Advertisement
E-Paper

নাজিব আহমেদ কোথায় গেলেন

নাজিব আহমেদ মাইক্রোবায়োলজির ছাত্র হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাত্র সাত দিন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই ‘মাহি মান্ডভি হস্টেল’-এ। তার পরই অক্টোবরের ১৪ তারিখ ‘এবিভিপি’ অর্থাৎ ‘অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ’-এর ছাত্রদের হাতে তিনি শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হন বলে অভিযোগ।

সোনালী দত্ত

শেষ আপডেট: ০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০০:০০

রোহিত ভেমুলা আত্মহনন করেছেন ২০১৬ সালে। ওই বছরই স্রেফ উধাও হয়ে গিয়েছেন আমাদের এক সহনাগরিক নাজিব আহমেদ। ভেমুলার মৃতদেহ তবু তাঁর মা’র কাছে শেষ আদরটুকু পাওয়ার জন্য পৌঁছতে পেরেছিল। নাজিবের মা সন্তানকে শেষ বার স্পর্শ করার সুযোগটুকুও পাননি। এমনকি এই সিদ্ধান্তেও আসতে পারেননি, তাঁর ছেলে আদপেই বেঁচে আছে না নেই। মেধাবী ছাত্র নাজিবের এই ‘ভ্যানিশ’ হয়ে যাওয়া শুধু তাঁর পরিবার বা তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষতি, এমনটা নয়। সেই তরুণের জীবনে ঠিক কী ঘটেছিল বা এখন তিনি কোথায়, কেমন আছেন বা সত্যিই আছেন কি না— এই সব প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার অধিকার প্রত্যেক ভারতবাসীর আছে।

নাজিব আহমেদ মাইক্রোবায়োলজির ছাত্র হিসাবে যোগ দিয়েছিলেন দিল্লির জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ে। মাত্র সাত দিন ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরেই ‘মাহি মান্ডভি হস্টেল’-এ। তার পরই অক্টোবরের ১৪ তারিখ ‘এবিভিপি’ অর্থাৎ ‘অখিল ভারতীয় বিদ্যার্থী পরিষদ’-এর ছাত্রদের হাতে তিনি শারীরিক ভাবে নিগৃহীত হন বলে অভিযোগ। ১৫ তারিখ থেকে নাজিবকে আর কেউ কখনও দেখেননি। নাজিবের মা ফতেমা আহমেদ জানিয়েছেন, ছেলের কাছেই তাঁরা আসছিলেন। আসার পথে কথাও হয়েছে দু’জনের। এসে তিনি ছেলেকে আর দেখতে পাননি। হস্টেলে তাঁর ঘরের সামনের সিঁড়িতে নাজিবের হোম স্লিপার বিক্ষিপ্ত ভাবে পড়ে থাকতে দেখেছেন। তিনি এবং জেএনইউয়ের ছাত্র সংগঠন বার বার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে গিয়ে তদন্তের আবেদন ও দাবি জানিয়েছেন। যারা নাজিবকে মেরেছিল তাদের শাস্তি হয়নি, কর্তৃপক্ষ নাজিবের উপরেই মারামারি করার অভিযোগ এনেছেন। নাজিবের মায়ের বক্তব্য, তাঁর ছেলে তেমন স্বভাবের নয়। আর যদি নাজিব কাউকে ‘চড়’ মেরেই থাকেন, তবে ভারতের সংবিধান চড়ের শাস্তি হিসাবে ঠিক কী শাস্তি বিধান করেছে, তিনি জানতে চান। পরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরাও প্রশ্ন তোলেন, কর্তৃপক্ষ কেন নাজিবের নিগৃহীত হওয়ার ঘটনা চেপে যাচ্ছেন?

নাজিবের মা দিল্লি পুলিশের কাছে অভিযোগ জানান। দিল্লি হাইকোর্টে ‘হেবিয়াস কর্পাস’ পিটিশন ফাইল করেন। হাইকোর্ট পুলিশের তদন্তে বার বার অসন্তোষ প্রকাশ করে। নাজিবের সম্পর্কে তথ্য দিতে পারলে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘোষিত হয়। পুরস্কারের অর্থমূল্য পরে দশ লক্ষ করা হয়। পরিবার আর ছাত্র বিক্ষোভে বিশ্ববিদ্যালয় উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। তাই ‘সিট’ গঠিত হয়। কিছুতেই কাজ হয়নি। ক্ষোভ প্রকাশ করলে দিল্লি পুলিশ কী আচরণ ফতেমার সঙ্গে করেছে, কী ভাবে তাঁকে চ্যাংদোলা করে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, মিডিয়ার দৌলতে তা সারা দেশ দেখেছে। ২০১৭ সালের মে মাসে নাজিবের তদন্তের ভার সিবিআইকে দেওয়া হয়। তারা প্রথমেই হাইকোর্টকে জানায়, দিল্লি পুলিশ কী ভাবে এক অটো ড্রাইভারকে সাক্ষ্য দিয়ে বলতে বাধ্য করে, যে তিনি নাকি ওই দিন নাজিবকে জামিয়া মিলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে নামিয়ে দিয়ে আসেন। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম উল্লেখ সম্ভবত এই কারণেই, যে হারিয়ে যাওয়া মানুষটির নাম নারায়ণ নয়, নাজিব।

আমাদের ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর নির্মাতা এবং তাঁদের সাঙ্গোপাঙ্গরাও চুপ করে ছিলেন না। প্রথমে প্রচার করা হল, নাজিব ডিপ্রেশনে ভুগতেন। অ্যান্টি ডিপ্রেশন পিল নিতেন। এ কথা বাকি সকলে জানেন, নাজিবের পরিবার ছাড়া! সে কাহিনি বাজারে চলল না। তখন আনা হল আরও মারাত্মক এক অভিযোগ। নাজিব নাকি আইসিস-এ নাম লিখিয়েছেন। এক বিজেপি নেতা ও কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর অনুগামী হিসাবে নিজেকে দাবি করা এক ব্যক্তির সোশ্যাল মিডিয়ার পাতায় ফুটে উঠল, “সেই জেএনিউ ছাত্র নাজিবের কথা মনে করুন, যে নিখোঁজ। বিজেপি/আরএসএস এবং সঙ্ঘ পরিবারের নামে অভিযোগ আনা হচ্ছিল এই অপহরণ বা হত্যার দায়ে।... সে নাকি এক নির্দোষ সংখ্যালঘু! এখন তার যোগ পাওয়া গিয়েছে আইসিস-এর সঙ্গে।” নাজিব নাকি তাঁর মাকে চিঠি লিখে জানিয়েছেন, তিনি আর এই দেশে থাকতে চান না। তিনি ‘জিহাদি’ হয়েছেন। এই পোস্ট মিডিয়ায় ঝড় তুলেছিল। শেয়ার করেছিলেন সঙ্ঘ পরিবারের নামজাদা ঘনিষ্ঠরা। পরে বলা হয়, এ নাজিব সে নাজিব নন। ইনি কেরলের অধিবাসী। কিন্তু তত দিনে সেই পোস্ট পৌঁছে গিয়েছে ঘরে ঘরে। এক দিকে এমন অসংখ্য গুজব, মিথ্যাচার, ক্ষেত্রবিশেষে অস্বাভাবিক নীরবতা, অপর দিকে বার বার হাইকোর্টের অসন্তোষ, ছাত্রবিক্ষোভ, পরিবারের হাহাকার। সিবিআই তদন্ত চালাচ্ছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক কোণে অনুসন্ধানকারীরা পৌঁছে গিয়েছিলেন। তবে সবই দেরিতে। যেমন সিবিআই কেস হাতে নেওয়ার আড়াই মাস পরে নাজিবের মোবাইল ফরেন্সিক-এ পাঠায়। পরীক্ষার ফল জানা যায় আরও ছ’মাস পরে। এই ভাবে সময় এগিয়ে চলে, প্রতিবাদ স্তিমিত হয়ে আসে, বিশ্ববিদ্যালয় আগের ছন্দে ফিরে আসে, নাজিব ক্রমশ বিস্মৃতির আড়ালে চলে যেতে থাকেন। তার পর গত অক্টোবরে সিবিআই কোর্টকে জানায়, নাজিবের হারিয়ে যাওয়ার কারণ হিসাবে কোনও অপরাধের চিহ্ন পাওয়া যায়নি। অতএব ৮ অক্টোবর কেস ক্লোজ় করে দেওয়ার প্রার্থনা মঞ্জুর হয়ে যায়।

আমাদের দেশ বিরাট। কত মানুষই তো এ দেশে হারিয়ে যান, অনুসন্ধান চলে, প্রমাণের অভাবে খাতা বন্ধ হয়ে যায়। তবু নাজিবের হারিয়ে যাওয়াটা অনেক আলাদা। নাজিব এ দেশে বড় হয়েছেন কিন্তু দেশটা কি ঠিক তাঁর ছিল? এই মুহূর্তে নাজিবদের কি কোনও দেশ আছে?

Najeeb ahmend JNU Jawaharlal Nehru University
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy