Advertisement
E-Paper

মানুষ নয়, কথা বলছে মুখোশ

প্রথম নরেন্দ্র মোদী সরকার চেষ্টা করেছিল এই সব তথ্য অগ্রাহ্য করতে। তার ফলে সরকার এখনও দেশের মানুষজনকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন ভাবে জানাতে পারেনি বিমুদ্রাকরণ ও জিএসটি কেন করা হয়েছিল ও করার ফলে অর্থনীতির কী হাল হয়েছে।

দেবেশ রায়

শেষ আপডেট: ১১ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ০০:০৭

ক্ষেড়নাট্য বলে একটি শব্দ ব্যবহৃত হত। তার অর্থ কুৎসিত, নিষ্ঠুর কোনও আচরণকে বা উচ্চারণকে গলার জোরে প্রতিষ্ঠা করা। শেষ লোকসভা ভোটে তৈরি নতুন কেন্দ্রীয় সরকার দেশের অভ্যন্তরীণ সঙ্কটে ক্রমেই সেই ক্ষেড়নাট্য তৈরি করে চলেছেন।

কাছাকাছি সময়েই রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের একটা রিপোর্ট বার হল। ন্যাশনাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল অফিসের এপ্রিল-জুন ত্রৈমাসিকের সংখ্যা-পরিসংখ্যানও বার হল। এই দুইয়ের মধ্যে কোনও প্রাতিষ্ঠানিক সংযোগ নেই। এই সংখ্যা-পরিসংখ্যাকে খাতির করা হয়। সরকারি পদাধিকারীরা ও অর্থনীতিবিদরা এই সব রিপোর্ট থেকে অর্থনীতি-রাজনীতির হাওয়া-আবহাওয়া বোঝেন। একটা পার্লামেন্ট-চালিত গণতন্ত্রের ক্ষেত্রে এই রিপোর্টগুলো নিয়ে অমাত্যরা কী বলছেন ও অনমাত্যরা কী বলছেন, সেটা গণতন্ত্রের পক্ষে খুব জরুরি।

প্রথম নরেন্দ্র মোদী সরকার চেষ্টা করেছিল এই সব তথ্য অগ্রাহ্য করতে। তার ফলে সরকার এখনও দেশের মানুষজনকে পরিষ্কার ও পরিচ্ছন্ন ভাবে জানাতে পারেনি বিমুদ্রাকরণ ও জিএসটি কেন করা হয়েছিল ও করার ফলে অর্থনীতির কী হাল হয়েছে। কিন্তু সরকার পার্লামেন্টকে তথা দেশকে তা না জানানোয় ভোটাররা কোনও দোষ দেখেননি। বরং তাঁরা এই সব কিছুকে নতুন, সাহসী ও উদ্যমী মনে করেছেন, যার ফলে ‘অচ্ছে দিন’ সত্য হয়ে উঠবে। ভোটের মুখে পাকিস্তানের সঙ্গে একটা বিরোধাভাস তৈরি হওয়ায় এ বারের ভোটে মোদী সরকারের প্রতি বা ব্যক্তিগত স্তরে নরেন্দ্র মোদীর প্রতি বা মোদী-শাহ নেতৃত্বের প্রতি আস্থাই দেখা গিয়েছে। ভোটের পরিসংখ্যান থেকে বিজেপি, কেন্দ্রীয় সরকার বা নরেন্দ্র মোদী বা মোদী-শাহ যৌথ নেতৃত্ব এই শিক্ষা নিয়েছেন। তার থেকেই এই রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেড়নাট্য তৈরি হচ্ছে। সেই শিক্ষা থেকেই তাঁদের চিৎকৃত সব ক্রিয়াকর্ম অদ্ভুত থেকে উদ্ভট হচ্ছে।

স্বাধীনতা লাভের পর থেকে আমাদের দেশের রাজ্য সংখ্যা বাড়তে থাকে, কেননা নানা স্থানীয় ঘটনা জাতীয় প্রাধান্য পেতে শুরু করে। অন্ধ্রপ্রদেশ গঠন দিয়ে শুরু। তার পর নর্থ-ইস্ট ফ্রন্টিয়ার এজেন্সি বলে যে একটি প্রশাসনিক ব্যবস্থা ছিল, তা থেকে উত্তর-পূর্বের কতকগুলি রাজ্য তৈরি। দ্বিতীয় নরেন্দ্র মোদী সরকার ক্ষমতায় এসেই সেই প্রক্রিয়া থামিয়ে উল্টো প্রক্রিয়া শুরু করলেন। মঞ্চের ম্যাজিশিয়ান যেমন আপনাকে একটা তাস তুলে নিতে বলে, সেই তাসটাকেই আপনার মাথা থেকে বা হাত থেকে বার করে আনেন, তেমনই জম্মু-কাশ্মীর বলে রাজ্যটিকে কেন্দ্রীয় সরকার তুলে দিলেন। একটা রাজ্য কমালেন। ছিল একটা রাজ্য, হয়ে গেল একটা শূন্য।

যাঁরা বিক্রির জন্য বিভিন্ন জিনিস তৈরি করেন ও সেগুলো তাড়াতাড়ি বিক্রি করে বাজারটাকে সচল রাখেন, তাঁরা তাঁদের কর্মী ছাঁটাই শুরু করলেন। ইংরেজিতে এগুলিকে বলে ‘ফাস্ট মুভিং কনজ়িউমার গুডস’। বিস্কুট, চা-পাতি, মুদির দোকানের জিনিসপত্র— এর মধ্যে পড়ে। একটি লেখা থেকে জানলাম, এক বড় সংস্থা এই সব অ-অনিবার্য ভোগ্যপণ্য বিক্রিতে বাজারে প্রথম সারিতে ছিল। তারা তাদের ১০,০০০ শ্রমিককে ছাঁটাই করল। তারা বলল— লোকে কিনছেন না, বাজারে খদ্দের নেই। মানুষজনের হাতে পয়সা নেই। সরকার বলে দিল ও ঘোষণা করে দিল— সরাসরি বিদেশি মূলধন এখন ভারতে খাটানো যাবে। অর্থমন্ত্রী এত জোর গলায় এটা ঘোষণা করলেন যে মূল কথাটা উল্টে গেল— অভাবটা মূলধনের নয়, অভাবটা খদ্দেরের। খদ্দের কে? যাঁর কাছে কেনার টাকা আছে। টাকা আসবে কোত্থেকে? কামাই থেকে। ‘কামাই’ শব্দটিতে দু’টি অর্থ একটা শব্দ তৈরি করেছে। ‘কাম’ করলে যে মজুরি আসে সেটাই ‘কামাই’। দিনমজুরদের
মুখে শোনা যায়, ‘কামাইয়ে বেরোচ্ছি’। মারুতি-সুজ়ুকির মতো সংস্থা ৩,৫০,০০০ কর্মীকে ছাঁটাই করল। সংস্থার ‘কামাই’ কমে গিয়েছে। তারা লোক রাখবে কেন!

সরকারের বক্তব্য, সরকারই গাড়ি কিনে নেবে। সরকার প্রধানতম খদ্দের হয়ে তো ‘অ্যাম্বাসাডর’ গাড়ির কারখানা বসিয়েছিল। সরকারই যদি একমাত্র ক্রেতা হয়, তা হলে সেটা কি ‘শিল্প’ হয়? আর এখন ভারত তো চার চাকা, তিন চাকা, দু’চাকা-র উঠতি বাজার। সেই উঠতি বাজারে যদি লোকের হাতে টাকা না খেলে তা হলেই যে মূলধনের বাজার তৈরি হয়, তাকেই বলে ‘ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম’। সেই ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়ম বহু সাবেক ব্যাপার। কয়েকশো বছরের। সিবিআই আর ইডি তদন্ত করছে সারদা, নারদের অভিযুক্তদের। আবার সঙ্গে সঙ্গে সরকার নিজেই ক্রোনি ক্যাপিটালিজ়মের রাস্তা খুলে দিচ্ছে।

রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়া কেন্দ্রীয় সরকারেরই সম্পত্তি। সরকারের দরকার থাকলে রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ককে তার রিজ়ার্ভ থেকে টাকা দিতেই হবে। সেই দেওয়াটা হবে ব্যাঙ্কিংয়ের নিয়ম মেনে। সরকারের প্রয়োজনে নয়। ১.৩৬ লক্ষ কোটি টাকা সরকার রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্কের কাছ থেকে নিয়েছে। সেই টাকা তো খরচা হবে বাজেটে যে ঘাটতি পাহাড়-প্রমাণ হয়ে উঠেছে তা পূরণ করতে, আর কয়েকটি ব্যাঙ্ককে মিলিয়ে এক-একটা বড় ব্যাঙ্ক বানিয়ে তুলে সরকারের সেই নতুন ব্যাঙ্কগুলিকে ভর্তুকি দিতে— যাতে লোকে ধার করতে পারেন। ২০০৭-০৮ সালে ওবামাকে কত তিক্ত ভাষায় নিন্দা করে এমনই খেসারত দিতে হয়েছিল ফেডারাল রিজ়ার্ভ থেকে। তাতে আমেরিকার মতো ধনীতম দেশের সঙ্কট কিন্তু মেটেনি, বরং বেড়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প এখন আমেরিকা থেকে আমেরিকানদের তাড়িয়ে আমেরিকার অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে চাইছেন।

তা হলে বলতে পারি, আমাদের নরেন্দ্র মোদী সরকার আমেরিকার পথ হুবহু নকল করে বাঁচাতে চাইছে ধনতন্ত্রকে। আমেরিকার পক্ষে ভারতের বাজার শুধু দরকার নয়। নিতান্ত প্রয়োজন। ভারতের আমেরিকা হয়ে ওঠাটাও নিতান্ত সর্বনাশ। সর্বনাশের সময়ই ক্ষেড়নাট্যের উপযুক্ত সময়। নরেন্দ্র মোদীর দ্বিতীয় পর্যায় তাই এমন মুখোশে ভরা। মানুষের স্বরে কথা হচ্ছে না। কথা বলছে মুখোশ।

Narendra Modi BJP
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy