Advertisement
০৮ মে ২০২৪
ভোটযুদ্ধে ত্র্যহস্পর্শ
West Bengal Election Assembly2021

রাজ্যে সংখ্যালঘু ভোট ভাগ হলে শাসক দলের বিপদ বাড়বে

তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে জেতানো মুসলমানদের দায়িত্ব নয়।

প্রেমাংশু চৌধুরী
শেষ আপডেট: ০৭ জানুয়ারি ২০২১ ০০:০১
Share: Save:

আপনি তো মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসিয়ে বিজেপিকে সুবিধা করে দিচ্ছেন! অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন, যা এমআইএম নামে অনেক বেশি পরিচিত, তার প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়েইসিকে প্রায়ই এ কথা শুনতে হয়। তিনি একটাই জবাব দেন— তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ দলগুলিকে জেতানো মুসলমানদের দায়িত্ব নয়।

বিহারের ভোটের সময়ই আসাদুদ্দিন ওয়েইসি হুঁশিয়ারি দিয়েছিলেন, তিনি বাংলার ভোটেও নামবেন। তৃণমূল নেতৃত্ব তখনই প্রমাদ গনেছিলেন। তাঁদের আশঙ্কাই সত্যি হয়েছে। হায়দরাবাদ থেকে কলকাতায় পৌঁছে ওয়েইসি ফুরফুরা শরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকির সঙ্গে শলাপরামর্শ করেছেন। রাজ্যে বিজেপির দাপট যত বাড়বে, ৩০ শতাংশ মুসলিম ততই এককাট্টা হয়ে ঘাসফুলে ভোট দেবেন ভেবে নিশ্চিন্ত তৃণমূল নেতৃত্বের ঘুম ছুটেছে। এবং স্বাভাবিক ভাবেই উৎফুল্ল বিজেপি নেতৃত্ব।

বিজেপি-বিরোধী শিবিরে ফাটল থাকলে বিজেপির সুবিধা। বিজেপি-বিরোধী শিবিরের ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরলেও ফয়দা বিজেপিরই। উত্তরপ্রদেশে বিজেপি-বিরোধী ভোট এসপি, বিএসপি, কংগ্রেসের মধ্যে ভাগাভাগি হলে যোগী আদিত্যনাথের সুবিধা হয়। তেমনই মহারাষ্ট্র থেকে বিহারে আসাদুদ্দিন ওয়েইসি বিজেপি-বিরোধী শিবিরের ভোটব্যাঙ্কে ভাগ বসালেও নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের ফয়দা হয়। পশ্চিমবঙ্গেও তৃণমূলের মুসলিম-মতুয়া ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরিয়ে সেই ফয়দা কুড়োনোরই আশা করছে বিজেপি।

২০১৯-এর লোকসভা ভোটের ফল বলছে, লোকসভায় ৩০৩টি আসনে জিতলেও বিজেপি মাত্র ৩৭.৩৬% ভোট পেয়েছে। এনডিএ পেয়েছে ৪৫% ভোট। অর্থাৎ, বিজেপি তথা এনডিএ-র বিরোধীদের অনেক বেশি মানুষ ভোট দিয়েছেন। প্রায় ৫৫ শতাংশ। কিন্তু সেই ভোট কোনও একটি দলের ঝুলিতে পড়েনি। বিরোধী শিবিরের মধ্যে এই বিভাজনের সুফল দীর্ঘ দিন কংগ্রেস কুড়িয়ে এসেছে। এখন বিজেপি কুড়োচ্ছে। তার সঙ্গে রাজ্যে রাজ্যে বিরোধী শিবিরের ভোটব্যাঙ্কে বিভাজন থেকেও বিজেপির লাভবান হওয়াটা নতুন মাত্রা। কখনও বিজেপি নিজেই এই বিভাজন করছে। কখনও ওয়েইসির মতো কেউ। ফলে বিজেপিকে মোটের উপর অর্ধেক ভোট জেতারও চেষ্টা করতে হচ্ছে না।

মণ্ডল বনাম কমণ্ডলুর রাজনীতিতে বিজেপির প্রধান লক্ষ্য ছিল, জাতপাতের ভিত্তিতে সংরক্ষণের রাজনীতির মোকাবিলায় সমস্ত হিন্দু সমাজকে এক ছাতার তলায় আনা। রামমন্দির আন্দোলনের মাধ্যমে বিজেপি তাতে অনেকাংশে সফলও হয়েছে। কিন্তু তাতে জাতপাতের বিভাজন মুছে যায়নি। যাদব, দলিতের ভেদাভেদ মুছে গোটা হিন্দু সমাজ এককাট্টা হয়ে বিজেপির ছাতায় আশ্রয় নেয়নি। এখন বিজেপির রণকৌশল পাল্টে গিয়েছে। হিন্দুদের মধ্যেই নানা রকম বিভাজনকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি ফয়দা কুড়োচ্ছে।

বিজেপির এই ‘সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর পরীক্ষানিরীক্ষার সবচেয়ে বড় রসায়নাগার উত্তরপ্রদেশ। যাদব ও মুসলিমরা বরাবরই মুলায়ম সিংহ-অখিলেশ যাদবের ভোটব্যাঙ্ক। মায়াবতীর ভোটব্যাঙ্ক দলিতরা। কিন্তু সব দলিতই মায়াবতীর নিজের জাটভ বা চামার জাতির নন। আবার ওবিসি-দের মধ্যে যাদব ছাড়াও অন্যরা রয়েছেন। তাঁরা মনে করেন, মুলায়ম-অখিলেশ ক্ষমতায় এলে যাদবদেরই দাপট বাড়ে। যেমন অ-জাটভরা মনে করেন, মায়াবতীর রাজত্বে শুধু চামাররাই বুক চিতিয়ে ঘুরতে পারে। এই অ-যাদব ওবিসি ও অ-জাটভ দলিত ভোটব্যাঙ্ককে বিজেপি নিজের দিকে টেনে এনেছে। তা উচ্চবর্ণের ভোটের সঙ্গে যোগ হতেই বিজেপি উত্তরপ্রদেশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।

এক কথায়, বিজেপি-বিরোধী দলগুলি এককাট্টা না হতে পারায় এমনিতেই বিজেপি উত্তরপ্রদেশে সুবিধাজনক অবস্থানে ছিল। তার সঙ্গে বিরোধী দলের ভোটব্যাঙ্কও এককাট্টা রইল না। ২০১৪ ও ২০১৯-এর লোকসভা ভোট, ২০১৭-র বিধানসভা ভোটে বিজেপির জয়জয়কার এই অঙ্ক মেনেই। কিছু দিন আগের উত্তরপ্রদেশের সাতটি বিধানসভা উপনির্বাচনেও দেখা গিয়েছে যে, এসপি, বিএসপি ও কংগ্রেসের ভোটের যোগফল বিজেপির থেকে অনেক বেশি। কিন্তু বিরোধী শিবিরের বিভাজনের সুযোগ নিয়ে আদিত্যনাথই শেষ হাসি হেসেছেন।

কিন্তু গল্পের এখানেই শেষ নয়!

বিজেপির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে এত কাল কোনও রাজনৈতিক দলই ভাবেনি যে, তাদের মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে বিভাজন ঘটবে। বরং বিজেপি উল্টো দিকে থাকলে পুরো মুসলিম ভোটব্যাঙ্ক তাদের পক্ষেই থাকবে, এ কথা ভেবে বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বীরা নিশ্চিন্ত থাকত। এক সময় বিজেপি নেতারা দাবি করতেন, নরেন্দ্র মোদী তিন তালাক প্রথা রদ করায় মুসলিম মহিলারা বিজেপিকে ভোট দিতে শুরু করেছেন। কিন্তু সিএএ-এনআরসির বিরুদ্ধে মুসলিম মহিলারাই শাহিন বাগ আন্দোলনের মুখ হয়ে ওঠার পরে তাঁরা আর সেই দাবি করেন না। মোদী সরকারের দ্বিতীয় জমানার গোড়াতেই তিন তালাককে আইনি অপরাধের তকমা দেওয়া, সিএএ-এনআরসি, ৩৭০ রদ হয়। শীর্ষ আদালতের রায় রামমন্দিরের পক্ষে যায়। ফলে বিজেপি-বিরোধী শিবির ধরেই নিয়েছিল যে, মুসলিমদের মধ্যে বিজেপির প্রতি প্রবল অসন্তোষ তৈরি হয়েছে। অতএব মুসলিম ভোট বিজেপির বিরুদ্ধেই পড়বে। কিন্তু তার একাংশ যে কোনও মুসলিম রাজনৈতিক দলের ঝুলিতেও পড়তে পারে, তা বোধ হয় বিরোধী নেতানেত্রীরা আঁচ করতে পারেননি।

প্রথম ধাক্কা মহারাষ্ট্রে। ভীমরাও অম্বেডকরের নাতি প্রকাশ অম্বেডকরের দল বঞ্চিত বহুজন আঘাড়ির সঙ্গে জোট বেঁধে ময়দানে নামল ওয়েইসির এমআইএম। ২০১৯-এ প্রথমে লোকসভা নির্বাচন, তার পরে বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস-এনসিপি’র ভোটে ভাঙন ধরল। ওয়েইসি-অম্বেডকরের জোট প্রায় তিন ডজন আসনে তাদের হারের কারণ হয়ে উঠল। না হলে কংগ্রেস-এনসিপি শিবসেনাকে ছাড়াই সরকার গড়ে ফেলত।

এর পর বিহারের ভোট বহুচর্চিত। ওয়েইসির এমআইএম বিহারে অনগ্রসর শ্রেণির নেতা উপেন্দ্র কুশওয়াহার রাষ্ট্রীয় লোক সমতা পার্টি এবং আরও কিছু দলের সঙ্গে জোট তৈরি করে। সে জোটে মায়াবতীর বিএসপি-ও ছিল। মহারাষ্ট্রের মতো এই জোটও আরজেডি-কংগ্রেসের চিরাচরিত ভোটব্যাঙ্কে ভাঙন ধরিয়েছে। বিশেষত এমআইএম মুসলিম অধ্যুষিত বিহারের সীমাঞ্চলে পাঁচটি আসন জেতায় কংগ্রেসের আসন কমেছে। ফলে, তেজস্বী যাদবের মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে বসার স্বপ্ন অধরাই থেকে গিয়েছে।

এখানেই তৃণমূল নেতৃত্ব অশনিসঙ্কেত দেখছেন। ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে মাত্র ১০.২ শতাংশ ভোট পেয়েছিল। ২০১৯-এর লোকসভা ভোটে বিজেপির ভোট ৪০ শতাংশ ছাপিয়ে গিয়েছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রীর গদিতে থাকতে হলে তৃণমূলকে পুরো ৩০ শতাংশ মুসলিম ভোটই পেতে হবে। তৃণমূল কংগ্রেস ২০১৬-র বিধানসভা ভোটে ২১১টি আসন জিতেছিল। এর মধ্যে ৯৮টি আসনে মুসলিম ভোট নির্ণায়ক শক্তি। বিজেপি যদি এ সব আসনে একই সঙ্গে হিন্দু ভোটের মেরুকরণ এবং মুসলিম ভোটে ভাঙন ধরাতে পারে, তা হলে তৃণমূলের বিপদ। ঘোর বিপদ।

উত্তরপ্রদেশ, মহারাষ্ট্রে বিজেপি বিরোধী শিবিরের দলিত ভোটেও ভাঙন ধরিয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে তেমনই বিজেপি মতুয়াদের একটা অংশের ভোটও তৃণমূলের থেকে নিজেদের দিকে টেনে এনেছে। মতুয়াদের মধ্যে ৮০ শতাংশ নমশূদ্রের উপস্থিতি। রাজ্যের প্রায় ৭০টি বিধানসভা কেন্দ্রে ৪০ থেকে ৪৫ শতাংশ মতুয়া ভোট রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশ থেকে আসা মতুয়ারা নয়া নাগরিকত্ব আইন বা সিএএ-কে সমর্থন করেছেন। কিন্তু তাঁরা নিঃশর্ত নাগরিকত্ব চাইছেন। ভোটের আগে নয়া নাগরিকত্ব আইনের বিধিনিয়ম চূড়ান্ত করে তার ব্যবস্থা করা হলে, বিজেপি মতুয়াদের ভোট নিয়েও সুবিধাজনক অবস্থানে থাকবে।

বিজেপির প্রতিদ্বন্দ্বীদের এখন তাই তিন দিক থেকে বিপদ। এক, বিজেপির বিরোধীরা এককাট্টা না থাকলে বিজেপি ফয়দা তুলবে। পশ্চিমবঙ্গে যেমন তৃণমূল ও বাম-কংগ্রেস দুই ভিন্ন মেরুতে। দুই, প্রতিদ্বন্দ্বী দলের মধ্যে ভাঙন ধরলেও বিজেপি লাভবান হবে। যেমন, শুভেন্দু অধিকারীর তৃণমূল ছেড়ে বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় বিজেপির মনোবল এখন তুঙ্গে। এবং তিন, প্রতিদ্বন্দ্বীর ভোটব্যাঙ্কে বিভাজন থেকেও বিজেপি সুবিধা নেবে। উদাহরণ, ওয়েইসিদের মুসলিম ভোটব্যাঙ্কে বিভাজন।

এই ত্র্যহস্পর্শ সামলাতে পারলে তবেই বিজেপির সঙ্গে মোকাবিলা করা সম্ভব।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE