Advertisement
২৬ এপ্রিল ২০২৪

সে দিনের গার্ডেনরিচ বদলে যায় এ দিনের বুলন্দশহরে

কে জানে, ধর্মের আধারে ভরে শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার তাগিদে আরও কত-শত নির্ভীক মানুষ জনের কর্তব্যনিষ্ঠা এ ভাবেই স্তব্ধ হয়ে যাবে! লিখছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্যকে জানে, ধর্মের আধারে ভরে শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার তাগিদে আরও কত-শত নির্ভীক মানুষ জনের কর্তব্যনিষ্ঠা এ ভাবেই স্তব্ধ হয়ে যাবে! লিখছেন দেবর্ষি ভট্টাচার্য

—ফাইল চিত্র।

—ফাইল চিত্র।

শেষ আপডেট: ২৪ জুন ২০১৯ ০১:৪০
Share: Save:

ভোট আসে, ভোট মিটে যায়। ১৯৮৪ সালের গার্ডেনরিচ যেন আবার ফিরে আসে সাম্প্রতিক অতীতের বুলন্দশহরের বেশে!

সেই মধ্য ৮০-র দশকের নৃশংস হত্যালীলা আজ হয়তো নাগরিক মননের বিস্মৃতির অতলে। রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকতায় পুষ্ট ঘৃণ্য চক্রান্তের অদৃষ্ট লিখন যে এমনটাই হয়, তা বোধহয় একেবারেই অজানা ছিল ‘পাঞ্জাব কা পুত্তর’ তৎকালীন ডিসি (বন্দর) বিনোদ কুমার মেহতা এবং তাঁর দেহরক্ষী বঙ্গসন্তান মোক্তার আলির। যা হয়তো অজানাই ছিল বুলন্দশহরের নির্ভীক পুলিশ অফিসার সুবোধ কুমার সিং-এরও।

কালান্তরের অবকাশে শুধু নাম বদলে যায়, স্থান বদল হয়, চক্রান্ত বাস্তবায়িত করা জন্য প্রয়োজনীয় অজুহাতেরও পরিবর্তন হয়। গাছের ডাব চুরির মতো মামুলি অজুহাত বদলে যায় গোমাতা রক্ষার ‘মহান’ দায়িত্বে! ‘মহান ধর্মরক্ষার’ কলে পিষে এবং রাজনৈতিক ইশারার শিকার হয়ে এ ভাবেই বোধহয় মরে যেতে হয় নির্ভীক কর্তব্যপরায়ণ কতিপয় পুলিশদের। সাধারণ মানুষকে।

গার্ডেনরিচ অঞ্চলের চোরাচালান এবং ড্রাগ ব্যবসার শিকড় উপড়ে ফেলার যে ব্রত অকুতভয় ডিসি মেহতা নিয়েছিলেন, তার মূল্য চোকাতে হয়েছিল তাঁরই তরতাজা প্রাণের বিনিময়ে। তাই তাঁর মৃত্যুদণ্ডের শাস্তি অলক্ষেই লিখে ফেলা হয়েছিল অপরাধজগৎ আর অপরাধমনস্ক কিছু রাজনৈতিক ব্যাক্তির ঘৃণ্য যুগলবন্দির ইশারায়। অপেক্ষা ছিল শুধু কোনও এক অছিলার। যে ঘটনার চিত্রনাট্য রচনায় তৎকালীন মন্ত্রিসভার এক দাপুটে মন্ত্রীরও নাম জড়িয়েছিল বলে সংবাদপত্রে প্রকাশ। তবু বহাল তবিয়তে তিনি আমৃত্যু মন্ত্রিত্ব পালন করে গিয়েছেন।

আর পেশাগত কর্তব্যের তাগিদে জীবনকে বাজি রেখে ছুটে যাওয়া এক তরুণ আইপিএস অফিসার এবং তাঁর মধ্যবয়স্ক দেহরক্ষী রেখে গেলেন প্রায়বিস্মিত স্মৃতির আবছায়াটুকু মাত্র। এমন নির্মম হত্যালীলার প্রত্যক্ষ কারিগরদের অধিকাংশই আজও ঘুরে বেরাচ্ছে সমাজের রাজপথ ‘আলো’ করে। আর এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের কারিগরেরা অগোচরেই থেকে গেলেন চিরতরের জন্য।

২০১৮ সালের ৩ ডিসেম্বরের থেকে ইতিহাসের রক্তাক্ত পাতাগুলো এমন ভাবেই পিছিয়ে যায় ১৯৮৪ সালের ১৮ মার্চে। দোল উৎসবের দিনে কলকাতা পুলিশের অধীনস্থ গার্ডেনরিচ থানা এলাকার ফতেপুর ভিলেজ রোডে স্থানীয় কচিকাঁচাদের দ্বারা অন্যের গাছের ডাব চুরির মতো এক অতি সাধারণ দুষ্টুমি ঘটে গেল, যা এই বঙ্গদেশে আকছারই ঘটে থাকে। কিন্তু কে বা জানত, রঙিন বসন্তের আপাত নিরীহ এই ঘটনাকে সোপান বানিয়ে ফল্গুধারায় রচিত হয়ে যাবে এক অতি হিংস্র রক্তক্ষয়ী চিত্রনাট্য! অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ভাবে পুলিশ বা প্রশাসনের কেউ এমন একটি নারকীয় ষড়যন্ত্রের কোনও আঁচই পেলেন না! পর দিন সকাল হতে না হতেই প্রাণঘাতী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ফতেপুর ভিলেজ রোডে জড় হতে লাগল দুই ভিন্ন সম্প্রদায়ের বেশ কিছু হিংসালিপ্সু মানুষ।

১৮ মার্চ সকাল দশটা নাগাদ লালবাজার কন্ট্রোলরুমে এক অজানা লোকের ফোন মারফত পুলিশ ঘটনার প্রথম খবর পেল। সকাল সাড়ে দশটা নাগাদ ঘটনাস্থলে এসে পৌঁছল তৎকালীন ডিসি-বন্দর বিনোদ কুমার মেহতার নেতৃত্বে পুলিশবাহিনী। ঘটনার তাৎক্ষণিক মোকাবেলার প্রয়োজন বিচার করে ডিসি মেহতা অতিরিক্ত পুলিশবাহিনীর অপেক্ষায় মুল্যবান সময় নষ্ট না করে গুটিকয় পুলিশকর্মীকে সঙ্গী করেই এক হাতে লাঠি এবং অন্য হাতে লোহার ঢাল নিয়ে ঢুকে পড়লেন হিংসা কবলিত অঞ্চলে। ডিসি মেহতার নেতৃত্বাধীন পুলিশবাহিনী অঞ্চল ডমিনেসনের জন্যে যত এগোতে লাগলো, ততই যেন তাঁরা অন্ধগলির গোলকধাঁধায় ঘুরপাক খেতে থাকল।

ফলস্বরূপ, অল্প কিছু ক্ষণের মধ্যেই হিংসাবাজ গুন্ডারা ডিসি মেহতার পুলিশবাহিনীকে চার দিক থেকে ঘিরে ফেলে রক্তপিপাসু হায়নার মতো চিৎকার করতে লাগল। ইতিমধ্যে তৎকালীন ডিসি (সদর), ডিসি-এসবি (প্রথম) এবং ডিসি-এসবি (দ্বিতীয়)-র নেতৃত্বে লালবাজার থেকে বিশাল পুলিশবাহিনী এসে আশ্চর্যজনক ভাবে পাহাড়পুর রোডে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল। উন্মত্ত সশস্ত্র গুন্ডাদের তাড়া খেয়ে আত্মরক্ষার তাগিদে ডিসি মেহতা, তাঁর দেহরক্ষী মোক্তার আলি, এসি-বন্দর (দ্বিতীয়) ও তাঁর দেহরক্ষী এবং আরও ছয় জন পুলিস কনস্টেবল স্থানীয় ধানখেতি মসজিদে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলেন। ধানখেতি মসজিদের মধ্যে নিরাপত্তা খুঁজে না পেয়ে এসি-বন্দর (দ্বিতীয়) ও তাঁর দেহরক্ষী এবং ছয় জন পুলিশ কনস্টেবল ছুটে বেরিয়ে এসে দৌড় লাগালেন পাহাড়পুর রোডের উদ্দেশ্যে। নিরস্ত্র মেহতা সাহেব এবং তার দেহরক্ষীকে একলা ফেলেই।

পাহাড়পুর রোডে বিশাল পুলিশ বাহিনী নিয়ে নিছক দর্শকের মতো তখনও অপেক্ষমান লালবাজার থেকে আগত পুলিশকর্তারা। কেউ কিন্তু খোঁজ নিলেন না ডিসি মেহতা বা তাঁর দেহরক্ষী কোথায়! অথচ, ডিসি মেহতা এবং মোক্তার আলি কারও কোনও ধারণাই ছিল না ওই অঞ্চলের রাস্তাঘাট সম্পর্কে। কিন্তু তাঁরাই দুষ্কৃতীদের ছত্রভঙ্গ করতে গিয়ে রক্তপিপাসু ঘাতক বাহিনীর চক্রব্যূহে বন্দি হয়ে পড়লেন।

প্রাণ নিয়ে আর ধানখেতি মসজিদে থাকা সম্ভব নয় বুঝে ডিসি মেহতা এবং মোক্তার আলি মসজিদ থেকে বেরিয়ে এসে দৌড় লাগালেন বাতিকলের দিকে। তখন তাঁদের পিছনে ছুটছে উন্মত্ত সশস্ত্র দল। বাতিকলের গলিতে ঢুকে ডিসি সাহেব ও তাঁর দেহরক্ষী আলাদা হয়ে পড়লেন।

ডিসি মেহতা প্রাণ বাঁচাতে ঢুকে পড়লেন ২২২ নম্বর বাতিকল সেকেন্ড লেনের আব্দুল লতিফ খানের বাড়িতে। লতিফ খান কলকাতা পুলিশেরই কনস্টেবল পদে কর্মরত ছিলেন। কিন্তু সে সময় তিনি বাড়ীতে ছিলেন না। বাড়িতে তখন ছিলেন তাঁর বড় ছেলে হাদিস খান। মেহতা সাহেবের উর্দি দেখেই হাদিস খান বুঝে যান ইনি পুলিশের এক জন উচ্চপদস্থ অফিসার। হাদিস খান চোখের ইশারাতেই গোসলখানায় ভীত-সন্ত্রস্ত ডিসি মেহতাকে আশ্রয় নিতে বললেন। কিন্তু তত ক্ষণে তাঁদের বাড়ির মধ্যে ঢুকে পড়েছে রক্তের নেশায় উন্মত্ত প্রায় কুড়ি জনের বাহিনী। আব্দুল লতিফের গোসলখানায় নৃশংস ভাবে মারা হল ডিসি মেহতাকে।

ময়নাতদন্তের রিপোর্টে পাওয়া গিয়েছিল ২২টা তলোয়ার আর ছুরির আঘাতের নির্মম ক্ষতচিহ্ন।

এর পর জল্লাদেরা ডিসি মেহতার নিথর-উলঙ্গ দেহ ১/৫৯ ও ২০০ নম্বর আটাবাগ লেনের বাড়ির পিছনের নর্দমায় ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল। অন্য দিকে মোক্তার আলি প্রাণভয়ে আশ্রয় নিতে ঢুকে পড়েছিল জি ২২৮/৩ বাতিকল সেকেন্ড লেনের মহঃ নউমুল্লার বাড়ীর বাথরুমে। সেখান থেকে ঘাতক বাহিনী তাঁকে টেনে বের করে ধানখেতি ময়দানে এনে ছুরি আর তলোয়ার দিয়ে নৃশংস ভাবে খুন করল। শুধু তাই নয়, রক্তাক্ত নিথর দেহ থেকে হাত-পা কেটে নিয়ে অবশিষ্ট দেহ জ্বালিয়ে দেওয়া হল।

এক জন আইপিএস অফিসার এবং তাঁর দেহরক্ষী দিনদুপুরে শহরের বুকে এই ভাবে খুন হয়ে যাওয়ায় তৎকালীন পুলিশ প্রশাসনের কর্তারা নড়েচড়ে বসলেন। আলিপুরের তৃতীয় অতিরিক্ত দায়রা আদালতে মোট ৪৩ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দাখিল করা হল। যার মধ্যে ১৪ জন ছিল অপ্রাপ্তবয়স্ক। সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে আদালত বেশ কয়েক জন অভিযুক্তকে মুক্তি দেয়। শুধুমাত্র আট জনের শাস্তি হল। অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ভাবে মোক্তার আলি হত্যাকাণ্ডের প্রমাণ পুলিশ আদালতের কাছে পেশ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছিল।

তার পর পঁয়ত্রিশটা বছরের ক্যালেন্ডারের পাতা পাল্টে গিয়েছে। সে দিনের সেই নারকীয় হত্যালীলা এত দিনে ঠাঁই পেয়েছে নাগরিক সমাজের স্মৃতির সমুদ্রের গভীরতম অতলে। পৃথিবীর আবর্তনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পাল্টে গিয়েছে ভৌগোলিক অবস্থান। বদলে গিয়েছে নাম। মৃত্যুর মিছিলটা শুধু একই আছে।

ঘৃণ্য চক্রান্ত আর রাজনৈতিক অভিসন্ধিরও বদল হয়নি এতটুকু। এমনিভা বেই বিনোদ মেহতা, মোক্তার আলি, সুবোধ কুমার সিং-রা মরে ‘ভ্যানিস’ হয়ে যায় কালো রাত্রির করাল গ্রাসে। আর এমন নৃশংস হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যের মানুষ জন নিষ্কলুষ শিরোপা নিয়ে বীরদর্পে দাঁড়িয়ে থাকে এই বিশ্বায়নের সূর্যোদয়ের সম্মুখে!

কে জানে, ধর্মের আধারে ভরে শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার তাগিদে আরও কত-শত নির্ভীক মানুষ জনের কর্তব্যনিষ্ঠা এ ভাবেই স্তব্ধ হয়ে যাবে! হিংসার সময় বদলায়, কিন্তু চেহারা তো একই রয়ে গিয়েছে আজও এই দেশে।

রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট, ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ অ্যাডভান্সড স্টাডি

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

অন্য বিষয়গুলি:

Life Garden reach
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE