Advertisement
১৯ এপ্রিল ২০২৪
আপনার অভিমত

কৃষকের প্রাপ্য লুটে নিচ্ছে ফড়েরাই

১৯৯০ সালে জাতীয় আয়ে কৃষিক্ষেত্রে অবদান ছিল ২৯ শতাংশ। এই সময়ে তা ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। যা ভারতীয় কৃষির তথৈবচ দশাকে স্পষ্ট করে। লিখছেন পঙ্কজ বিশ্বাস১৯৯০ সালে জাতীয় আয়ে কৃষিক্ষেত্রে অবদান ছিল ২৯ শতাংশ। এই সময়ে তা ১৬ শতাংশে নেমে এসেছে। যা ভারতীয় কৃষির তথৈবচ দশাকে স্পষ্ট করে। লিখছেন পঙ্কজ বিশ্বাস

প্রতীকী ছবি।

প্রতীকী ছবি।

শেষ আপডেট: ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৪:০৯
Share: Save:

রিজার্ভ ব্যাঙ্কের প্রাক্তন গভর্নর রঘুরাম রাজনের মতে, এতে যে শুধু কৃষি ক্ষেত্রে লগ্নি ধাক্কা খায় তাই নয়। একই সঙ্গে সরকারকে খাবি খেতে হয় ঘাটতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে। তাই ভোট অঙ্কের কথা ভেবে যখন রাহুল গাঁধী এই রকম ঘোষণা করে বসেন, ক্ষমতায় এলে তার সরকার গোটা দেশের কৃষকদের কৃষিঋণ মকুব করে দেবেন, তখন দুর্ভাবনা হয় বইকি! প্রসঙ্গত, বলে রাখা যাক, কৃষিঋণ মূলত অবস্থাপন্ন ও মাঝারি কৃষকেরাই গ্রহণ করে থাকে। তাই কৃষিঋণ মকুব হলে প্রান্তিক চাষিদের তেমন লাভ হয় না।

এ কথা অস্বীকার করার কোনও মানে নেই যে, কৃষকদের উন্নতির জন্য পদক্ষেপ নিতে গেলে তাকাতে হবে কৃষি সমস্যার গোড়ার দিকে। ভারতের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশে কৃষকদের সবচেয়ে বড় শত্রু হল প্রকৃতি। প্রকৃতি বিমুখ হলে কৃষকের দুঃখের অন্ত থাকে না। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, ঝড় ইত্যাদি কারণে প্রতি বছরই কৃষক তার ফসল নিয়ে সমস্যায় পড়ে। এই সময়ে ভারতের কৃষকদের যে দুরবস্থা তার প্রধান কারণ হিসাবে দায়ি করা যায় ২০১৪ এবং ২০১৫ সালের খরাকে। মহারাষ্ট্র, গুজরাত, কর্ণাটকের কৃষকেরা মূলত এই খরা দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে। এতে কৃষক যেমন কৃষিতে নিয়োজিত মূলধন ঘরে তুলতে পারেননি, তেমনই শোধ করতে পারেনি বকেয়া ঋণের পরিমাণ। কৃষকের দুর্দিনে রাষ্ট্র বিভিন্ন ভাবে হাত বাড়ালেও, বাস্তবে দেখা যায় সেগুলির সুফল পেয়ে থাকেন অবস্থাপন্ন চাষিরাই।

২০১৬ সালে ‘প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা’ চালু হয়। চাষ ভাল না হলেও কৃষকের যাতে অসুবিধা না হয়, সেই কথা ভেবে এই প্রকল্পের পরিকল্পনা। কিন্তু বাস্তবে এর সুফল কৃষকেরা এখনও ভোগ করতে পারেননি। কেননা, এই প্রকল্পের আওতায় খুব কম সংখ্যক কৃষককে আনা গিয়েছে। প্রকল্প রূপায়ণে সরকারি ঔদাসীন্য, উচ্চ হারে প্রিমিয়াম, সর্বোপরি কৃষকদের অসচেতনতা এর জন্য দায়ী। আর এই প্রকল্প সম্পর্কে দুর্নীতির অভিযোগও কম নয়। মহারাষ্ট্রের পরভণী জেলার উদাহরণ দিয়ে সাংবাদিক পি সাইনাথ ব্যাখ্যা করেছেন, এই জেলায় প্রায় ২ লক্ষ ৮০ হাজার সোয়াবিন চাষির থেকে একটি বেসরকারি বিমা সংস্থা ১৯ কোটি টাকার বেশি প্রিমিয়াম আদায় করেছে। কেন্দ্র ও রাজ্য ৭৭ কোটি টাকা করে দিয়েছে। অর্থাৎ, বিমা সংস্থা এক বছরে জেলা থেকে ১৭৩ কোটি টাকা ঘরে তুলেছে। আর ফসল নষ্ট হওয়ার পর তারা ক্ষতিপূরণ মিটিয়েছে মাত্র ৩০ কোটি টাকা। অর্থাৎ, একটি জেলা থেকেই তাদের লাভ ১৪৩ কোটি টাকা। আর তাই অনেক কৃষকই এই বিমার আওতা থেকে বেরিয়ে আসছে।

মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কৃষক যে ফসল উৎপন্ন করে, তার যথার্থ মূল্যও কি কৃষক পায়? আমার নিজের গ্রামে পেঁপে, লঙ্কার মতো ফসল এই বার মাঠেই ‘মারা’ যেতে দেখলাম। কেননা, ফসল মাঠ থেকে তুলতে যা খরচ, বাজারে বিক্রি করে সেই টাকাও কৃষকের ঘরে ফেরে না। এই প্রসঙ্গে মনে পড়বে স্বামীনাথন কমিশনের সুপারিশের কথা। এই কমিশন উৎপাদিত ফসলের সহায়ক মূল্য দেড় গুণ বৃদ্ধি করার কথা বলেছিল। প্রায় দু’দশক আগের এই সুপারিশ কেন্দ্রের কোনও সরকারই গুরুত্ব দিয়ে দেখেনি। যেটুকু সহায়ক মূল্য সরকার দেয়, তা অনেক সময় দরিদ্র কৃষকের কাছে এসে পৌঁছায় না। সম্পন্ন কৃষকেরাই এর সুফল ভোগ করে। প্রান্তিক কৃষকদের অজ্ঞতা, তৎপরতার অভাগ, পঞ্চায়েতের রাজনীতি এর জন্য দায়ী।

সম্প্রতি দৈনিক সংবাদপত্রের পাতায় বার বার অভিযোগ এসেছে কিসান মান্ডিগুলিতে ধান বেচাকে উপলক্ষ করে দুর্নীতির কথা। যা ফড়ে বা বড় বড় ব্যবসায়ীদের ‘হাত’। যার ফলে কৃষক তাঁর প্রাপ্যমূল্য পান না। নবান্নের খবর, কেন্দ্রীয় সরকার ধানের সহায়ক মূল্য কুইন্টাল প্রতি ২০০ টাকা বাড়িয়েছে। এর সঙ্গে রাজ্য কুড়ি টাকা বোনাস ঘোষণা করেছে। সব মিলিয়ে সরকারের কাছে সরাসরি ধান বিক্রি করলে কৃষকদের কুইন্টাল প্রতি ১৭৭০ টাকা পাওয়ার কথা। কিন্তু অভিযোগ উঠেছে, বিভিন্ন জেলায় ফড়েরা কৃষকদের কাছ থেকে প্রতি কুইন্টাল ১৪০০-১৪৫০ টাকায় ধান কিনে তা সরকারি কেন্দ্রে বিক্রি করে যাচ্ছে। অর্থাৎ, কৃষকের যা প্রাপ্য ছিল তা অধিকার করছে ফড়েরা। শুধু ধান নয়, অনেক ফসল বিক্রি করতে গিয়ে ফড়েদের এই বাড়বাড়ন্তে কৃষক তাঁর ঠিক মূল্য পায় না। সরকার এ সব ক্ষেত্রে কৃষকের হয়ে সদর্থক ভূমিকা নিতে পারে। নিচ্ছেও। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় স্থানীয় নেতা বা ‘দাদা’রা এই সব কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে। তাই সমস্যার নিরসন খুব মসৃণ হয় না।

কেন্দ্র প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, আগামী চার-পাঁচ বছরে কৃষি রফতানি দ্বিগুণ করে কৃষকের আয় দ্বিগুণ করবে। ‘ইকোনমিক সার্ভে অব ইন্ডিয়া, ২০১৬’ অনুযায়ী ভারতের সতেরোটা রাজ্যের পরিবার পিছু বার্ষিক আয় কুড়ি হাজার টাকা। অর্থাৎ পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি কৃষক পরিবারের মাসিক আয় সতেরশো টাকারও কম। তাই রোজগার দ্বিগুণ হলেও কি সমস্যার সমাধান হবে? আর তার চেয়ে ভাবনার কথা কৃষি বিপণনে উপযুক্ত পরিকাঠামো কি দেশে তৈরি হয়েছে? নীতি আয়োগের তথ্য অনুযায়ী তা হয়নি। ‘অরগ্যানাইজেশন ফর ইকোনমিক অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ (ওইসিডি)-এর মতে, আইনি জটিলতা এবং পরিকাঠামোর অভাবই প্রবল ভাবে প্রভাব ফেলে কৃষি বিপণনে। পশ্চিমবঙ্গের দিকে তাকালে দেখা যায়, আনাজ উৎপাদনে দেশের মধ্যে এই রাজ্য প্রথম হলেও রফতানিতে শেষের দিকে। আনাজ রফতানির তেমন কোনও টার্গেট বা অ্যাকশন প্ল্যানই এই রাজ্যে এখনও তৈরি হয়নি। সুতরাং আনাজ মাঠেই পচে, নয়তো গবাদি পশুর খাদ্য হয়।

স্বাতী ভট্টাচার্যের ‘নষ্ট নয়, রফতানি হোক’ লেখা থেকে জানা গেল, এই রাজ্য থেকে দৈনিক দশ টন আনাজ, ফল বিভিন্ন দেশে রফতানি হয়। পূর্ব এবং উত্তর-পূর্ব ভারতের সব রাজ্যের ফল-আনাজ রফতানির জন্য ভরসা দত্তপুকুরের একটি প্যাকিং হাউস। যেটি বেসরকারি। অর্থাৎ আনাজের জন্য তেমন স্টোর হাউজ নেই। তাই আনাজের জন্য যথোচিত ব্যবস্থা করা গেলে নিশ্চয়ই এই রফতানি বাড়িয়ে কৃষককে অভাবি বিক্রি থেকে রক্ষা করা

যেতে পারে।

সমস্যার এখানেই শেষ নয়। এই সে দিন পূর্ব বর্ধমানের আউশগ্রামে সেচের জল পায়নি বলে ধানের খেতে আগুন লাগিয়ে প্রতিবাদ জানাল কৃষকেরা। ভারতে চাষযোগ্য জমির ৬৪% সেচ-সেবিত। কিন্তু বিভিন্ন কারণে সেই ব্যবস্থাও বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত। গৃহীত প্রকল্পগুলিও বিভিন্ন কারণে এখনও বাস্তবায়িত হতে বড্ড ঢিলে হয়ে যায়। কৃষির উৎপাদনশীলতার হ্রাস, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণের যথেষ্ট ও উপযুক্ত প্রযুক্তি না থাকা, ছোট চাষিদের প্রযুক্তির সহায়তা গ্রহণ করতে না পারা, নগরায়ন ইত্যাদি কারণে কৃষক বিভিন্ন ভাবে মার খাচ্ছে। সরকারি প্রকল্পগুলি সম্পর্কেও কৃষকেরা খুব সচেতন নন। সচেতনতা মূলক পাঠ তাঁদের দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।

২০১৮-এর জুন মাসের ১ তারিখ থেকে ১০টি রাজ্যের কৃষকেরা ১০ দিনের ধর্মঘট করে তাদের ফসল বাজারে না পাঠিয়ে নষ্ট করে। কৃষকদের ক্ষোভ ছিল বিদেশ থেকে কম দামে আমদানি করা আনাজ এবং দুগ্ধজাত পণ্যের বিরুদ্ধে। কেননা, এগুলো তাদের প্রতিদ্বন্দ্বী। কৃষির আরও একটি সমস্যা শ্রমের অভাব। বর্তমানে বিভিন্ন কারণে বিশেষ করে MNREGA চালু হওয়ার পর কৃষিতে শ্রমিকের অভাব ঘটেছে। অনেকেই একে ‘কৃষি বিরোধী প্রকল্প’ বলেন। সব চেয়ে ভাল হয় কৃষিকে এই প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসা। যাতে করে শ্রমিকেরা কৃষিতে কাজ করতে পারেন। তাতে কৃষিকাজে শ্রমিক সমস্যাও মিটতে পারে।

উল্লেখ্য, ১৯৯০ সালে জাতীয় আয়ে কৃষিক্ষেত্রে অবদান ছিল ২৯ শতাংশ। এই সময়ে ১৬ শতাংশে তা নেমে এসেছে। এই তথ্য ভারতীয় কৃষির তথৈবচ দশাকে স্পষ্ট করে দেয়। কৃষকের সমস্যা রাতারাতি নিরসন করার নয়। মুক্ত বাজার অর্থনীতির সঙ্গে তাল রেখে সুস্থ পরিকল্পনা নিয়ে রাষ্ট্রকেই এগিয়ে আসতে হবে। না হলে ‘ঋণ মকুব’কে কুম্ভীরাশ্রুই মনে হবে। (শেষ)

চাপড়া গভর্নমেন্ট কলেজের শিক্ষক

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Farmers Middlemen Agriculture
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE