প্রতীকী ছবি।
করোনা অতিমারির সহিত শহর-গ্রামে বহু পরিবারে নিঃশব্দে কোপ বসাইতেছে অন্য এক ব্যাধি— নাবালিকা বিবাহ, তথা নাবালিকা পাচার। লকডাউন-পর্বের মাসগুলিতে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনা, এই দুইটি জেলায় অন্তত সত্তরটি নাবালিকা বিবাহ রুখিয়াছে জেলা প্রশাসন। ইহা হিমশৈলের চূড়ামাত্র। জেলা প্রশাসনের নিকট যে কয়টি বিবাহ-উদ্যোগের সংবাদ আসিয়াছে, তাহার বহু গুণ বিবাহ নিশ্চুপে ঘটিয়া গিয়াছে। এবং ইহাও প্রায় নিশ্চিত যে, এই সকল বিবাহের একটি বড় অংশ বস্তুত মেয়ে পাচারের প্রথম ধাপ। বিবাহ অনুষ্ঠানটি সেই মর্মান্তিক অপরাধের উপর বৈধতার আচ্ছাদনমাত্র। প্রথাটি পুরাতন। কোনও বিপর্যয়ে পড়িলেই কন্যাকে ‘পার’ করিয়া বোঝা নামাইবার ইতিহাস যেমন করুণ, তেমনই দীর্ঘ। তেতাল্লিশ সালের মন্বন্তরের পর বাংলার গ্রামগুলি হইতে অগণিত নাবালিকা ও নারীর স্থান হইয়াছিল নানা শহরের গণিকালয়ে। তাহাদের পরিবার সামান্য মূল্যে তাহাদের বিক্রয় করিয়াছিল, অথবা বিনা বরপণে কন্যাদান করিয়া খাদ্য জোগাইবার দায় হইতে নিষ্কৃতি পাইয়াছিল। স্বাধীন ভারতেও বৃহৎ মাপের বিপর্যয়ের পর দারিদ্র তীব্র হইবার সঙ্গে সঙ্গে মেয়েদের জীবনে বিপর্যয় নামিয়া আসিয়াছে। গঙ্গার ভাঙন হইতে বন্ধ চা বাগান, সর্বত্রই মেয়েরা হারাইয়া গিয়াছে বড় বড় শহরে, নিরন্তর অবমাননা ও নির্যাতনের অন্ধকারে। এই পরিণাম এমনই প্রত্যাশিত যে, লকডাউন ঘোষণার পরে শিশু অধিকার সুরক্ষা কমিশন আগাম সতর্কবার্তা জারি করিয়াছিল জেলাগুলিতে।
কিন্তু পাচার থামানো যায় নাই। বহু দিনের বহু পরিশ্রমে বালিকা ও কিশোরীদের শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের যেটুকু জমি উদ্ধার করা গিয়াছিল, তাহা ফের জবরদখল করিয়াছে পুরুষতন্ত্র। নারী পাচার ও বালিকাবিবাহ প্রতিরোধের আইন, তাহার প্রয়োগের জন্য নির্দিষ্ট আধিকারিক লইয়াও সরকার ব্যর্থ। অসরকারি সংস্থাগুলিও অসহায়। ইহার কারণ অনেক। প্রথমত, নাবালিকা বিবাহের প্রতি সমর্থনের চোরাস্রোত সমাজে বরাবরই রহিয়াছে। কখনও ধর্ম, কখনও জাতপাত, কখনও পারিবারিক মর্যাদা— এমন নানা ভেক ধরিয়া পুরুষতন্ত্র মেয়েদের জীবনসঙ্গী নির্বাচনের ক্ষমতা নস্যাৎ করিতে চাহে। দ্বিতীয়ত, কলিকাতা বহু দিন হইতে ভারতে আন্তর্জাতিক পাচারকারীদের প্রবেশদ্বার। নাবালিকা পাচারে পশ্চিমবঙ্গের স্থান প্রায় শীর্ষে। পাচারচক্রগুলি রাজনৈতিক নেতা, পঞ্চায়েত সদস্য ও পুলিশ, সকল পক্ষের ঘনিষ্ঠ ও প্রশ্রয়প্রাপ্ত বলিয়া অভিযোগ। বিপর্যয়ের সময়ে রাষ্ট্র ও সমাজের অন্যমনস্কতার সুযোগ লইয়া সেগুলি অতিশয় সক্রিয় হইয়াছে। বিশেষত লকডাউন ও আমপান-জনিত বিপর্যয়ে পুলিশের ব্যস্ততা বাড়িয়াছে। সুযোগ বুঝিয়া বাড়িয়াছে নারীর বিরুদ্ধে অপরাধ।
সর্বোপরি, স্কুল দীর্ঘ দিন বন্ধ থাকিবার ফলে মেয়েদের বিপন্নতা বাড়িয়াছে। স্কুল চলিলে সহজেই ছাত্রীর অনুপস্থিতি লক্ষিত হয়। বহু নাবালিকা বিবাহ-উদ্যোগের আগাম সংবাদ শিক্ষকই সর্বপ্রথম পাইয়াছেন। গ্রামে কিশোরীদের সামাজিক সংযোগের একটিই উপায়, তাহা স্কুল। শিশুর সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করিবার প্রধান প্রতিষ্ঠান তাহার বিদ্যালয়। শিশুশ্রম, যৌননির্যাতন, অকাল-বিবাহ, নাবালিকা পাচার হইতে শিশুদের বাঁচাইতে স্কুলের বিকল্প নাই। স্কুল সচল না হইলে মেয়েদের বিপন্নতা কমিবে না।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy