এনআরসি তালিকা নিয়ে আধিকারিকরা। নিজের নাম এনআরসি-তে আছে কিনা, জানতে জানালায় ভিড় অসমবাসীর। ছবি: রয়টার্স
এই মুহূর্তে অসমে নাগরিক পঞ্জির বিরুদ্ধে যাঁহারা সমালোচনার ঝড় উঠাইতেছেন, তাঁহাদের অনেকেই জানেন এবং স্বীকার করেন যে এমন একটি পঞ্জি আসলে রাষ্ট্রের পক্ষে সত্যই প্রয়োজনীয়। বিরোধী দল কংগ্রেস যখন শাসকের ভূমিকায় ছিল, তখন হইতেই এমন পঞ্জির কথা ভাবা হইয়া আসিয়াছে। কারণটি সহজ। বিরাট পরিমাণ উদ্বাস্তুসংখ্যা যে কোনও দেশের পক্ষে সামাজিক, অর্থনৈতিক, এমনকি রাজনৈতিক ভাবেও সঙ্কটজনক হইতে পারে। তদুপরি যদি বেআইনি উদ্বাস্তু অর্থাৎ অনুপ্রবেশকারীর সংখ্যা হুহু করিয়া বাড়িতে থাকে, তবে তো সেই সঙ্কট অনেক গুণ বাড়িয়া যায়। বিশ্বের অনেক দেশই বর্তমানে এই সঙ্কটের সঙ্গে জুঝিতেছে, এই সঙ্কট তাহাদের সঙ্কটান্তরেও লইয়া যাইতেছে। মূল প্রশ্নটি নাগরিক পঞ্জি লইয়া নহে। প্রশ্নটি আসলে তাহা তৈরি করিবার পদ্ধতি বিষয়ে। এমন একটি পদ্ধতিতে যদি নাগরিকদের অস্তিত্বের হিসাব লওয়া হয় যাহাতে একটি প্রদেশ হইতেই চল্লিশ লক্ষ মানুষ অবলীলায় বাদ পড়িয়া যান, তবে বিস্ময়ভ্রু কুঞ্চিত হইবেই। অনেক দশকের বাস সত্ত্বেও কেবল কিছু কাগজপত্র না থাকিবার কারণে যদি অক্ষরজ্ঞানহীন দারিদ্র-নিমজ্জিত অসংখ্য মানুষ নিজেদের নথিভুক্ত না করাইতে পারেন, বলিতেই হয় যে সেই পদ্ধতি ত্রুটিপূর্ণ। সে ধরনের পঞ্জির উপর ভিত্তি করিয়া সরকার দ্রুত পদক্ষেপ করিলে, কিংবা পদক্ষেপ করিবার কথা ভাবিলে বলিতে হয়, ব্যাপারটি বিশেষ ভাবে অমানবিক। সর্বোপরি, এই নাগরিক পঞ্জির যোগ-বিয়োগের মধ্যে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘু ইত্যাদি হিসাব ঢুকিয়া আসিলে তাহা বিপজ্জনক দাঁড়ায়। সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক রাজনীতি রাষ্ট্রিক কাজটিকে দুর্গন্ধলাঞ্ছিত করে। সংক্ষেপে, নাগরিক পঞ্জির কাজটি প্রয়োজনীয় হইলেও অত্যন্ত সংবেদনশীল। সেই সংবেদন চুলায় দিয়া বিজেপি সরকার যে ভাবে কাজটি সম্পাদন করিতেছে, তাহা ভারতীয় রাষ্ট্রের পক্ষে কলঙ্কজনক।
সঙ্কীর্ণ রাজনীতিই যে এ কাজের পিছনে প্রধান চালক-বাহক, কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন ধরনের বক্তব্যের মধ্য দিয়া তাহা স্পষ্ট। কেহ বলিতেছেন, এ বার বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের মজা দেখাইয়া দিবেন, কেহ বলিতেছেন বেআইনি উদ্বাস্তুদের গুলি করিয়া মারিবেন— আর দলের সর্বভারতীয় সভাপতি সর্বসমক্ষে বুক চাপড়াইয়া বলিতেছেন, কেবল তাঁহার দলেরই হিম্মত আছে উদ্বাস্তু-কবল হইতে সম্পদ ছিনাইয়া নাগরিকদের নাগালে আনিয়া দিবার। উদ্বাস্তু বনাম নাগরিক লড়াইটি লাগাইয়া দিবার প্রচেষ্টার সঙ্গে সঙ্গেই ‘অন্যান্য দেশের সংখ্যালঘুদের’ উদ্দেশে এ দেশে চলিয়া আসিবার আহ্বান শোনা যাইতেছে। বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ বন্ধ করিবার হুঙ্কারের পাশে এই আহ্বানটি বুঝাইয়া দেয়, হিন্দু-মুসলমান তফাত বাড়ানোই পঞ্জি-নীতির প্রধান নির্ধারক।
উদ্বেগের কথা— উল্টা দিকে উদগ্র পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর স্বরটি। সেই স্বরেও সংবেদনের অপেক্ষা রাজনীতির ঝঙ্কার বেশি। সংখ্যালঘু ‘সুরক্ষা’য় মনোযোগী নেত্রী অনুপ্রবেশকে সমস্যা বলিয়াই স্বীকার করিতেছেন না। দুই দিকে দুই ‘ভোটব্যাঙ্ক’ রাজনীতি, মাঝখানে হারাইতে বসিয়াছে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটি: কেন একটি বিশেষ সময়ের আগে আসিলেই কোনও ব্যক্তি নাগরিক হিসাবে গণ্য, অন্যথা নহেন? এই পদ্ধতি কি অতিমাত্রায় যান্ত্রিক ও অমানবিক নহে? সমাধান চাই বলিয়া কি যে কোনও রাস্তাই সমাধান বলিয়া মান্য? ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতি কি এতটাই বিপজ্জনক রকমের ফাঁপা হইয়া পড়িয়াছে? সংবেদনশীল মানবিক বিবেচনার পরিবর্তে রাজনৈতিক স্বার্থান্ধ বিবেচনা লইয়া পঞ্জি তৈরির কাজটি করিলে ভারত দ্রুত আর একটি মায়ানমার হইয়া উঠিতে পারে। লক্ষকোটি মানুষের নাগরিক পরিচয় কাড়িয়া আরও বিশালাকার আন্তর্জাতিক সঙ্কট তৈরি করিতে পারে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy