সহযাত্রী: ভারত মহাসাগরে জাপানি সাবমেরিনে ওঠার আগে আবিদ হাসান (বাঁ দিকে) ও সুভাষচন্দ্র বসু, ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩।
জনৈক অনুরাগী পাঠক টেলিফোনে অভিযোগ জানালেন আমি কিছু দিন হল কোনও লেখা লিখছি না। পর দিন ছয়টি হৃষ্টপুষ্ট খাতা এবং ছয়টি কলম আমার বাড়িতে পৌঁছে গেল। আমি যে ঠিক কাগজ-কলমের অভাবে লেখা লিখছিলাম না, তা অবশ্য নয়। চার দিকে দেশের এবং বিশ্বের দ্বন্দ্ব-দীর্ণ চেহারা দেখে নিরুৎসাহ বোধ করছিলাম। মানুষ মানুষের প্রতি কত নিষ্ঠুর হতে পারে, তা-ও কিনা ধর্মের নামে! মহাপুরুষরা বলেছেন হতাশ হতে নেই, আর মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। এই সময়ে এক জনের কথা আমার বার বার মনে পড়ছিল, তাঁর নাম আবিদ হাসান। ইউরোপ আর এশিয়াতে নেতাজির বিশ্বস্ত সহযোগী। তাঁর দীর্ঘ নব্বই দিন ধরে সাবমেরিন যাত্রার এক মাত্র সঙ্গী আবিদ হাসানের কাছে বসে সে সব দিনের গল্প শোনার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। বড় সুন্দর গুছিয়ে বলতেন তিনি। বিচিত্র সব কাহিনি মনকে নাড়া দিয়ে যেত। আজকের দিনে বিশেষ মনে পড়ে, নেতাজির কাছে তিনি কেমন বকুনি খেয়েছিলেন, সেই কথা।
অবশ্য নেতাজির কাছে বকুনি মাঝে মাঝেই তাঁর কপালে জুটত। সিঙ্গাপুরের বাড়িতে নেতাজিকে লুকিয়ে দুই বেড়ালছানা পুষেছিলেন। তারা যে দিন সোজা ঘর থেকে বেরিয়ে নেতাজির অফিসঘরে টেবিলের ওপর চড়াও হল, আবিদ হাসানের অবস্থা নিতান্ত করুণ। অথবা যখন নেতাজি আদেশ করলেন, ভারতীয়রা পরস্পর দেখা হলে সম্বোধন করতে পারেন এমন একটি সম্বোধন খুঁজে বার করো। নমস্কার, নমস্তে, সালাম-আলেকুম, সৎশ্রীআকাল, হরেক সম্বোধনে বিভ্রান্ত আবিদ নেতাজিকে বলেন, ‘সবাই বলতে পারেন এমন একটা সম্বোধন পেয়ে গেছি— হ্যালো।’ বিরক্ত নেতাজি বলেছিলেন, ‘এটা সিরিয়াস ব্যাপার, হাসি-তামাশার নয়।’
তবে এ সব বকুনি তুচ্ছ। সব চেয়ে যা মনে দাগ কেটেছিল, সেটা আবিদ হাসানের কথাতেই বলি। ‘আজাদ হিন্দ ফৌজ বা আইএনএ গঠন করে নেতাজি দেখিয়ে দিলেন সামনে কোনও সঠিক আদর্শ ধরিয়ে দিতে পারলে হিন্দু, মুসলমান, শিখ, খ্রিস্টান— সব ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করতে পারে।’ আবিদ বললেন, ‘আমরা সর্বপ্রথম ভারতীয়। তার পর অন্য সত্তা। আমরা তো ভুলেই যেতাম কে হিন্দু, মুসলমান বা শিখ, কে-ই বা বাঙালি, পঞ্জাবি অথবা তামিল! এই রকম যখন আমাদের মনের ভাব— এক জাতি, এক প্রাণ, একতা, তখন আমরা নিজেরাই বলাবলি করলাম, আমরা রণক্ষেত্রে এক সঙ্গে প্রাণ বলিদানের পণ করেছি, তবে আমরা বিভিন্ন উপাসনাগৃহে যাই কেন! আমরা কি মন্দির-মসজিদ-গির্জা-গুরুদ্বার না গিয়ে সকলে মিলে একসঙ্গে প্রার্থনা করতে পারি না? যে কথা সেই কাজ। সকলে মিলে একটা সুন্দর প্রার্থনা লিখে ফেলা হল। প্রার্থনা উচ্চারিত হল দুনিয়া কি মালিকের উদ্দেশে। দুনিয়ার মালিক বলতে কারও কোনও আপত্তির প্রশ্ন নেই।’
ওঁরা স্থির করলেন এর পর যে দিন নেতাজি সৈনিকদের ব্যারাক পরিদর্শনে আসবেন, সে দিন সমবেত প্রার্থনা-সংগীত শুনিয়ে তাঁকে চমকিত করে দেবেন। যথাসময় নেতাজি এলেন, দুনিয়ার মালিকের উদ্দেশে বিবিধ ধর্মের মানুষের সমবেত পবিত্র প্রার্থনা তাঁকে শোনানো হল, তিনি নীরবে শুনলেন। ওঁর মুখ দেখে মনের ভাব বোঝা শক্ত। তবে তিনি যে খুশি হয়েছেন এ বিষয়ে আবিদ হাসানদের মনে কোনও সংশয় ছিল না।
এক সময় নেতাজির অফিস ঘরে আবিদ হাসানের ডাক পড়ল। ঘরে পা দেওয়া মাত্র নেতাজি অত্যন্ত গম্ভীর মুখে বলে উঠলেন, ‘এ সব কী আরম্ভ করেছ?’ হতভম্ব আবিদকে তিরস্কার করে বললেন, ‘কে এ সব লোক দেখানো চমক শিখিয়েছে?’ ইংরেজিতে কথাটা বলেছিলেন ‘স্টান্ট’। আবিদ বেশ মুষড়ে পড়েছিলেন। তাঁদের এত সাধের প্রার্থনা নেতাজির পছন্দ হয়নি! নেতাজি ওঁকে বুঝিয়ে বললেন, ‘আমাদের আন্দোলনের ভিত্তি হল জাতীয়তাবাদ, এর চরিত্র রাজনৈতিক। এর সঙ্গে কখনও ধর্মকে মিশিয়ে ফেলবে না। ধর্মের নামে যদি একতার চেষ্টা করো, তবে ধর্মের নামে বিভেদ ডেকে আনাও হবে সহজ। আমরা সকলে ভারতীয়, সেটাই আমাদের পরিচয়। ব্যক্তি হিসেবে আমাদের বিভিন্ন ধর্ম থাকতেই পারে। সেই ব্যক্তিজীবনে ধর্ম আচরণের স্বাধীনতা সকলের থাকবে, তাঁরা নিজ পছন্দমত উপাসনাগৃহে অবশ্যই যাবেন। আন্দোলনের রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে ধর্মকে মিশিয়ে ফেলা ভ্রান্ত নীতি।’ প্রথমে মন খারাপ হলেও আবিদ ও অন্যান্যরা নেতাজির যুক্তির সারবত্তা অনুধাবন করতে পেরেছিলেন।
আজকে প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দল, ধর্ম ও রাজনৈতিক আন্দোলনকে কত চমৎকার ভাবে মিশিয়ে দিতে পারে তার প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে। কখনও রামনবমীর মিছিল (সশস্ত্র অথবা অস্ত্রহীন), কখনও বা হনুমান জয়ন্তী অথবা সাংবাদিককুলের পথিকৃৎ হিসেবে ঋষি নারদমুনির পূজা। ভারতের বর্তমান শাসকদলের যারা বিরোধী, সেই সব বিভিন্ন দল নীতিগত প্রতিবাদের পথের পরিবর্তে, নিজেরাও যাগযজ্ঞ-হোম করে নিজেকে অপরের চেয়ে অধিক ধর্মাচরণশীল প্রমাণের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েছে।
এই প্রেক্ষাপটেই আবিদ হাসানের নেতাজির কাছে তিরস্কৃত হওয়া— রাজনীতি ও ধর্ম কখনও মিশিয়ো না, এমনকী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির জন্যও নয়— সাবধানবাণী মনে পড়ছে।
আরও মনে পড়ছে সিঙ্গাপুরের চেট্টিয়ারদের মন্দিরে দশেরার নিমন্ত্রণ নেতাজি প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। যেখানে সকল ধর্মের মানুষের প্রবেশাধিকার নেই, এমনকী নিম্নবর্গের হিন্দুদেরও নেই, সেখানে তিনি যাবেন না। পর দিন পুরোহিতরা আবার নেতাজির কাছে এলেন, ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত হল। মন্দির প্রাঙ্গণে রাজনীতিক সমাবেশ হবে, সেখানে সকল ধর্মের অফিসারদের নিয়ে তিনি যাবেন। আরও বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত, মন্দিরের দরজাও সকলের জন্য সে দিন থেকে উন্মুক্ত। নেতাজির সঙ্গে সকলে মন্দিরে প্রবেশ করলেন, পুরোহিতরা সাদরে অভ্যর্থনা করলেন। তার পর প্রাঙ্গণে রাজনীতিক সমাবেশ। নেতাজি সে দিন ঐক্যের ওপর অপূর্ব বক্তৃতা করলেন। আবিদ দুঃখ করেছেন, এর কোনও রেকর্ড রাখা হয়নি।
আজকের এই ভেদাভেদ ও হানাহানির মধ্যে এ সব কথা আমরা কি এক বারও স্মরণ করতে পারি না? গাঁধীজিও সারা জীবন একতার কথা বলেছেন, সেই জন্য শেষ পর্যন্ত তাঁকে প্রাণও দিতে হল। আজাদ হিন্দ ফৌজের কীর্তিগাথা যখন গাঁধীজির কাছে পৌঁছল, তিনি যা চেয়েছেন সুভাষ হাতে-কলমে করে দেখিয়েছে— এই বলে আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন।
ভারতের সৌভাগ্য, আমাদের সংবিধান-প্রণেতারা সেই আদর্শ ধরে রেখেছিলেন। রাষ্ট্রের চোখে সকলে সমান, প্রত্যেকের নিজের ব্যক্তিগত ধর্মাচরণের আধিকার থাকবে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়কদের আদর্শ অক্ষুণ্ণ রাখতে আমরা দায়বদ্ধ। সংবিধানে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষার দায়ও প্রতিটি নাগরিকের।
ভূতপূর্ব সদস্য, ভারতীয় লোকসভা
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy