Advertisement
E-Paper

নয়ই বা কেন?

যৌন নিগ্রহের প্রতিবাদ জানাতে যাদবপুর কেন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করল, পোস্টারেও তো করতে পারত, এ তর্ক অর্থহীন। পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞানের কাঠামোর বাইরে নতুন প্রতিবাদের ভাষা এ ভাবেই তৈরি হওয়ার কথা।যৌন নিগ্রহের প্রতিবাদ জানাতে যাদবপুর কেন স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করল, পোস্টারেও তো করতে পারত, এ তর্ক অর্থহীন। পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞানের কাঠামোর বাইরে নতুন প্রতিবাদের ভাষা এ ভাবেই তৈরি হওয়ার কথা।

সোহিনী মজুমদার

শেষ আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০১৫ ০০:১৬

ইউনিভার্সিটিতে আমাদের এক সিনিয়র বন্ধু ছিল, যার ব্যবসায়ী বাবার বিশ্বকর্মা পুজোর নেমন্তন্নে আমাদের সকলের যাওয়া ছিল বাঁধা। ব্যবসাটা সস্তায় স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরির। নেমন্তন্নে কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে এলেও যে কারণে খাওয়ার আয়োজন, সে প্রসঙ্গে কথা উঠলেই দেখেছি, ছেলে-মেয়ে নির্বিশেষে চোখ নামিয়ে মুখ টিপে হাসাহাসি। কেউ হয়তো প্রথম জানল তার বাবার ব্যবসার কথা। জানার পরেই, বিস্ময়ে-লজ্জায়-কৌতুকে তাদের মুখের হাঁ-টা আরও বড় হওয়ার আগেই আমাদের ওই বন্ধু এতটুকু অস্বস্তিতে না পড়ে স্বভাবসুলভ মশকরার ভঙ্গিতে তাদের প্রতিক্রিয়াকে তুড়ি মেরে সত্যিটাকে স্বীকার করে তাদেরই আরও অস্বস্তিতে ফেলে দিত। আবার সেই বন্ধুকেই দেখেছি, অন্য বন্ধুদের বাড়িতে গুরুজনদের ‘তোমার বাবা কী করেন?’ হেন প্রশ্নের উত্তরে সতীর্থদের চোখ টেপাটেপি পুরোপুরি উপেক্ষা না করে বলতে, ‘বাবার মেডিসিনের ব্যবসা’।

গুরুজন দূর অস্ত্‌, বন্ধুদের সবার সামনেও যে জিনিসের কথা প্রকাশ্যে আনা যায় না, সে জিনিস বিখ্যাত প্রতিষ্ঠানের প্রকাশ্য দেওয়ালে আসলে যে, নিয়ম তথা নর্ম রক্ষকদের চোঁয়া ঢেকুর থামতেই চাইবে না, সে তো বলাই বাহুল্য। এর যুক্তি হিসেবে কানে এল— সব জিনিস প্রকাশ্যে আনার দরকার নেই, কিছু জিনিস গোপন থাকাই ভাল; ব্যাপারটা কুরুচিকর; নান্দনিক নয়; মিডিয়ায় তো ‘এ সব জিনিস’-এর খোলাখুলি বিজ্ঞাপন হয়ই, তা হলে আবার সেটাকে টেনে হিঁচড়ে চোখের সামনে সাঁটাবার কী দরকার বাপু? ধর্ষণ-নিগ্রহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার হলে পোস্টারে লেখ, প্যাডে লিখে কী দাবি আদায় হতে পারে? ইত্যাদি। এখন কথা হচ্ছে, আমরা কী গোপন করতে চাই, কেন চাই। আমাদের দুর্বলতা প্রকাশ্যে আসলে আমরা লজ্জা পাই, কারণ একমাত্র সক্ষমতাকেই সমাজ স্বাভাবিকের তকমা দেয়। সেই স্বাভাবিকের থেকে চ্যুতির লজ্জা ঢাকতেই গোপনীয়তার আশ্রয় নেওয়া। আবার নিজের মৌলিকত্ব বজায় রাখার তাগিদেও ভাবনা গোপন করি। অর্থাৎ গোপনীয়তার সঙ্গে সকলের থেকে বিচ্ছিন্ন (other) হয়ে থাকার একটা প্রবণতা কাজ করে।

সাম্প্রতিক একটি সাক্ষাৎকারে তসলিমা নাসরিন চিলিতে পিরিয়ডের রক্ত নিয়ে হওয়া এক প্রদর্শনী প্রসঙ্গে এক জনের মন্তব্য উল্লেখ করে বলেছেন, ‘পুরুষের রক্তকে সাহসের রক্ত হিসেবে সেলিব্রেট করা হয়। আর আমাদের মেয়েদের রক্তকে চিরকাল লজ্জার বলে চিহ্নিত করা হয়’। বিশেষ দিনগুলোতে ক্লাস সেভেন-এইটের মেয়েদের ক্ষেত্রে বেস্ট ফ্রেন্ডকে সব সময় সজাগ রাখতে হয়, পিছনে দাগ লেগেছে কিনা নজর রাখবার জন্য। এর সঙ্গে যুক্ত রয়েছে ‘অশুচিতা’র প্রশ্নও। মেয়েরা যে আদতে ‘মাত্র’ যৌন বস্তু, এই ট্যাবু সে কথাই বলে মাত্র। তাদের যৌনতার চিহ্ন, যৌন চাহিদা, এমনকী তাদের যৌন হেনস্থা, সব কিছুই ‘অশ্লীল’। প্রকাশ্যে আসা ‘শোভন’ নয়। তাই ‘চোখের বালি’তে ঋতুপর্ণ কী ভাবে পিরিয়ডের দৃশ্যটা দেখালেন তা ছিল সদ্য ঋতুমতী আমাদের গভীর নিষিদ্ধ আলোচনার বিষয়বস্তু।

স্কুল-স্তরে স্যানিটারি ন্যাপকিনের ব্যবহার নিয়ে আলোচনা, কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সাহায্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ানোর উপযোগিতা অনস্বীকার্য। দেশের বেশির ভাগ অঞ্চলে হয়তো এটাই প্রাথমিক প্রয়োজন। কিন্তু হাজারও বিজ্ঞাপনী প্রচার সত্ত্বেও শহরের সচেতন ‘উচ্চ শিক্ষিত’ মানুষও তো এখনও কাগজের মোড়ক আর কালো প্যাকেটের মোহ কাটাতে পারেননি। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য এখনও প্রকাশ্যে ‘পিরিয়ড’ শব্দটাই ব্যবহার করতে কুণ্ঠা বোধ করেন। নিজের নীরবতার পিছনে যুক্তি হিসেবে বলেন, ‘ওই সমস্ত ভাষা ব্যবহার সামাজিক ভাবে স্বীকৃত নয়’, তাই জাতীয় সংবাদ মাধ্যমে তা তিনি প্রয়োগ করতে চান না। এই অস্বীকৃতি নারী শরীরকে, না তার যৌনতার চিহ্নকে, নাকি তার বহিঃপ্রকাশকে, সে বিষয়টা কিন্তু তিনি পরিষ্কার করতে পারেন না।

আসলে সামাজিক সচেতনতা ছড়াতে গেলে শুধু মেয়েদের স্কুলে নয়, কো-এডুকেশন, এমনকী ছেলেদের স্কুলেও এই ট্যাবুগুলোকে চিহ্নিত করে সে সম্বন্ধে গোপনীয়তা ভাঙা প্রয়োজন। পুরুষের চোখ দিয়ে দেখার, দেখানোর অভ্যেস বদলানো প্রয়োজন স্কুল স্তর থেকেই। একই রকম গোপন রহস্যে ঢেকে রাখা বয়ঃসন্ধির ছেলে-মেয়েদের হস্তমৈথুনকেও। সচেতনতা ছড়াতে গেলে এ নিয়েও ট্যাবু ভাঙা দরকার। ট্যাবু ভাঙা দরকার ভাষা ব্যবহার নিয়েও। বাংলা মাধ্যম স্কুলেও কেউ টয়লেটে যাওয়া বা পটি করার বিকল্প বাংলা শব্দের ব্যবহার শেখান না। পিরিয়ড বা মাস্টারবেশনের বাংলা প্রতিশব্দ সারা জীবনেও হয়তো কেউ কেউ উচ্চারণ করেন না। এই যে ‘উচ্চ সংস্কৃতি’র ভাষা ব্যবহার করলে পাঁক মোচনের আশা, নিজের সংস্কৃতির রক্ষণশীলতা ভাঙতে গেলে এরও বিকল্প খোঁজা প্রয়োজন।

যাদবপুর কেন যৌন নিগ্রহের প্রতিবাদ স্যানিটারি ন্যাপকিনে করল, পোস্টারেও তো করতে পারত, এ প্রশ্ন অর্থহীন। কারণ এই বিকল্প পদ্ধতিগুলোই পুরুষতান্ত্রিক জ্ঞানের কাঠামোর বাইরে নতুন প্রতিবাদের ভাষা তৈরি হতে পারে। এই পদ্ধতি একাধারে সচেতনতা বাড়ানোর প্রোগ্র্যাম হিসেবে এবং সেক্সিজমের বিরুদ্ধে বৃহত্তর আন্দোলনের হাতিয়ার হিসেবে অন্যতম সেরা। সেটা যদি কারও রুচিকে, নান্দনিকতাকে আঘাত করে, তা হলে বলতে হয়: জগতে কোনও কিছুই নৈর্ব্যক্তিক নয়। মকবুল ফিদা হুসেনের নগ্ন সরস্বতীকে যদি কুরুচিকর বলে এক দলের রোষের মুখে পড়তে হয়, আর এক দল আবার তার মধ্যেই অনির্বচনীয় নান্দনিকতা খুঁজে পাবেন।

যাদবপুরের আন্দোলনকারী এক ছাত্রী আনন্দবাজারকেই বলেছিলেন, ‘দৃষ্টিকটু ভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করাই’ তাঁদের লক্ষ্য। অর্থাৎ তাঁরা মেনেই নিচ্ছেন তাঁদের পদ্ধতি দৃষ্টিকটু! সমাজকে ধাক্কা দেওয়ার জন্যই যে পদক্ষেপ করা, সেখানে সামাজিক বক্তব্য রাখার সময়ে নিজেদের পন্থা নিয়ে আরেকটু প্রত্যয়ী দায়িত্ববান মন্তব্য তাঁদের কাছে কি কাম্য নয়? যাঁরা সামাজিক এই জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হলেন, তাঁদের এই আন্দোলনে অঙ্গীভূত করতে পারাটাই তো অন্তত ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এর সফলতার পথ দেখাতে পারত। পুরুষতন্ত্র খারাপ, তা থেকে যাঁরা নড়তে পারেন না, তাঁরাও সমালোচনার যোগ্য। কিন্তু যে পড়ুয়া দেওয়ালে প্যাড দেখে নাক সিঁটকোচ্ছেন, তাঁদের প্রতিপক্ষ ভেবে দূরে ঠেলে না দিয়ে, তাঁদের অবস্থান থেকে তাঁদের বুঝে সহিষ্ণুতা বজায় রেখে চিন্তাগুলো বদলানোর চেষ্টা করা অনেক জরুরি। ছোট ছোট ক্ষেত্রে সাবজেক্টের মতো করে বার্তাটা পৌঁছনোই আসল। এ ক্ষেত্রে ‘ফর্ম’ যেন ‘কনটেন্ট’কে ছাপিয়ে না যায়, সে বিষয়ে সাবধান থাকা প্রয়োজনীয়। না হলে এ শুধুই দু’দিন মিডিয়ায় ঝড় তোলা অন্য অনেক দায়িত্বজ্ঞানহীন মুষ্টিমেয় ‘সেনসিটাইজড’-এর দৃষ্টি আকর্ষণের গল্প হয়ে থেকে যাবে।

Sanitary napkin unique protest jadavpur university protest sanitary napkin protest abp post editorial
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy