Advertisement
২৭ এপ্রিল ২০২৪

শীতের অতিথি দেব ভবঃ

পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া বন্যপ্রাণ সম্পন্ন। শয়ে শয়ে পাখি প্রজাতি। অধিকাংশই স্থায়ী বাসিন্দা। বিরল বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি যেমন রয়েছে, দৃষ্টিনন্দন, সুরেলা পাখিরাও রয়েছে প্রাচুর্য নিয়ে। পরিযায়ী পাখির প্রজাতি চল্লিশের কাছাকাছি। লিখছেন নচিকেতা বন্দ্যোপাধ্যায় পক্ষীনিবাস মূলত সবুজ বনানী হরিয়ালিতে বা উন্মুক্ত জলাশয়ে। পরিবেশ হতে পারে গ্রামীণ, শহুরে বা আধা শহুরে লোকালয়।

বিষ্ণুপুরের লালবাঁধে পরিযায়ী পাখি। ফাইল চিত্র

বিষ্ণুপুরের লালবাঁধে পরিযায়ী পাখি। ফাইল চিত্র

শেষ আপডেট: ১৬ ডিসেম্বর ২০১৯ ০২:০৯
Share: Save:

প্রকৃতির অপরূপ অবদান বিহঙ্গকুল। বিচিত্র বর্ণবৈভব, সুরসিদ্ধ কলতান, সামাজিক শিষ্টতা এবং পরিবেশে তাদের ভূমিকা দেখে আমরা আপ্লুত হই। তাদের মনোহারিণী বিনোদিনী ভূমিকা বহুদিনের পুরনো। প্রায় প্রতিটি দেশেরই আদর্শ বা জাতীয় পাখি রয়েছে। আমরা তো তাদের ডাকে জেগে উঠি। পথ হারানো বুনো হাঁসের দল দেখে কতবার বিস্মিত হয়েছি। নাগরিক জীবনেও পক্ষী সংসর্গ থেকে বিচ্যুত হইনি।

পক্ষীনিবাস মূলত সবুজ বনানী হরিয়ালিতে বা উন্মুক্ত জলাশয়ে। পরিবেশ হতে পারে গ্রামীণ, শহুরে বা আধা শহুরে লোকালয়। যে কোনও জায়গায় পাখিদের উপস্থিতি পরিবেশ তথা জনস্বাস্থ্যের জন্য লাভ প্রদায়ক। জলাশয়ের গুণাগুণ ও সম্পন্নতা জলপাখিদের বৈচিত্র ও জনসংখ্যার উপর নির্ভর করে। পুরুলিয়া জেলার পাখি প্রজাতি সংখ্যা ৩৯০, বিপন্ন পাখি প্রজাতি ১৪। বাঁকুড়া জেলার ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা ৩৮২ ও ১৭। (সূত্র: এভিবেস দ্য ওয়ার্ল্ড ডাটাবেস ২০১৯ ও বার্ড লাইফ ইন্টারন্যাশনাল)

স্থায়ী বাসিন্দা পাখিরা জনজীবনের আটপৌরে। পরিযায়ী পাখিরা দুর্লভ বলে ‘আইটেম’ মর্যাদা পায়। তায় আবার অতিথি। শীতের অতিথি মূলত। আমাদের জলাশয়েগুলির সঙ্গে তাদের এক নিবিড় ইকোলজিক্যাল সম্পর্ক। পুরুলিয়ার পক্ষীধারক জলাশয়গুলি শহর পুরুলিয়া, রেলশহর আদ্রা, আনাড়া ও গ্রামীণ অঞ্চলে। বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের বাঁধগুলো রাজাদের আমলের।

এই দুই জেলার বাইরে বঙ্গব্যাপী এরা আসে যায়। হলদে খঞ্জন, কালাজাং, মিটুয়া, বড়িহাঁস, বড় সরাল, ছোট সরাল, চখাচোখি, তুলিকা, রকমারি বক উত্তরবঙ্গ ও গাঙ্গেয় বাংলার আতিথ্য নেয়। সুদূর সাইবেরিয়া বা তিব্বত বা হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চল থেকে আগমন। জীবনচক্রের কোনও না কোনও অংশ জলে কাটায় বলে পরিযায়ী পাখিদের একটা অংশ সাধারণ ভাবে ওয়াটার বার্ড বা জলপাখি। ওয়েদার, কুট, ফাউল প্রভৃতি প্রজাতি পাখির প্রাচুর্য ও বৈচিত্র অনুসারে পাখির জলাশয়ের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক গুরুত্ব বাড়ে।

দূরান্তের মেহমানেরা এক নির্দিষ্ট পথে বাৎসরিক চক্রে নিজস্ব স্থায়ী বসতি প্রজনন ক্ষেত্র থেকে বা খাদ্যসন্ধানে যখন অন্য সম্পন্ন ক্ষেত্রে উড়ান দেয় সেই উড্ডয়ন পথকে বলে ফ্লাইওয়ে বা পরিযানতন্ত্র। এক একটি পরিযানতন্ত্রের সকল পাখি প্রজাতির প্রজনন পরিযান ও শীতযাপনকে বলে পপুলেশন ফ্লাইওয়ে। যাওয়া আসার এই উভয়স্থানেই তারা নিরন্তর যাপন নিশ্চিন্তি চায়। চায় অনুকূল পরিবেশ। খাদ্য, ডিম ফোটানো শাবক প্রতিপালনের নিশ্চয়তা।

পুরুলিয়া বাঁকুড়ার যে সব জলাশয়ে শীতের অতিথিদের আসা যাওয়া, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল আদ্রার সাহেব বাঁধ, শহর পুরুলিয়ার সাহেব বাঁধ, জয়পুরের রানিবাঁধ, ইন্দ্রবিলের কালিদহের জোড়। বাঁকুড়ার লালবাঁধ, যমুনাবাঁধ, কৃষ্ণ বাঁধ, কলাইজুড়ির বাঁধ প্রভৃতি। স্বল্প পরিচিত জলাশয়গুলি হল মধুকুণ্ডার বরন্তী, গোলামারা বাঁধ, আনাড়ার বাঁধ, বাবিরডির বাঁধ প্রভৃতি। এসব জলাসয়ের ও ইতিহাসগন্ধ আছে।

পুরুলিয়া ও বাঁকুড়া বন্যপ্রাণ সম্পন্ন। শয়ে শয়ে পাখি প্রজাতি। অধিকাংশই স্থায়ী বাসিন্দা। বিরল বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতি যেমন রয়েছে, দৃষ্টিনন্দন, সুরেলা পাখিরাও রয়েছে প্রাচুর্য নিয়ে। বান্দোয়ান, বাঘমুণ্ডি, অযোধ্যা, সিমলাপাল, জয়পুরের বনাঞ্চলে তাদের বসত। জেলাগুলিতে গবেষক ও পর্যবেক্ষকদের বিবরণ থেকে জানা যায় জেলা দু’টিতে পরিযায়ী পাখির প্রজাতি চল্লিশের কাছাকাছি। নয়-দশটি প্রজাতির প্রবল উপস্থিতি। যেমন, রাঙামুড়ি, বড় রাঙামুড়ি, গিরিয়া, বড় দিঘর, রাজহাঁস, ডাইখোল, মোট হাঁস, ভূতি হাঁস, কমন টিল প্রভৃতি। জলাশয়ে শীতজুড়ে ঝাঁকে ঝাঁকে সাঁতরে বেড়ায়। নীলচে, সবুজ, গোলাপি, মেটে, খয়েরি রঙের হাঁসের দল।

পরিযায়ী পাখিদের জীবন বিপদসঙ্কুল। পরিযান কালীন তাদের প্রতিকূল আবহাওয়া ও ক্লান্তিতে বিপন্ন হয় প্রায়শই। এ সব কারণে মৃত্যু হয় সহস্র পাখির। প্রধান সমস্যা আপাতত আবহাওয়া বদল জনিত কারণে পরিবর্তিত পরিবেশ তাদের বিনষ্ট প্রজনন ক্ষেত্র, নীড় বসত, শাবক প্রতিপালন আর খাদ্য উৎস। পাখিদের এই গোষ্ঠী জীবনকে অভিযোজিত করেছে যেন তাদের জীবনধারণের প্রাথমিক শর্তগুলো অক্ষুন্ন থাকে। কিন্তু তাদের উড়ান সরণির পরিবর্তিত পরিবেশ জনিত কারণে বসতি ও খাদ্যসংগ্রহে বাধা বা অপ্রাপ্তি পরিযান পথ সংক্ষিপ্ত বা রুদ্ধ করে। ফলত উপযুক্ত পরিবেশের অভাবে প্রজনন ঘাটতিতে নতুন প্রজন্মের সংখ্যা কমে য়ায়।

আমরা স্থানীয় সমস্যাগুলো দেখতে পাই। পুরুলিয়া-বাঁকুড়ার যে সব জলাশয়ে তাদের বসত সেগুলো কি খুব নিরাপদ? পুরুলিয়ার বরন্তীর জলাশয়ের সন্নিকটে স্পঞ্জ আয়রন কারখানার অবস্থান। আবার গ্রামীণ জলাশয়ের যেগুলিতে পরিযায়ী পাখিরা আসে নির্জনতার সুযোগে সেখানে চলে শিকার। শহরাঞ্চলের জলাশয়ের চতুর্দিকে সুউচ্চ নির্মাণ, তথ্য সম্প্রচারের টাওয়ার, নাগরিক কোলাহল, চোখ ধাঁধানো আলো আর অ্যামপ্লিফারারের শব্দত্রাস। অনাবৃষ্টিজনিত কারণে জলের স্বল্পতা, জলের তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়া, জলাশয়ের পরিবেশে বিশৃঙ্খলা, ফলশ্রুতি বিপন্ন পরিবেশ তন্ত্রে তাদের খাদ্যাভাব, শাবক প্রতিপালনে বিঘ্ন। ইকোট্যুরিজম সর্বদাই বিবেচনা প্রসূত নয়। গবেষকদের মতে, বিগত দশকে পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমেছে এক তৃতীয়াংশ। গ্রামীণ অঞ্চলেও তারা কমে যাচ্ছে। গ্রামীণ কৃষিক্ষেত্রে পেস্টিসাইডের আধিক্য হেতু পতঙ্গ, শামুক ইত্যাদি তার আর পায় না।

তবে আরেকটি বিশ্বব্যাপী বিপদ তাদের পৃথিবীর উষ্ণায়ন আবহাওয়া বদলজনিত কারণে তাদের প্রাথমিক আবাস খাদ্য উৎস ও শারীরবৃত্তীয় চক্রে আঘাত হেনেছে। প্রজনন ক্ষেত্রে অপরিণত শীতে বসন্ত সমাগম। ঋতু পরিবর্তনজনিত কারণে তাদের জীবনচক্রে বদল আসছে। শাবক সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সারা পৃথিবীতে প্রায় হাজার দু’য়েক পরিযায়ী পাখি প্রজাতি। এদের ৪০ শতাংশের সংখ্যা হ্রাস পাচ্ছে। বিপন্ন প্রজাতি দু’শো। মূল কারণ বসতি বিনাশ, উড়ালপথের বিশ্রাম বসতিতে প্রতিকূল পরিবেশ, মানবজনিত দূষণ ও নির্মাণ।

গুরুত্বপূর্ণ পরিযায়ী উড়ালপথ (ফ্লাইওয়ে) গুলো হল আফ্রিকা-ইউরেশিয়া (মধ্যপ্রাচ্য পান্থশালা), পূর্ব এশিয়া-অস্ট্রেলিয়া পথ (চিনে বিশ্রাম) ও আমেরিকা ফ্লাইওয়ে (উত্তর আমেরিকা-দক্ষিণ আমেরিকা সংযোগী পথ)। এই দুই জেলায় অতিথি পাখিরা আসে হিমালয়ের উপর থেকে। ট্রান্স হিমালয়ান। দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গে তাদের শীতযাপন। এই উড়ালপথটির নাম সেন্ট্রাল এশিয়া ফ্লাইওয়ে।

এ বার উড়ালপথের সংরক্ষণ জরুরি। এ পথ আন্তর্জাতিক। সমস্যার সমাধান হবে আন্তর্জাতিক প্রোটোকল অনুযায়ী। পাখিদের নিজস্ব জৈবনিক পরিযানতন্ত্রে সূর্য, নক্ষত্র, নক্ষত্র বিন্যাস, ভূ চৌম্বকক্ষেত্র আর দেহস্থ পরিযান সংবেদী তন্ত্রের আন্তঃক্রিয়া আছে। উড়ালপথের পরিবেশ বিকৃত হলে তাদের পরিযানতন্ত্রে ও জীবন যাপনের অর্জিত বাধা সুদূরপ্রসারী অভিশাপ নিয়ে আসে প্রজন্মে। তাই আন্তর্জাতিক সমন্বয় সাধনের প্রচেষ্টায় চলন্ত আন্তর্জাতিক চুক্তি (কনভেনশন অব মাইগ্রেটরি স্পিসিস, রামসর কনভেনশন ও ওয়াটার বার্ড এগ্রিমেন্ট প্রভৃতি) গুলিতে রাষ্ট্রের সক্রিয়তা বাঞ্ছনীয়।

লেখক সিধো কানহো বীরসা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Winter Migratory Birds Environment
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE