Advertisement
১৯ মে ২০২৪
প্রবন্ধ ১

কাশ্মীর থেকে ছত্তীসগঢ়, মোদী কি পথ হারিয়েছেন?

তখন কারগিল যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নাণ্ডেজের সঙ্গে সেনা চপারে গিয়েছি কারগিলে। ত্রিশ হাজার ফুট উপরে একটি বাঙ্কারে বন্দুক তাক করে নির্বাক বসেছিল এক সেনা জওয়ান।

ক্ষোভ: নিরাপত্তা বাহিনীর দমন নীতির প্রতিবাদে সক্রিয় তরুণী, লালচক, শ্রীনগর, ২৪ এপ্রিল। ছবি: পিটিআই

ক্ষোভ: নিরাপত্তা বাহিনীর দমন নীতির প্রতিবাদে সক্রিয় তরুণী, লালচক, শ্রীনগর, ২৪ এপ্রিল। ছবি: পিটিআই

জয়ন্ত ঘোষাল
শেষ আপডেট: ০৩ মে ২০১৭ ০০:৪০
Share: Save:

তখন কারগিল যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নাণ্ডেজের সঙ্গে সেনা চপারে গিয়েছি কারগিলে। ত্রিশ হাজার ফুট উপরে একটি বাঙ্কারে বন্দুক তাক করে নির্বাক বসেছিল এক সেনা জওয়ান। দুপুরের ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুর। সেই জওয়ানকে কথা বলিয়ে জানতে পেরেছিলাম, কী ভয়ঙ্কর কষ্টে আছে মানুষটি। নীচে শহর থেকে সেনা-ট্রাকে করে জওয়ানদের জন্য শুকনো খাবারের প্যাকেট আসার কথা। বেশ কিছু দিন ধরে আসছে না। রাতের বেলা অন্ধকারে বসে থাকে জওয়ানটি। আলো জ্বললেই পাকিস্তান গোলাবর্ষণ শুরু করছে। অন্ধকারে বাঙ্কারে খুব মশার উপদ্রব। ওডোমসের টিউবও আসে। তাও আসছে না। কানাঘুষো শোনা যাচ্ছে, পাকিস্তান ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাপ্লাই লাইন বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। জাতীয় সড়কে চলছে গোলাবর্ষণ।

খুব রেগে গেলেন জর্জ ফার্নাণ্ডেজ। কেরোসিন জ্বালিয়ে চা করে দিয়েছিল ওরা। কেরোসিনের গন্ধ মাখা গরম চা খেতে খেতে জর্জ সেনাপ্রধানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, অবিলম্বে চপারে খাবার আর ওডোমস পাঠাতে। সেনাপ্রধান তস্য অধস্তনকে বললেন। তস্য তস্যকে।

ক’দিন আগেই দেখলাম, আধা-সামরিক বাহিনীর এক জওয়ান ফেসবুকের মাধ্যমে প্রচার করেছেন, কী রকম বাজে পোড়া শক্ত রুটি খেতে দেওয়া হচ্ছে তাঁদের। নিজের স্ত্রীকে সেই রুটির ছবি তুলে জানিয়েছিলেন ফেসবুকে। তার পর ভাইরাল সেই দৃশ্য। সরকার বাহাদুর ক্ষিপ্ত। জওয়ান শৃঙ্খলা ভেঙেছে। সংবাদমাধ্যম জাতীয়তাবিরোধী কাজ করছে। কিন্তু সেনা, আধা-সেনা বাহিনীর জন্য বরাদ্দ খাবারের গুণগত মান এই ঘটনার পর বাড়ল কি না, আম আদমি তা আজও জানে না।

লালুপ্রসাদ যাদব এক বার বলেছিলেন, ‘হামারা রাজনীতি মে বহুত পলিটিকস হ্যায়।’ অমিত শাহ যে দিন নকশালবাড়িতে পৌঁছে মমতার বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করলেন, সে দিনই বিজেপি শাসিত রাজ্য ছত্তীসগঢ়ে মাওবাদীদের হাতে নিহত হলেন ২৫ জন জওয়ান। অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, তখন সন্ত্রাস হলেই সনিয়া গাঁধীর কংগ্রেস সরকারের নৈতিক ইস্তফা দাবি করত। ইউপিএ যুগে মনমোহনেরও ইস্তফা দাবি করা হত। এখন ক্ষমতাসীন ২৮২টি আসনে বিজয়ী শাসক দল এবং তার জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। প্রেক্ষাপট তাই বদলে গিয়েছে। আপাতত আমরা সার্জিকাল স্ট্রাইক-এর স্বপ্নমদির নেশায় বুঁদ। দায়ী পাকিস্তান। দায়ী ইসলামিক জেহাদির মৌলবাদ। দায়ী জাতীয়তাবাদ ও সেনা-বিরোধী শক্তি, মাওবাদী কাপুরুষতা।

টেলিভিশনের পর্দায় দেখলাম, আধুনিক প্রজন্মের কাশ্মীরি মেয়েরা পাথর ছুড়ছে ভারতীয় সেনা ও আধাসামরিক বাহিনীকে লক্ষ্য করে। শ্রীনগরের এই ফুটেজ দেখে ভারতের জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী হয়তো বলবেন, এই সব বালিকাদের পিছনে রয়েছে পাকিস্তানি প্ররোচনা। গভীর ষড়যন্ত্র। জেহাদি-জঙ্গি সংগঠন এই সব বিক্ষোভের জন্য নগদ সাহায্য দিচ্ছে, এ হল বিশ্ব সন্ত্রাসের বাজার অর্থনীতি। অতএব ঘটনার মিছিল। সেনা ছাউনিতে পাক-হানা, কুপওয়ারা-উরি।

কাশ্মীর হোক অথবা মাওবাদী সমস্যা, মোদী তিন বছরেই সমাধান করে দেবেন, এমনটা প্রত্যাশা করি না। কিন্তু সমাধানের অভিমুখটা কি ঠিক? কাশ্মীরকে ঘিরে দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সংঘাত রয়েছে। সীমান্ত বিতর্ক আছে। তাই মাওবাদী সমস্যার সঙ্গে কাশ্মীর সমস্যার তুলনা করি না। কিন্তু বীরত্ব প্রদর্শনের এই প্রাচীন ক্ষয়িষ্ণু রণকৌশল কি এখনও বদলানোর সময় আসেনি? এই ডাণ্ডা দিয়ে ঠান্ডা করে দেওয়ার নীতিতে সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না। এটা বোঝার সময় এসেছে।

অটলবিহারী বাজপেয়ী কিন্তু আলোচনা ও সন্ত্রাস দমন, দু’টিকেই একসঙ্গে চালাতেন। হুরিয়তই হোক বা মাওবাদী, বাজপেয়ী কথা বলতেন। স্থানীয় রাজনৈতিক শক্তি এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটা গণতন্ত্রের আবহ তৈরি করা হত। কাশ্মীরের মানুষের কাছে একটা ‘ইনসানিয়ত’, একটা মানবিক মুখ, তুলে ধরার প্রচেষ্টা ছিল। বাজপেয়ীর মনে হয়েছিল, কাশ্মীরিয়তের সত্তা ভারতীয় সত্তা থেকে বিচ্ছিন্ন যাতে না হয়, তার জন্য এই মানবিক দিকটিও গুরুত্বপূর্ণ। মাওবাদী সমস্যা সমাধানে একটি অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা সবাই বলেন। কিন্তু গত তিন বছরে তার বাস্তবায়ন দেখলাম কোথায়?

ঠগ বাছতে ভারতবর্ষ উজাড় হয়ে যাচ্ছে। ছত্তীসগঢ়ে সিআরপিএফ জওয়ানদের উপর মাওবাদী হামলা। সেখানকার গ্রামের রাস্তা নির্মাণের কাজ চলছে গত কয়েক দশক ধরে। অভিযোগ, স্থানীয় ঠিকাদার এবং তথাকথিত কিছু মাওবাদী মিলে সরকারি টাকায় বনমহোৎসব করে চলেছে, রাস্তার নির্মাণ সেই তিমিরেই। মাওবাদী কার্যকলাপও যেখানে ছিল সেখানে। এখনও এ রাজ্যে তাদের দাপট। কখনও অমুক গোষ্ঠী আবার কখনও তমুক গোষ্ঠী। রিগ্রুপিং।
নতুন নতুন নামকরণ, নতুন নতুন গোষ্ঠী। কিন্তু সেই যে মাওবাদী সন্ত্রাস শুরু হয়েছে, তার অবসান কোথায় হল?

দেখুন, মমতা বন্দোপাধ্যায়ের রাজনীতির সমর্থক আমি আপনি না-ও হতে পারি। কিন্তু এ কথা অস্বীকার করব কী করে যে জঙ্গলমহলে মাওবাদী দৌরাত্ম্য দমন করতে মমতা সফল হয়েছেন। শুধু জঙ্গলমহল নয়, দার্জিলিংয়ে বিচ্ছিন্নতাবাদী সন্ত্রাসকে আপাতত শক্ত হাতে দমন করেছেন। মমতা এক দিকে কিষেনজির মতো গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব ও বহু জঙ্গিকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে কঠোরতা প্রদর্শন করেছেন, আবার অন্য দিকে মমতার স্পর্শ দিয়ে তাদের উন্নয়ন ও শান্তি আলোচনা, আত্মসমর্পণের পরিসরকেও সক্রিয় রেখেছেন। সন্ত্রাস দমন নিয়ে কাশ্মীর থেকে ছত্তীসগঢ়— বিজেপির রণহুঙ্কার আছে, কিন্তু কেবল হুঙ্কারই আছে। পশ্চিমবঙ্গে এ ব্যাপারে মমতা বেশি সফল।

এক সুদীর্ঘ গ্রীষ্মকাল আসছে। এই সময়ই পাক জঙ্গি অনুপ্রবেশ বাড়ে। বাড়ে মাওবাদী সন্ত্রাসও। এই রকমই এক গ্রীষ্মে কারগিলের আগ্রাসন হয়েছিল। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিটাও ভারতের পক্ষে খুব অনুকূল নয়। চিন আরও আক্রমণাত্মক। আমেরিকার সামরিক সহায়তা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত ভারত কতটা পাবে জানি না। কিন্তু গত তিন বছরে বিশ্বের দরবারে পাকিস্তানের কৌশলগত পরিসর বেড়েছে বই কমেনি। সেনা বা আধা-সামরিক বাহিনী পাঠিয়ে দমন করার নীতি ব্যর্থ হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অরাজি মোদী সরকার। প্রয়োজন ছিল কাশ্মীরের উন্নয়ন। গত সত্তর বছরে কাশ্মীরের রাজনৈতিক স্বাধীনতা নিয়ে অনেক তর্কবিতর্ক হয়েছে। কিন্তু কাশ্মীরের যুবকদের শিক্ষা ও চাকরির ব্যবস্থা কতখানি হয়েছে?

অতীতেও সব প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের কথা বলেছেন। সে কাশ্মীরেরই হোক বা মাওবাদী এলাকার। আর্থিক প্রস্তাব ঘোষণা করেছেন। উন্নয়নের জোয়ার আসবে, এই বিশ্বাস নরেন্দ্র মোদীর প্রতি বহু মানুষের এখনও রয়েছে। কিন্তু বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া হবে না তো? প্রয়োজন মানুষের সঙ্গে মানুষের বিভেদ ঘোচানো। তার উপায় একটাই, অন্য মানুষটিকে জানা। তার জন্য চাই কথোপকথন। সে আলোচনার প্রক্রিয়াই যদি স্তব্ধ হয়ে যায়, তবে সন্ত্রাসের সমস্যা সমাধানের চিত্রনাট্যটি রচনা হবে কী ভাবে?

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Narendra Modi Terrorism
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE