উত্তর-পূর্ব কলকাতার একটি নামী দুর্গাপূজার এক উদ্যোক্তা জানালেন, তাঁদের আয়োজনের ৮৫ শতাংশ খরচের জোগান আসে একটি মেলা-অনুষ্ঠান করে, যাতে অংশ নেন ছোট-বড় নানান পণ্য বিক্রেতা। বাকি ১৫-২০ শতাংশ উঠে আসবে এলাকাবাসীর দেওয়া চাঁদায়।
কলকাতার ডাকসাইটে পুজোগুলি তো বটেই, অনতিপ্রসিদ্ধ পুজোগুলিও চলে স্পনসরশিপের টাকায়। তাঁরা ভরসা রাখেন পণ্য-বিক্রেতা সংস্থার থেকে পাওয়া হোর্ডিং-ব্যানার-গেট ইত্যাদি নানান বিজ্ঞাপনী মাধ্যমে। আজকের কলকাতার চোদ্দো আনা পুজোর আশি শতাংশ খরচ জোগায় পণ্য-বিক্রেতা সংস্থা।
চোখের সামনেই বদলে যাওয়াটা বেশ মজার। যাটের দশকের কলকাতায় বিভিন্ন পল্লিতে যে দুর্গাপূজা হত, তার চেহারা কেমন? পুজোর প্রায় একশো শতাংশ খরচ আসত পল্লিবাসীর চাঁদা থেকে। চাঁদা কত? চার আনা-আট আনা-এক টাকা-দু’টাকা-পাঁচ টাকা। খুব কম লোকই পাঁচ টাকা দিতে পারতেন। সত্তরের দশকে পরিবর্তন ঘটল। চার আনা কেন, আট আনাও কেউ নিতে চায় না। নতুন অঙ্ক হল এক-দুই-পাঁচ-দশ-ত্রিশ-পঞ্চাশ। সত্তরের মধ্য ভাগ থেকেই বেলাগাম মাইক বাজানো শুরু। পুজোয় সদ্যোজাত আধুনিক বাংলা গানের পাশাপাশি বাজে হিন্দি ফিল্মি গানা। কিন্তু তখনও পুজোর খরচের জোগানদার পল্লিবাসী।
দ্রুত বদলের শুরু আশির দশক থেকে। ২০০০ সাল থেকে কলকাতার নামী পাড়ার দামি পুজো সব পণ্য-সংস্থা নির্ভর। উত্তর কলকাতার কোনও পুজোর উদ্যোক্তা যদি বললেন, এ বার আমাদের পুজোর বাজেট এত লক্ষ টাকা, তো দক্ষিণ কলকাতার অন্য দাদা হাঁকড়ালেন, আরে দুর! ও তো নস্যি, এ বার আমাদের অ্যা-তো লক্ষ টাকা। দুই দাদার এই মোরগ-লড়াইয়ের ভরসা কিন্তু পাড়ার লোক নয়, কোনও পণ্য-বিক্রেতা সংস্থা। ষাট-সত্তরে পাড়ার পুজোর সম্পাদক নিজে বাড়ি-বাড়ি যেতেন চাঁদা তুলতে। এখন সম্পাদক অনেক উঁচু দরের লোক। তাঁর কোনও চ্যালা-চামুন্ডা ব্যপৃত এই কাজে। বস্তুত কলকাতার বেশ কিছু পুজো আজ পা়ড়ার লোকে চাঁদা না দিলেও হইচই করে সম্পন্ন হবে। পণ্যায়ন প্রবেশ করে গেছে পাড়ার পুজোর অন্দরমহলে।
পণ্য-বিক্রেতা সংস্থার কাছে দুর্গাপূজা, যা নাকি হরপ্রসাদ শাস্ত্রীর ভাষায় ‘বাঙালির মহা-মহোৎসব’, একটি বড় ‘ইভেন্ট’। এখন পুজোর অন্তত তিন মাস আগে থেকে পণ্য-বিক্রেতা সংস্থার বিপণন-বিজ্ঞাপন বিভাগ ঠিক করতে শুরু করে, কোন কোন পাড়ার পুজোয় বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। নির্বাচনের একটাই যুক্তি— লোকসমাগম। কত মানুষ আগ্রহ নিয়ে দেখতে যান সেই পুজো। যে প্যান্ডালে ‘ফুটফল’ বেশি হবে, তাকেই স্পনসর করো। এমন ভাবে নির্বাচন করতে হবে, যেন শহরের উত্তর-দক্ষিণ-পূর্ব-পশ্চিমে আমার পণ্যের উপস্থিতি ঘোষণা করা যায়।
কিন্তু লোক আসবে কেন? উদ্যোক্তারা দিতে শুরু করলেন নানান চমক— থিম, থিমসং, পুজো অ্যাম্বাস্যাডর, খুঁটি পুজো। প্রচার চাই, অতএব নামী কাউকে দিয়ে পুজো উদ্বোধন। তবে এ কথা স্বীকার করতেই হবে, সম্ভবত, স্পনসরশিপ-বিজ্ঞাপন এবং পুরস্কার পাওয়ার তাগিদে, কলকাতার পুজো এখন অনেক বেশি দৃষ্টিনন্দন। বেশ একটা প্রফেশনাল ছোঁওয়া লেগেছে প্রতিমা থেকে প্যান্ডালে। মাইকের অত্যাচারও অনেক কম।
তবে এই পরিবর্তনের প্রকোপে উৎসব বস্তুটির একটি বড় রূপান্তর ঘটে গিয়েছে। মানুষের অংশগ্রহণের দরকার বা পরিসর, দুটোই কমতে কমতে প্রায় অদৃশ্য। রবীন্দ্রনাথ যতই বলুন, ‘উৎসবের মধ্যে মিলন চাই’, যতই বলুন উৎসব মানে ‘সমস্ত মানুষের সঙ্গে একত্র হইয়া বৃহৎ’ হওয়া: স্পনসরশিপ-বিজ্ঞাপন আর পুরস্কার-থিমপুজোর প্রবল দাপটে এখন উৎসবের মধ্যে মানুষের জায়গা অতি অল্প। চাকচিক্য আছে, সহযোগ নেই। আয়োজন আছে, মানুষের প্রয়োজন নেই। মিলন যদি উৎসবের স্বাভাবিক উদ্দেশ্য হয়, তা আজ ইতিমধ্যেই ব্যর্থ।