Advertisement
E-Paper

বিলেতে বোকা বানিয়ে ভোট মেলে না

৭ মে ব্রিটেনে পার্লামেন্ট নির্বাচন। একাধিক জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী, এখনও কোনও পার্টিরই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়ার আশা নেই। ব্রিটেনের রাজনীতিতে কি তবে একটা নতুন যুগই চলে এল?মে মাসের সাত তারিখে বিলেতে সাধারণ নির্বাচন। এ বারের বিলেতের ভোট শুরু থেকেই আলাদা। তফাতটা মূলত দুটো কারণে। প্রথমত, দুই প্রধান দলের নেতা, কনজারভেটিভ দলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও বর্তমান বিরোধী নেতা, প্রধানমন্ত্রী-পদাকাঙ্ক্ষী লেবার পার্টির এড মিলিব্যান্ড, কেউ কারও থেকে জনমতের নিরিখে এগিয়ে নেই। শুধু তা-ই নয়, সাম্প্রতিক সমস্ত সমীক্ষার বিচারে দুজনেরই গ্রহণযোগ্যতার মান বেশ তলার দিকে: মেরেকেটে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ শতাংশ।

ইন্দ্রজিৎ রায়

শেষ আপডেট: ২৮ এপ্রিল ২০১৫ ০০:০৪
টিভি বিতর্ক। (বাঁ দিক থেকে) লেবার পার্টির এড মিলিব্যান্ড, প্লে়ড ক্যামরি-র লিয়েন উড, এসএনপি-র নিকোলা স্টার্জন এবং প্রধানমন্ত্রী, কনজারভেটিভ পার্টির ডেভিড ক্যামেরন। ২ এপ্রিল, রয়টার্স।

টিভি বিতর্ক। (বাঁ দিক থেকে) লেবার পার্টির এড মিলিব্যান্ড, প্লে়ড ক্যামরি-র লিয়েন উড, এসএনপি-র নিকোলা স্টার্জন এবং প্রধানমন্ত্রী, কনজারভেটিভ পার্টির ডেভিড ক্যামেরন। ২ এপ্রিল, রয়টার্স।

মে মাসের সাত তারিখে বিলেতে সাধারণ নির্বাচন। এ বারের বিলেতের ভোট শুরু থেকেই আলাদা। তফাতটা মূলত দুটো কারণে। প্রথমত, দুই প্রধান দলের নেতা, কনজারভেটিভ দলের প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন ও বর্তমান বিরোধী নেতা, প্রধানমন্ত্রী-পদাকাঙ্ক্ষী লেবার পার্টির এড মিলিব্যান্ড, কেউ কারও থেকে জনমতের নিরিখে এগিয়ে নেই। শুধু তা-ই নয়, সাম্প্রতিক সমস্ত সমীক্ষার বিচারে দুজনেরই গ্রহণযোগ্যতার মান বেশ তলার দিকে: মেরেকেটে তিরিশ-পঁয়ত্রিশ শতাংশ। তাই, প্রায় সকলেরই ধারণা, এ বার বিলেতে ত্রিশঙ্কু সংসদ হতে চলেছে। জোট সরকার গঠন হতে পারে। সেটা যে আগে হয়নি তা নয়— শেষ বার, ২০১০ সালেই তো কনজারভেটিভ ও লিবারাল ডেমোক্রাটরা গাঁটছড়া বাঁধে। কিন্তু এ বার জোটের চেহারা চরিত্র আরও অনেক বেশি অনিশ্চিত। এ বারের নির্বাচনের দু’নম্বর তফাত হল, দলের সংখ্যা আর দুই বা তিনে সীমাবদ্ধ নেই— নয়-নয় করে বড়-ছোট মিলিয়ে এখন উল্লেখ্য দল অন্ততপক্ষে সাতটি। কনজারভেটিভ আর লেবার, এই দুটো বড় দলই প্রধান হলেও, রয়েছে লিব ডেম-এর মতোই আরও দুটো ছোট দল: পরিবেশবান্ধব গ্রিন পার্টি এবং ইউ কে ইন্ডিপেনডেন্স পার্টি (ইউকেআইপি)। আছে আরও দুটো দল: স্কটল্যান্ডের স্কটিশ ন্যাশনাল পার্টি (এসএনপি) আর ওয়েল্‌শ-এর প্লেড ক্যামরি। অনেকেই বলছেন, বিলেতে দুই দলের রাজনীতির দিন এ বার শেষ, বহুদলীয় গণতন্ত্রের ও মিশ্র সংসদের দিন সমাগত। কলকাতা লন্ডন হোক বা না হোক, বিলেত তবে এত দিনে ভারত হল!

নির্বাচনী প্রচারের রণদুন্দুভি অবশ্য বেজেছিল এপ্রিলের গোড়ায়, ইস্টার-এর ছুটির ঠিক আগে, সাত দলের সাত নেতাকে নিয়ে একসঙ্গে এক টেলিভিশনে সম্প্রসারিত নির্বাচনী বিতর্কে। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে দুই নেতার মুখোমুখি ডিবেটই হল প্রচারের মূল মঞ্চ। বিলেতে নেতাদের মধ্যে ডিবেট ব্যাপারটাই আমেরিকার তুলনায় নতুন, যদিও বিভিন্ন চ্যানেলে নেতাদের প্রশ্ন-উত্তর পর্ব এখানেও হয়। ২০১০ সালে তিন জন নেতাকে নিয়ে তিন বার টিভি-ডিবেট হয়েছিল ঠিকই, তবে এ বার যেন ডিবেটটা অনেক বেশি গুরুত্বের। সাত জন নেতা ভোটে জিতে কী করবেন, কী ভাবে করবেন, সেটা শুরুতেই যেন বলা হয়ে গেল। ডিবেটের বিষয়গুলো স্থির করা হয়েছিল আমজনতার করা বিভিন্ন প্রশ্ন থেকে বেছে। তর্ক হল দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে, সরকারের আয়ব্যয় নিয়ে। প্রসঙ্গত, বিতর্কে চলে এল জনসাধারণের জীবনযাত্রার মান বা লিভিং স্ট্যান্ডার্ড, সঙ্গে সঙ্গে উচ্চশিক্ষা ও স্বাস্থ্য ব্যবস্থা নিয়েও। সর্বোপরি, অভিবাসন, বিশেষত পূর্ব ইউরোপের দেশ থেকে আসা শ্রমিকদের নিয়ে নেতাদের মতভেদ থেকে প্রশ্ন উঠল: ব্রিটেন আদৌ ইউরোপের অঙ্গ হিসেবে ভবিষ্যতে থাকবে কি না।

টিভি ডিবেট দিয়ে শুরু। সেই সন্ধ্যার বিষয়সমূহের ভিত্তিতে নেতাদের দেওয়া বিভিন্ন উত্তর নিয়েই তার পর দলগুলো নিজেদের প্রচার চালু করে, বিষয়গুলোতে দলের অবস্থান নির্ধারণ ও নীতি প্রণয়ন করে। সপ্তাহ দুয়েক প্রচার চালিয়ে সম্প্রতি ছোট-বড় সব দলগুলি এ বার তাদের সম্পূর্ণ নির্বাচনী ইস্তাহার প্রকাশ করেছে। ভোটে জিতলে কোন দল কোন কোন প্রশ্নে ঠিক কী করবে, তার বিবরণ নিয়েই দলীয় ইস্তাহার। আমাদের দেশের দলগুলির ইস্তাহারের সঙ্গে অবশ্য বিলিতি ইস্তাহারের ফারাক আছে। আমাদের দলগুলি বিভিন্ন নির্বাচনের আগে, তা সে পুরভোট হোক বা লোকসভার, নিজেদের ইস্তাহারে ‘হ্যান করেঙ্গে ত্যান করেঙ্গে’ লেখেন। কিন্তু, ‘কী ভাবে করেঙ্গে’, তার কোনও খতিয়ান দেওয়া হয় না। বিলেতে এ ভাবে ফাঁকি দেওয়া চলে না— আয়ব্যয়ের অঙ্ক না মিললে অন্য দলগুলি, তদুপরি মিডিয়া, ছেড়ে কথা বলবে না। ইস্তাহারগুলো তাই যেন আগাম মিনি-বাজেট: সরকার গঠন করলে কোথায় কত কর বাড়বে বা কমবে, সরকারি খাতে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ইত্যাদি খাতে কত ব্যয় হবে, তার সব খুঁটিনাটি মিলবে ইস্তাহারে। শুধু নির্বাচনের আগে বলে নয়, সারা বছর ধরেই বিরোধী দলগুলি তাদের নিজেদের শ্যাডো-ক্যাবিনেট চালায়। এই ছায়া-বিভাগগুলি বিভিন্ন বিষয়ে নিজেদের নীতি তৈরি করে— বিরোধী না হয়ে নিজে মন্ত্রী হলে যেমন কাজ করেন, তেমনটাই।

মনে হতে পারে, এত দলের এত অ্যাজেন্ডাতে জনগণের তো মাথা গুলিয়ে যেতে পারে, তবু গণতন্ত্রের দাবিতে আগে থেকে সব বলে দেওয়াই ভাল। এখানেই ভারতের দলীয় ইস্তাহারের সঙ্গে বিলেতের ইস্তাহারের আর এক তফাত। সেটা হল, আগামী সংসদে যে সব নীতি পেশ করা হবে, তা আগে থেকেই জনগণকে জানিয়ে দেওয়া হয়। যেমন, মিলিব্যান্ড বলছেন, প্রধানমন্ত্রী হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফি কমিয়ে দেবেন, বা ক্যামেরন বলেছেন, এ বার ইউরোপে ব্রিটেন থাকবে কি না, সেটা জনগণ নিজেরাই স্থির করবেন রেফারেন্ডাম বা গণভোটের মাধ্যমে। দলগুলির এই প্ল্যান জেনেই জনসাধারণ ভোট দিতে যান। তুলনায় আমাদের দেশে সংসদীয় নির্বাচনের আগে জমি-বিলের মতো গুরুত্বপূর্ণ নীতিও জানানো হয় না— মোদীও বলেন না, বিরোধীরাও বিকল্প হিসেবে কী প্ল্যান করেছিলেন আমাদের আগে জানান না। আমাদের আগে না জানিয়ে আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে সংসদে গিয়েই কোনও বিল পেশ করলে তো আমাদের ঠকানো হল।

তবে, এ বারে বিলেতেও দলগুলির অবস্থান ইস্তাহারে পুরোপুরি খোলামেলা নয়। তার কারণ হয়তো নির্বাচনের পরের সম্ভাব্য জোট সরকার! এখন সব ক’টি দল আলাদা আলাদা হলেও, ভোটের পরে সরকার গড়তে কে যে কার সঙ্গে হাত মেলাবে তা জানা নেই। আমাদের দেশে নির্বাচনের পূর্বে গড়া জোট, পরিভাষায় যাকে বলে ‘প্রি-ইলেকটোরাল কোয়ালিশন’ দেখতেই আমরা বেশি অভ্যস্ত। যেমন ইউপিএ, এনডিএ ছাড়াও রয়েছে তথাকথিত তৃতীয় ফ্রন্ট। বিলেতে নির্বাচনের পরে, অর্থাৎ কোন দল ক’টা আসন পেয়েছে, তা জানার পরেই সরকার গড়ার তাগিদে বিভিন্ন দল জোট বাঁধবে। কোনও জোটই অপ্রত্যাশিত নয়। নীতিগত ভাবে দূরের দলও একজোট হতে পারে।

জোট হলে দলগুলি নিজেদের ইস্তাহারে যা যা করতে চেয়েছিল, তা-ই তা-ই করতে হবে এমন কোনও গ্যারান্টি বিলেতেও নেই। তবু ভবিষ্যতে ভোটারদের কাছে মুখরক্ষার খাতিরে দলগুলির নিজস্ব কিছু দাবিদাওয়া তো ধরে রাখতে হবে। যেমন, গত বার ২০১০-এর নির্বাচনের ঠিক পরে এত দিন ধরে চলে আসা নির্বাচন পদ্ধতিটাই বদলানো হবে কি না তা স্থির করতে লিব-ডেম প্রস্তাবিত ‘রেফারেন্ডাম’ ডাকতে ক্যামেরন বাধ্য হন, প্রস্তাবটা গোহারান হেরে যাবে জেনেও। বিলেতের নাগরিকরা ভোট দিয়েছিলেন ‘অল্টারনেটিভ ভোটিং’, সংক্ষেপে ‘এ ভি’-র পক্ষে বা বিপক্ষে। এ ভি হেরে যায়, প্রচলিত নির্বাচনী ব্যবস্থাই চালু থাকে। এ বারেও হয়তো ছোট দলগুলি বড় দলের সঙ্গে জোট বাঁধতে কিছু না কিছু দাবি করবে। তাই নির্বাচনী ইস্তাহারে দলীয় অবস্থানে একটু ফাঁকফোকর থাকলে হাত মেলাতে হয়তো সুবিধা হবে। তবে, আবার বেশি ফাঁক থাকলেও বিপদ— জনতাকে বোকা বানানো সম্ভব নয়।

ব্রিটেনে বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতির শিক্ষক

uk general election david cameron fool people making people foo abp post editorial indrajit roy
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy