Advertisement
E-Paper

‘অন্য’ ভারত

ইতিহাস বলে, ঋকবৈদিক যুগে পৌরোহিত্যের অধিকারটি শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের ছিল না। যিনি পূজার্চনা করিতেন, তিনিই ব্রাহ্মণ, যিনি দেশরক্ষা করিতেন, তিনিই ক্ষত্রিয়। চারিটি বর্ণের বর্ণাশ্রম ছিল কর্মনির্ধারিত, জন্মনির্ধারিত নহে।

শেষ আপডেট: ২৬ মার্চ ২০১৯ ০০:০১
শালতোড়ার গ্রামে সরস্বতী পুজো করছেন রমণী কিস্কু ও শিউলি বাউড়ি (সামনের সারিতে)। —নিজস্ব চিত্র।

শালতোড়ার গ্রামে সরস্বতী পুজো করছেন রমণী কিস্কু ও শিউলি বাউড়ি (সামনের সারিতে)। —নিজস্ব চিত্র।

একটি বিপ্লব ঘটিতেছে। নিঃশব্দে। বিপ্লবের পরিসরটি হয়তো বৃহৎ নহে। কিন্তু সামাজিক তাৎপর্যটি বিরাট। যে পেশাকে এ যাবৎকাল ব্রাহ্মণ পুরুষরাই শাসন করিয়াছেন, সেই পৌরোহিত্যের পেশায় প্রবেশের জন্য অব্রাহ্মণ নারীরা হাতেখড়ি দিতেছেন। বাঁকুড়ার শালতোড়ার ঘটনা। নিজেকে পুরোহিত করিয়া তুলিতে রীতিমতো প্রশিক্ষণ লইতেছেন তাঁরা। শিখিতেছেন সংস্কৃত মন্ত্র, পূজাপদ্ধতি, হোম-যজ্ঞের খুঁটিনাটি। খুব সচেতন ভাবে যে তাঁহারা সমাজ পরিবর্তনে ব্রতী হইয়াছেন, তাহা নহে। অনেকেই হয়তো আর্থিক কারণে এই পেশায় আসিতে চাহিয়াছেন। কিন্তু অর্থনৈতিক বাধ্যতা দেবতাকে পূজিবার অধিকার বিষয়ে তাঁহাদের ভাবনাটির পরিবর্তন করিতে পারে নাই। যে ভাবনা বলে, শুদ্ধ উচ্চারণে, নিয়ম মেনে অন্তর হইতে পূজা করাটাই আসল। দেবতা তো বলেন নাই অব্রাহ্মণ নারী তাঁহার পূজা করিতে পারিবেন না।

ইহার অন্তর্নিহিত প্রশ্নটি হইল, দেবতার পূজায় জাত-লিঙ্গের ভেদ কেন? দেবতা সকলেরই। কিন্তু সমাজ তাহা স্বীকার করিলে তো! ইতিহাস বলে, ঋকবৈদিক যুগে পৌরোহিত্যের অধিকারটি শুধুমাত্র ব্রাহ্মণদের ছিল না। যিনি পূজার্চনা করিতেন, তিনিই ব্রাহ্মণ, যিনি দেশরক্ষা করিতেন, তিনিই ক্ষত্রিয়। চারিটি বর্ণের বর্ণাশ্রম ছিল কর্মনির্ধারিত, জন্মনির্ধারিত নহে। জন্মসূত্রে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য, শূদ্রের বর্ণাশ্রম পরবর্তী বৈদিক যুগের অবদান। সেই সময় হইতেই সমাজে উচ্চবর্ণ হিসাবে ব্রাহ্মণদের দাপট ক্রমশ বৃদ্ধি পাইতে থাকে এবং অন্য তিন বর্ণ পূজার্চনার অধিকার হারায়। সেই প্রথা এখনও সসম্মানে বর্তমান। অব্রাহ্মণের অধিকার শুধুমাত্র নিজ গৃহকোণের নিত্যপূজাটুকুতেই সীমাবদ্ধ। যেখানে দশের মঙ্গলের প্রশ্নটি জড়িত, সেখানে অব্রাহ্মণের গ্রহণযোগ্যতা কিছু ব্যতিক্রম ভিন্ন কার্যত নাই। অনেক শিক্ষিত পরিবারেও ঠাকুরঘরের শালগ্রাম শিলাটি পৈতেধারী ব্রাহ্মণ ভিন্ন কেহ স্পর্শ করিতে পারেন না। ব্রাহ্মণপুত্র বিকৃত উচ্চারণে ভুল মন্ত্র আওড়াইলেও পূজার দিনে তাহার চাহিদা তুঙ্গে উঠে। সংস্কৃতে পণ্ডিত অব্রাহ্মণের হাতে শুভ কার্যের দায়িত্ব সমর্পণ করিতে সমাজ এখনও দ্বিধাগ্রস্ত।

আর অব্রাহ্মণ পুরোহিত যদি মহিলা হন? বস্তুত এই দ্বিতীয় ক্ষেত্রে পরিবর্তনের অভিঘাতটি আরও তীব্র। কারণ নারীর সঙ্গে অশুচিতার ধারণাটি জড়াইয়া আছে। সাধারণ ধ্যানধারণায়, ঋতুমতী নারীর দেবতাকে স্পর্শের অধিকার নাই, শুভকার্যে যোগদানও কাম্য নহে। এই দেশই কেরলের শবরীমালায় মহিলাদের প্রবেশাধিকার লইয়া আয়াপ্পাভক্তদের তুমুল বিক্ষোভ প্রত্যক্ষ করিয়াছে কিছু মাস পূর্বেই। গত বৎসর সুপ্রিম কোর্ট শবরীমালা মন্দিরে ঋতুযোগ্য মহিলাদের প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা সত্ত্বেও এখনও সেখানে নারীর অনধিকার প্রবেশ লইয়া তুমুল চর্চা এবং বিক্ষোভ অব্যাহত। ঠিক এইখানেই শালতোড়ার রমণী কিস্কু, শিউলি বাউড়িদের কৃতিত্ব। তাঁহারা প্রথাগত চিন্তার এই জড়তাকে কাটাইয়া উঠিয়াছেন। অবশ্যই উল্লেখ্য শালতোড়ার গ্রামবাসীদের কথা। মেয়েদের দাবিকে তাঁহারা অগ্রাহ্য করেন নাই। বরং যতটুকু বাধা আসিয়াছিল, অন্যদের উৎসাহে সেইটুকুও দমিয়া গিয়াছে। সমাজবিজ্ঞানে বলে, ভারত কোনও একটি দেশ নহে, অনেক দেশ এবং অনেক সংস্কৃতি এখানে লুকাইয়া আছে। কথাটি যে কতখানি সত্য, বাঁকুড়ার প্রত্যন্ত অঞ্চলটি দেখাইয়া দিতেছে।

Society Priests Woman
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy