়ে যাবেন। “স্বামী আছে, ছেলে আছে— কী করে বলে দেব আমার সঙ্গে কী হয়েছিল!” কেন মেয়েরা বার বার এই কথা বলছেন? সমাজকর্মী, সুন্দরবনের তাপসী মণ্ডল এই পরিপ্রেক্ষিতে জানালেন যে, সমাজ ধরে নেয়, যে মেয়েটি যৌন নিগৃহীত হয়েছেন, দোষটা তাঁর। স্বভাব তাঁরই ভাল ছিল না, তাই এত মেয়ে থাকতে তাঁর সঙ্গেই এমন হল। বা তিনি নিগৃহীত হয়েছেন মানে তাঁর গায়ে দোষ লেগে গিয়েছে। এই ভয়ে মেয়েরা এমনিই যৌন হয়রানি মেনে নেয়, ভবিতব্য বলে। তাপসী বললেন, শুধু মেয়েরা কেন, এত সব যে ঘটছে তা আসলে তো শহরের প্রান্তের বা তারও বাইরে গ্রামের ছেলেরাও জানে না, কারও হাতে তথ্য নেই। কাজেই তাপসীর মত, নানা ভাবে মানুষকে ওয়াকিবহাল করতে শুরু করা এখনই প্রয়োজন। কারণ তবেই মেয়েরা সাহস পাবে। যে যৌন হয়রানি করে, তাপসী বলেন, মনে রাখতে হবে সে এক জনকে হেনস্থা করে থেমে থাকে না। ফলে অনেক মহিলা যদি দেখিয়ে দেন নিগ্রহকারীকে, লোকটি সমঝে যাবে।
অসংগঠিত ক্ষেত্রে যৌন হয়রানি মোকাবিলায় স্থানীয় অভিযোগ সমিতির (এলসিসি) গুরুত্ব সবচেয়ে বেশি হবে। সেটির শাখা থাকবে প্রতিটি ওয়ার্ডে এবং সেখানে জেলাশাসকের ধামাধরা লোক জন বসে থাকলে ছবি বদলাবে না, সেখানে থাকবেন নানা স্তরের শ্রমজীবী মহিলা, থাকবেন সমাজকর্মীরা— পরামর্শ দিলেন একটি সংগঠনের প্রতিনিধি, কস্তুরী। কাজের জায়গায় যৌন হয়রানি আরও আরও ক্ষমতা ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত, আসলে যৌন হয়রানি ক্ষমতারই অপব্যবহার। কস্তুরী সাফ জানান, উঁচু পদে আছেন বলে এক জন পুরুষ তাঁর অধস্তন মহিলাকর্মীকে যৌন নিগ্রহ করতে পারেন, শাস্তি হিসেবে সেই পদ যদি তাঁর থেকে কেড়ে নেওয়া হয়, তা হলে নজির তৈরি হবে।
মিটু-র ঢেউ ক্রমে ছড়িয়ে পড়ছে। জানা যাচ্ছে রাজ্যে রাজ্যে এত দিন ধরে জমে থাকা ও নতুন জমা পড়া অভিযোগ হাজার হাজার। এই নভেম্বরেই বেঙ্গালুরুতে জড়ো হয়েছিলেন শ্রমজীবী মহিলারা। গৃহ পরিচারিকা, বয়নশিল্প পোশাক কারখানার শ্রমিক, সাফাই কর্মী, মহিলা বাস কন্ডাক্টরদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিলেন রূপান্তরকামীরা, ছাত্রছাত্রীরা। তাপসী বলেছিলেন, নিজের হয়রানির কথা জানানোর দৃঢ়তা পেতে হবে। এই জমায়েতে অনেকেই মুখ খুললেন, ধিক্কার জানালেন। মহিলা বাস কন্ডাক্টররা বললেন এক বাস ভিড়ের মধ্যে টাকার ব্যাগ, টিকিট বা পাঞ্চিং মেশিন সামলে কী যৌন হেনস্থার মধ্যে তাঁদের যেতে হয়, শরীরের প্রতি খেয়াল রাখতে গিয়ে টাকা হাতসাফাই হয়ে যায়, পরে নিজেদেরই খেসারত দিতে হয়। দাবি উঠল হাউসিং কমপ্লেক্সগুলোর মধ্যে আলাদা করে থাকতে হবে এলসিসি, যেখানে মহিলারা আর বিশেষ করে বালিকারা সবচেয়ে বেশি যৌন নিগৃহীত।
আসছে আর একটি পদযাত্রা। আর একটি ‘লং মার্চ’। কাজের জায়গায় যৌন হেনস্থা হয়েছে এমন পঁচিশ হাজার মহিলা হাঁটবেন কয়েকশো এনজিও-র উদ্যোগে। ২৫ রাজ্যের ২০০টি জেলার প্রত্যন্ত গ্রামে যাবেন তাঁরা। সঙ্গে হাঁটবেন সমাজকর্মীরা, আর যাঁরা এই আন্দোলনে শামিল হতে চান, তাঁরা। তাঁরা নিজেদের কথা বলবেন, তথ্যের খুঁটিনাটি জানাবেন, অভিযোগ দায়ের করতে ও জনমত তৈরি করতে সাহায্য করবেন। ডিসেম্বর এল বলে।
যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে তুলনামূলক
সাহিত্যের শিক্ষক
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy