ফাইল চিত্র
চিনের সহিত সীমান্ত সংঘাত-পর্বে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বিবিধ আচরণ ও বক্তব্য লইয়া প্রশ্ন উঠিয়াছে। কিন্তু, ইহার মধ্যেও, গালওয়ানে নিযুক্ত সেনাবাহিনীর বিহার রেজিমেন্টের শৌর্য এবং আত্মত্যাগকে শুধুমাত্র বিহারের গর্বের বিষয় বলিয়া চিহ্নিত করিবার ঘটনাটি ঐতিহাসিক হইয়া রহিয়া গেল। রেজিমেন্টটির নামে বিহার থাকিলেও সেনাবাহিনীর অন্য রেজিমেন্টগুলির ন্যায় ইহাতেও যে গোটা দেশ হইতে সৈনিক নিয়োগ করা হয়, প্রধানমন্ত্রীর তাহা জানা না থাকিলে জানিয়া লইতে পারিতেন। দ্বিতীয়ত, গালওয়ান উপত্যকায় শুধু বিহার রেজিমেন্ট ছিল না— নিহত ২০ জন সৈনিক সেনাবাহিনীর ছয়টি পৃথক ইউনিট হইতে আসিয়াছিলেন। রাজ্যগত ভাবেও কেহ বঙ্গের বাসিন্দা, কেহ পঞ্জাবের, কেহ তামিলনাড়ু, কেহ তেলঙ্গানা, কেহ আবার বিহারের বাসিন্দা ছিলেন। জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদনের পূর্বে এই কথাটুকু জানিয়া লওয়া প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য ছিল। তাঁহার মন্তব্যে সীমান্তে নিহত সৈনিকদের স্মৃতির অপমান হইল— যাঁহারা বিহারের বাসিন্দা ছিলেন না, তাঁহাদেরও যেমন, বিহারের বাসিন্দাদেরও তেমনই। কারণ, ভারতে যদি একটিমাত্র প্রতিষ্ঠান প্রকৃতার্থে সর্বভারতীয় হইয়া থাকে, তবে তাহা সেনাবাহিনী। সেনার উর্দি গায়ে চড়াইবার সময় জওয়ানরা তাঁহাদের প্রাদেশিক পরিচিতিটি বিস্মৃত হন— তাঁহারা প্রত্যেকেই ভারতমাতার সন্তান, ইহাই তাঁহাদের পরিচয়। বিহারের জওয়ানরাও সীমান্তে রাজ্যের হইয়া লড়িতে যান নাই, দেশের হইয়া কাজে গিয়াছিলেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁহাদের সেই আত্মত্যাগের সম্মানরক্ষা করিতে ব্যর্থ হইলেন।
জওয়ান কেন, দেশের যে কোনও বাহিনীকে যে দেশের পরিচয়টিই প্রথম ও প্রধান হিসাবে মনে রাখিতে হয়— পঞ্জাব, দিল্লি, মণিপুর না বলিয়া নিেজর স্থানপরিচয় ‘ইন্ডিয়া’ বলিতে ও ভাবিতে হয়, ‘চক দে ইন্ডিয়া’ চলচ্চিত্রে হকি-প্রশিক্ষক শাহরুখ খান তাহা বুঝাইয়া দিয়াছিলেন। স্বাধীন ভারতেও বারংবার জোর দেওয়া হইয়াছে এই বিষয়টির উপর যে, সেনাবাহিনীর কোনও প্রাদেশিক পরিচয় থাকিতে পারে না, সেনা মাত্রেই দেশ-সেবক, অন্য কোনও সঙ্কীর্ণ পরিচিতির ঊর্ধ্বে। প্রধানমন্ত্রী মোদী সেই ভারতীয় জাতীয়তাবাদী ভাবনার বিরোধিতা করিয়া সেনাবাহিনীকে অসম্মান করিলেন, বলিলে ভুল হইবে না।
কেন বিহার রেজিমেন্টের গৌরবের আলোটি প্রধানমন্ত্রী কেবলমাত্র বিহারের উপরই ফেলিতে ব্যগ্র, অনুমান করা সহজ। বিহারে বিধানসভা নির্বাচন সমাসন্ন। নির্বাচনী প্রচারের স্বার্থে ইতিপূর্বে নরেন্দ্র মোদী যখন যে রাজ্যের প্রয়োজন, সেই রাজ্যকে মহিমান্বিত করিয়াছেন। ইতিপূর্বে সেনাবাহিনীকেও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করিয়াছেন— সিয়াচেনের সৈনিকদের রাজনৈতিক চিত্রকল্পটি তাঁহারই নির্মাণ। এই দফায় তিনি আরও এক পা আগাইলেন, একটি ভিন্ন লক্ষ্মণরেখা অতিক্রম করিলেন, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সেনাবাহিনীর গায়ে প্রাদেশিকতার রং চাপাইয়া দিলেন। তাঁহাদের রাজনীতি দেশাত্মবোধের রাজনীতি, এমন দাবি তিনি ও তাঁহার দল করিয়া থাকেন। কিন্তু নিজেদের সেই দাবি হইতে তিনি সরিয়া আসিলেন। দেশকে ভুলিয়া প্রদেশ রাজনীতির স্থান করিয়া দিলেন। আশঙ্কা জন্মাইতে পারে, যে দেশপ্রেমের জিগির তাঁহারা ফেরি করিয়া বেড়ান, তাহা প্রয়োজনে সঙ্কীর্ণ আইডেন্টিটি ও পরিচিতির সহিত যুক্ত করিতে তাঁহারা কিছুমাত্র পিছপা হইবেন না। দেশ ও দেশাত্মবোধ তাঁহাদের নিকট শুধুই রাজনৈতিক অস্ত্র— যত ক্ষণ তাহার ব্যবহার আছে, তত ক্ষণই তাহা মূল্যবান। ঘরে-বাহিরে আজিকার সঙ্কট পরিস্থিতিতে যেখানে প্রতিটি ভারতবাসীকে অভিন্নতা ও সমনিরাপত্তার বার্তা দেওয়া প্রধানমন্ত্রীর কর্তব্য, সেখানেও তাই তিনি সঙ্কীর্ণতা ও বিভাজনের রাজনীতি টানিয়া আনিতে পারেন অতি সহজে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy