কথা হল, ‘অ্যাঁ! ছেলে হয়ে মা-কে মারল!’ আইএস যেখানে ইচ্ছে করলেই অন্য কাউকে দিয়ে মৃত্যুদণ্ডটা কার্যকর করাতে পারত, সেখানে এ রকম করল কেন? আসলে, অপরিণত ব্যক্তি বা গোষ্ঠী খুব নাটক ভালবাসে। বাঙালি পরিবারে যেমন এক জন না এক জন কাকু বা মাসি থাকে, যে জ্বর হলেই মৃগীমুর্গির মতো সশব্দ কোঁকায়, বা কলেজে লেঙ্গি খেলে দু’বছর হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে থাকে, ফুচকা খায় না। এই নাটুকেপনাকে বাঙালি খুব মূল্য দেয়। যুক্তির চেয়ে অনেক ওপরের তাক-এ রেখে পুজো করে। আইএস-ও নাটকবাজিকে গুরুত্ব দিয়ে, ‘ছেলেই মাকে মারবে’ আদেশ দিল (মা’র নামে নালিশও ছেলেই করেছিল)। এটার একটা পটাং-অ্যাপিল আছে। দেখেছ, আমরা এমন ক্যাডার তৈরি করি, সে সুপার-আনুগত্যে এমনকী মা’কেও খুন করতে দ্বিধা করে না! সত্যিই, এই ঘচাং-ফু হয়তো ছেলেটার টিআরপি বাড়াবে দলে, কেউ কেউ নিজস্ব খুন করতে যাওয়ার আগে তার চরণাম্মেতো খেয়ে যাবে! কিন্তু এই মা’কে খুন-টা সন্তানের জীবনে কোনও ট্রমা-র জন্ম দেবে কি না, মা’র শেষ চাউনি তাকে ঘুমের গহনে তাড়া করবে কি না, এর ফলে তার পরবর্তী ট্রিগারে আঙুল কেঁপে যেতে পারে কি না, সে জেহাদের ক্রিটিকাল মুহূর্তে অমনোযোগী হয়ে পড়তে পারে কি না, অতিজেহাদ দেখাতে গিয়ে সে আদতে এক পিস কম-জেহাদি হয়ে পড়ল কি না, এ সব আইএস ভাবেনি বোধহয়। কাজকম্ম দেখে, ওদের খুব তলিয়ে ভাবা পাবলিক বলেও মনে হয় না।
আবার ওরা এ রকমও ভাবতে পারে, এ লোকটা কাল থেকে গোল্লায় গেলে যাক, এই উদাহরণটা আমাদের সংগঠনের ইমেজটাকে বহু দূর নিয়ে যাবে। যে হেতু ‘মা’ ব্যাপারটাকে একটা সর্বজনীন তোল্লাই দেওয়া হয়, তাই কোটি কোটি জল্লাদগিরির খবরের মধ্যে থেকেও এটা আলাদা ঝটাস-থাপ্পড় হিসেবে বিশ্বে আছড়াবে, এবং আমরা বোঝাতে পারব আমাদের মগজ-ধোলাই কী সার্বিক ও নিঃশর্ত, এ চেতাবনিও পৌঁছবে: কোনও তুমুল ব্যক্তিগত সম্পর্ককেও কাজে লাগিয়ে আমাদের সাবোতাজ করা না-মুমকিন। আর, গোটা বিশ্বই আল্টিমেটলি নাইট্য-ক্যাংলা, সে চুপচাপ যাথাযথ্যের চেয়ে চটকদার ডিসপ্লে-কে চিরকাল অধিক মূল্য উপুড় করেছে, তা হলে সে প্রবণতাটা ব্যবহার করে কেনই বা আমাদের সংগঠন নিয়ে একটা এক্সএক্সএল হেডলাইন আদায় করব না? সে দিক থেকে দেখলে, ওদের প্ল্যান সফল। এবং সত্যিই তো, এক জন ব্যক্তি-জেহাদির চেয়ে, এক খণ্ড মিথ অনেক বেশি জরুরি, আন্দোলনের পক্ষে। তা হলে অবশ্য মানতে হবে, ওরা তলিয়েই ভাবে।
এ বার আসল ব্যাপার। ‘মাদার ইন্ডিয়া’র শেষে নারগিস নিজের ছেলেকে গুলি করে মারেন। দর্শক দুঃখ পায়, কিন্তু তার পূর্ণ সমর্থন থাকে মায়ের দিকে। কারণ, ছেলে যদি ‘ঠিক রাস্তা’ থেকে চ্যুত হয়, তা হলে তো মা’কে শেষ সমাধান হিসেবে এটা বেছে নিতে হবেই, দেশ ও দশের জন্যে। ধরা যাক, আজ যদি সিদ্ধার্থ ধর তার লন্ডনের বাড়িতে উপস্থিত হয়, ‘মা, তোমার কোলে মাথা রেখে একটু শোব, কাল বিকেলে মেট্রোয় বোম রাখতে যাব, যাতে তিনশো লোক খুন হয়’, আর সবিতা ধর যদি সন্তানের মাথা কোলে নিয়ে হাতে সেলফোন তুলে পুলিশ ডেকে নেন, তা হলে আমরা তাঁকে শাবাশ দেব না কি? আমরা কি বলব না, সত্যি, এই হচ্ছেন এক জন মানুষের মতো মানুষ, যিনি, ছেলে মরবে বা সারা জীবন জেলে পচবে জেনেও তাকে ঠিক-শাস্তির দিকে ঠেলে দিয়েছেন, কারণ সাচ্চা মানুষের কাছে সন্তান বা প্রিয়জনের চেয়ে অনেক দামি হল ন্যায় ও স্বধর্ম? তা হলে, এই ছেলেটা যখন তার মা’কে মেরেছে, সে কিন্তু নিজধর্মে ঠিক থেকেছে। মা বলে তার হাত কাঁপেনি, সেটা তার চারিত্রিক অসামান্যতারই পরিচায়ক। ‘আদর্শের জন্য সব কিছুকেই ত্যাগ করা যায়, কিন্তু কোনও মূল্যবোধের বশেই আদর্শকে ত্যাগ করা যায় না’ যদি কারও অস্তিত্বের মূল সুর হয়, সে তো শ্রেয় পথের পথিক। ঈশ্বর যদি কাউকে বলেন, তোমার একমাত্র ছেলেকে হত্যা করে আমার প্রতি ভক্তি প্রমাণ করো, আর সে যদি ছেলেকে পাহাড়ের চুড়োয় নিয়ে গিয়ে নিরপরাধ সন্তানের বুকের ডগায় অনুতাপহীন ছুরি তোলে, তাকে কি আমরা বারংবার পেন্নাম ঠুকি না?