Advertisement
E-Paper

রোগীকে বোঝা আর বোঝানো

দুই ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের উপর রোগীর পরিবার আস্থা রাখেনি। তরুণ সেই চিকিৎসকের পিতা, নিজে এক কালের নামী ডাক্তার, বলেছেন, “রোগী এবং ডাক্তারের মধ্যেকার বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। আমাদের সময় এই বিশ্বাসটুকুর কোনও অভাব ছিল না।”

সুমন্ত ঘোষ মৌলিক ও তাজুদ্দিন আহ্‌মেদ

শেষ আপডেট: ১১ জুলাই ২০১৮ ০০:০৯

মফস্সলের ছোট নার্সিংহোমের তরুণ ডাক্তারের কপালে চিন্তার ভাঁজ। মাঝরাতে নার্সিংহোমে এসেছেন তাঁর চিকিৎসাধীন প্রসূতি। বিত্তশালী পরিবার। নির্দিষ্ট দিনে সিজ়ারিয়ান অস্ত্রোপচারে সন্তানকে পৃথিবীতে আনার পরিকল্পনা। কিন্তু পরিস্থিতি যা, তাতে অস্ত্রোপচারের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেওয়ার সময় নেই। স্বাভাবিক প্রসবপ্রক্রিয়ায় বা ফরসেপস ব্যবহার করে শিশুকে মাতৃগর্ভ থেকে বার করে আনা জরুরি। প্রসূতির পরিবার রাজি নয়। গত কালই আর এক প্রসূতির নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার কিছুতেই অস্ত্রোপচারে রাজি হয়নি, অথচ প্রসূতির অবস্থা ছিল জটিল। তাদের বক্তব্য, ডাক্তাররা অর্থের লোভে অকারণ অপারেশন করেন। দুই ক্ষেত্রেই চিকিৎসকের উপর রোগীর পরিবার আস্থা রাখেনি। তরুণ সেই চিকিৎসকের পিতা, নিজে এক কালের নামী ডাক্তার, বলেছেন, “রোগী এবং ডাক্তারের মধ্যেকার বিশ্বাসে চিড় ধরেছে। আমাদের সময় এই বিশ্বাসটুকুর কোনও অভাব ছিল না।”

সরকারি হাসপাতাল তো বটেই, ঝাঁ-চকচকে কর্পোরেট হাসপাতালগুলিতেও রোগীর পরিবারের সঙ্গে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং চিকিৎসকদের অশান্তি এখন নিত্যনৈমিত্তিক। এর অন্যতম কারণ চিকিৎসক তথা চিকিৎসার সংশ্লিষ্ট মানুষ ও প্রতিষ্ঠানগুলির উপর রোগীর আস্থার অভাব। পরিস্থিতি পরিবর্তনে রোগীর কিছুটা দায়িত্ব থাকলেও, চিকিৎসক সম্প্রদায়ের দায় অনেক বেশি।

হিপোক্রেটিস-এর যুগ থেকেই চিকিৎসা পদ্ধতি রোগী ও ডাক্তারের পারস্পরিক বিশ্বাসের ওপর বহুলাংশে নির্ভরশীল। চিকিৎসার এই ঘরানা ফিডিউশিয়ারি মডেল নামে পরিচিত। ল্যাটিন ‘ফিডিউশিয়া’ (বিশ্বাস) থেকে এসেছে এই নাম। এই পদ্ধতিতে ধরেই নেওয়া হয় যে, ডাক্তার যেটা করেন সেটা রোগীর ভালর জন্য করেন, এবং রোগী ডাক্তারের সিদ্ধান্ত ও চিকিৎসা বিনা প্রশ্নে মেনে নেবেন। বহু শতক ধরে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশে রোগী ও চিকিৎসকের সম্পর্ক এই পথেই চলেছে।

গত শতক থেকে অবস্থা বদলায়। ১৯১৪ সালে স্লোয়েনডর্ফ বনাম সোসাইটি অব নিউ ইয়র্ক হসপিটাল মামলায় যুগান্তকারী রায় দেয় নিউ ইয়র্ক কোর্ট অব অ্যাপিলস। স্লোয়েনডর্ফের সম্মতি না নিয়ে করা অস্ত্রোপচার চিহ্নিত হয় রোগীর শরীরের সার্বভৌমতার পরিপন্থী অপরাধ হিসেবে। এর পর প্রচলিত হয় ‘পেশেন্ট অটোনমি’ মডেল, যেখানে চিকিৎসার ব্যাপারে রোগীর মতামত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। পশ্চিমি দেশগুলিতে, এখন বহু ক্ষেত্রে ভারতেও, কর্পোরেট হাসপাতালগুলিতে জনপ্রিয় হয়েছে ‘শেয়ারড ডিসিশন-মেকিং’ মডেল। এতে ডাক্তার রোগী ও তাঁর পরিবারকে চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয়ে অবহিত করেন। রোগীও জানান তাঁর আর্থিক সামর্থ্য, রোগের ইতিহাস, পছন্দ ইত্যাদি বিষয়ে। উভয় পক্ষের মত ও প্রয়োজনের মধ্যে সামঞ্জস্য রেখে যৌথ ভাবে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

ভারতে চিকিৎসকরা এখনও প্রধানত ফিডিউশিয়ারি মডেল অনুসরণ করেন। রোগী নিজেকে ডাক্তারবাবুর (এবং ভবিতব্যের) হাতে সমর্পণ করেন। তবে রোগের প্রকৃতি, চিকিৎসার পদ্ধতি, তার ব্যয় ইত্যাদি বিষয় বুঝে নেওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। এর পিছনে আছে চিকিৎসা পরিষেবার বাণিজ্যিকীকরণ, এক শ্রেণির চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর মানবিকতা ও দায়িত্ববোধের অভাব, নানা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মুনাফার লোভ, সরকারি স্বাস্থ্য-পরিষেবার অপটু পরিকাঠামো ইত্যাদি জটিল সব কারণ। রোগী ও চিকিৎসকের যোগাযোগ ও মতবিনিময় আজ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অথচ তা প্রবল অবহেলিত এই রাজ্যে তথা দেশে।

চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ্যক্রমের মূলত তিনটি উপাদান। প্রথমটি ‘কগনিটিভ ডোমেন’ সম্পর্কিত; এতে ছাত্র চিকিৎসা-সংক্রান্ত যাবতীয় জ্ঞান আহরণ করেন। দ্বিতীয় অংশে ছাত্র সেই জ্ঞানকে বাস্তবে প্রয়োগ করতে শেখেন। এই সুপ্রয়োগের দক্ষতাকে বলা হয় ‘সাইকোমোটর স্কিল’। তৃতীয়টি ‘অ্যাফেক্টিভ ডোমেন’ সম্পর্কিত; ছাত্র সেখানে মনোযোগ, আগ্রহ, পরিস্থিতির মূল্যায়ন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ, মূল্যবোধের প্রয়োগ ইত্যাদি বিষয় রপ্ত করেন। ভারতে চিকিৎসাবিদ্যার প্রচলিত পাঠ্যক্রমে তৃতীয় অংশটি অবহেলিত। মনে করা হয়, ছাত্ররা কিছুটা ব্যক্তিগত চরিত্রগুণে, কিছুটা শিক্ষক এবং অগ্রজদের দেখে বিষয়গুলি শিখে নেবেন। তা যে হয়ে ওঠে না তার প্রমাণ প্রতি দিন আমরা পাচ্ছি।

রোগী যখন চিকিৎসকের কাছে আসেন, তাঁর শারীরিক অবস্থা, রোগের উপসর্গ, বিস্তার, এই সব পর্যবেক্ষণ করেন চিকিৎসক, সেই অনুযায়ী নিদান দেন। তার সঙ্গে লক্ষ করেন (অনেক সময় অসচেতন ভাবেই) রোগীর শরীরী ভাষা, বাচনভঙ্গি, পোশাকআশাক, আবেগ অনুভূতি, সবই। শেষোক্ত পর্যবেক্ষণগুলি ‘অ্যাফেক্টিভ ডোমেন’-এর অংশ, রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যে যোগাযোগের ক্ষেত্রে এর গুরুত্ব অসীম। দুই ধরনের পর্যবেক্ষণ মিলিয়ে রোগী সম্পর্কে চিকিৎসকের সম্যক ধারণা তৈরি হয়, যার প্রতিফলন ঘটে চিকিৎসায় এবং রোগীর প্রতি তাঁর আচরণে। এই ধারণা এবং তার প্রতিফলনের সাযুজ্য থাকলে চিকিৎসা ঠিক পথে এগোয়, রোগী ও চিকিৎসকের সুসম্পর্কও বজায় থাকে।

যোগাযোগ, মতবিনিময় ও পরিস্থিতি বিচারে ঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া, চিকিৎসাবিদ্যা শেখার পাশাপাশি সুচিকিৎসকের যোগ্য আচরণ করা— ‘অ্যাফেক্টিভ ডোমেন’-এর অন্তর্গত নানা বিষয়ের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব মনে রেখে চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ্যক্রমে, ধীর গতিতে হলেও, পরিবর্তনের চেষ্টা শুরু হয়েছে। ভোগবাদের এই দাপটের কালে রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা সহজ নয়। অতীতের কিংবদন্তি সব ডাক্তার, যাঁরা পরিবারের সদাসতর্ক শুভানুধ্যায়ীর মতো বিরাজ করতেন, তাঁদের সেই পিতৃসুলভ সহানুভূতির সংস্কৃতি হারিয়ে গিয়েছে। কিন্তু রোগী এবং চিকিৎসকের মধ্যে যুক্তিসঙ্গত ভাব বিনিময়ের সংস্কৃতিটুকু ফিরিয়ে আনা সম্ভব। তার মধ্যেই রয়েছে বেহাল স্বাস্থ্য পরিষেবার অনেক রোগের উপশম।

সুমন্ত ঘোষ মৌলিক বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজে শিক্ষক।

তাজুদ্দিন আহ্‌মেদ আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক

Relationship patient
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy