Advertisement
E-Paper

হনুমানের পিঠেই তো ভারততীর্থ

হনুমান বেদজ্ঞ, তাঁর মা অঞ্জনা লেখাপড়া শিখতে ছেলেকে সূর্যের কাছে পাঠিয়েছিলেন। হনুমান আকাশে গেলেন এবং সূর্য তাঁকে দেখে ভয় পেলেন।

গৌতম চক্রবর্তী

শেষ আপডেট: ০৬ ডিসেম্বর ২০১৮ ০০:০০

উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ভোটের নেশায় বলে দিয়েছেন, হনুমান এক জন দলিত। এই শুনে অনেকে আবার রে-রে করে প্রতিবাদ জানিয়েছেন, মোটেও না, হনুমান আসলে জঙ্গলের জনজাতি। আবার এমন রবও উঠেছে যে, হনুমান আসলে আর্য।

তা, হনুমান নিয়ে এমন বিভ্রান্তি হবে না তো কাকে নিয়ে হবে? তাঁর লীলা অপার। সেই কাহিনিটাই ধরুন না! হনুমান বেদজ্ঞ, তাঁর মা অঞ্জনা লেখাপড়া শিখতে ছেলেকে সূর্যের কাছে পাঠিয়েছিলেন। হনুমান আকাশে গেলেন এবং সূর্য তাঁকে দেখে ভয় পেলেন। ছোটবেলায় এই বালকই তাঁকে সুস্বাদু ফল ভেবে খেতে গিয়েছিল যে! কিন্তু হনুমান তো এখন বিনয়ী বিদ্যার্থী। ছেলেবেলার কথা মনেও নেই। সূর্যদেবকে প্রণাম করে জানালেন, তাঁর কাছে তিনি বেদবেদান্ত, ব্যাকরণ শিখতে এসেছেন। সূর্য বললেন, ‘‘আমাকে তো দিবারাত্র কাজ করতে হয়। তোমাকে পড়ানোর সময় কোথায় পাব?’’ হনুমান গুরুর মুশকিল আসান করে দিলেন। ঠিক হল, তিনি সূর্যের রথের আগে আগে ছুটবেন, কিন্তু মুখ থাকবে রথের দিকে, সূর্যের থেকে যা কিছু শোনার শুনতে শুনতে রথের সমান বেগে পিছন দিকে ছুটবেন। সূর্যের রথ বাধা পাবে না। স্মৃতিধর হনুমান, এক বার শুনলেই তাঁর সব কিছু মনে থাকে। কিন্তু সূর্যের দিকে মুখ করে ব্যাক গিয়ারে ছুটছিলেন বলেই তো মুখটা পুড়ে কালো হয়ে গেল।

গল্পটা আছে ‘হনুমান বাহুক’ গ্রন্থে। লোকবিশ্বাস, এই বইও তুলসীদাসের লেখা। লেখা যাঁরই হোক, পরীক্ষার মরসুমে বারাণসীর যে কোনও হনুমান মন্দিরে গেলেই বিশ্বাস মর্মে মর্মে মালুম হয়। ছাত্রছাত্রীরা অনেকেই সেখানে মানত করতে আসে। পরীক্ষা পাশের জন্য।

জনজাতির গল্পও বেশ কিছু অসংস্কৃত, অর্বাচীন রামায়ণে আছে। অযোধ্যায় মানুষবেশে রামচন্দ্র জন্মেছেন, কৈলাস পর্বত থেকে শিব স্বয়ং হনুমানকে নিয়ে গেলেন সেখানে দেখা করতে। শিব দশরথের প্রাসাদে গেলেন ছাইভস্মমাখা মাদারির বেশে, ডমরু নিয়ে বানরখেলা দেখাতে দেখাতে। সে সব দেখার পর শিশু রামচন্দ্র কান্না জুড়লেন, বানরটা দাও না! শিব অন্তর্হিত হলেন। হনুমান রামচন্দ্রের খেলার সঙ্গী হয়ে গেলেন। বিশ্বামিত্র তাড়কা বধের জন্য রামকে জঙ্গলে নিয়ে যেতে চাইলে রামচন্দ্র হনুমানকে বিদায় দিলেন। গোপনে জানালেন, ‘‘এখন কিষ্কিন্ধ্যায় গিয়ে সুগ্রীবের কাছে থাকো। পরে দেখা হবে।’’

গল্প আরও আছে। হনুমান কি শুধুই পবনপুত্র? কৈলাস পর্বতে রামভক্ত শিব রামের নামে ধ্যান করছেন। ধ্যান ভেঙে উঠে স্ত্রী পার্বতীকে জানালেন, তাঁর উপাস্য রামচন্দ্র অযোধ্যায় জন্মেছেন। তিনি তাঁকে সাহায্য করতে মর্তে যাবেন। অতঃপর বৌরা যা যা বলেন, ‘‘আমি তা হলে একা কৈলাসে কী ভাবে থাকব’’ স্বামীকে শুনিয়ে দিলেন পার্বতী। শিব বললেন, তা হলে তাঁর একটি অংশ মর্তে রামচন্দ্রকে সাহায্যের জন্য অবতীর্ণ হবে। সেই অংশাবতারই হনুমান! পার্বতী আপত্তি করলেন, ‘‘বানরের রূপ কেন?’’ শিব জানালেন, প্রভু মানুষরূপে জন্মেছেন, ফলে তাঁর দাস হতে গেলে মনুষ্যেতর কোনও রূপ তাঁকে ধারণ করতে হবে। আর মায়া, মোহ কাটাতে বানরের রূপই ভাল। পার্বতী জানালেন, তা হলে বানরের লেজে তিনি অধিষ্ঠান করবেন। হনুমানের লেজ এই কারণেই শক্তির অন্য রূপ, তার আগুনে লঙ্কাপুরী পুড়ে ছারখার হয়ে যায়।

তার পর পবনপুত্রের গল্পটা? বানররাজ কেশরীর স্ত্রী অঞ্জনা বনপথে যাচ্ছিলেন, বায়ু তাঁর বস্ত্রহরণ করে। সেই কামতাড়িত পবনদেবের পুত্রই হনুমান। স্থানীয় এক রামায়ণের গল্পে আছে, এক মঙ্গলবারে পুত্র যখন জন্মালেন, তাঁর পরনে সন্ন্যাসীদের মতো বজ্রকৌপীন। গলায় মুঞ্জা ঘাসের পৈতে। কানে যোগীদের মতো কুণ্ডল। অষ্টসিদ্ধিপ্রাপ্ত হঠযোগী বলেই তো শরীরটাকে তিনি ইচ্ছা মতো বাড়িয়ে এক লাফে সমুদ্র পেরোতে পারেন, আবার কখনও এইটুকু হয়ে লঙ্কাপুরীতে ঢুকে যান। সন্ন্যাসযোগ, শিব, বিষ্ণু, সব উত্তরাধিকার মিলে গিয়েছে হনুমানের চরিত্রে।

বোঝা যায়, বৈদিক দেবতা পবন যখন মর্যাদা হারালেন, হনুমানকে নিয়েই স্থানীয় স্তরে এই সব লোককথা তৈরি হয়, আর আঁকাবাঁকা সেই বহু ধারা মিলে যায় রামায়ণের মহাসমুদ্রে। রামায়ণ, মহাভারত এখানেই চমকপ্রদ। তাদের বয়ান এক নয়, বহু। বহু স্রোতে প্রবহমান, জীবন্ত ঐতিহ্য।

স্থানীয় হনুমান-তীর্থের জন্য যেমন ব্রহ্মপুরাণ ঘাঁটা যেতে পারে। সেখানে আছে, দেবরাজ ইন্দ্রের সহস্র চক্ষু নিয়ে অঞ্জনা ঠাট্টা করেছিলেন। ফলে ইন্দ্র তাঁকে অভিশাপ দেন। হনুমান মাকে গোদাবরী বা গৌতমীগঙ্গায় স্নান করিয়ে শাপমুক্ত করেন। মহাভারতে হিমালয়ের অরণ্যে হনুমানের সঙ্গে ভীমের দেখা হয়েছিল, লৌকিক রামায়ণে হনুমান দাক্ষিণাত্যেও যান। আদিত্যনাথ জানেন না, তাঁর বিরোধীরাও জানেন না— হনুমান খাঁটি আর্য না দলিত, জনজাতি না বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ, উত্তর ভারতীয় না ইডলি-সম্বরখেকো দক্ষিণ ভারতীয়, এ সব তর্কই অবান্তর। হনুমানের পিঠে চড়েই অটুট আমাদের জাতীয় সংহতি।

পুরীর মন্দিরের কথাও মনে করে দেখতে পারেন। সেখানে দক্ষিণ দেউড়ির নাম হনুমানদ্বার। হনুমান আছেন বলেই সমুদ্রের গর্জন মন্দিরের অভ্যন্তরে পৌঁছয় না। গল্প, হনু এক বার মন্দিরের ভিতরে জগন্নাথ দর্শনে গিয়েছিলেন। সমুদ্রগর্জনে ভক্তরা তখন বিধ্বস্ত। জগন্নাথ এসে হনুমানকে বেঁধে রাখার নিদান দিলেন। কিন্তু কোন শিকল বাঁধবে তাঁকে? অগত্যা রামনাম লেখা শিকলে জড়িয়ে দেওয়া হল তাঁকে, তার পর থেকে হনুমান আর দরজা ছেড়ে অন্যত্র যান না। বিস্মৃত এই গল্পই বাংলায় ‘‘এই হনুমান কলা খাবি/ জয় জগন্নাথ দেখতে যাবি’’ ছড়ার উৎস কি না, সংস্কৃতি-গবেষকরা ভেবে দেখতে পারেন।

উত্তর থেকে দক্ষিণ, আসমুদ্রহিমাচল ছড়িয়ে আছে এই সব স্থানীয় গল্প। স্বভাবতই, ভারতবর্ষে রামের থেকেও হনুমানের মন্দির বেশি। মাথার ওপর ছাদ থাকুক বা না-থাকুক, রাস্তার ধারে, বটগাছের নীচে তেলসিঁদুরমাখা বজরংবলীর মূর্তিটি অবশ্যই থাকবে। বজরংবলী অবশ্য চলতি শব্দ। এই শব্দের উৎসে আছে বজ্র-অঙ্গ-বলী। বজ্রের মতো সুগঠিত অঙ্গ যাঁর।

শেষ গল্পটা বলা যাক। বিশ শতকেও সীতারাম নামে এক লেখক হিন্দি ভাষায় ‘অওধ কি ঝাঁকি’ নামে একটি বই লিখেছিলেন। সেখানে রামচন্দ্রের ১৮ লক্ষ বানরসৈন্যকে মা জানকী আশীর্বাদ করেন, ভবিষ্যতে তারা ইংরেজ নামে পরিচিত হবে। রাক্ষসী ত্রিজটা অশোকবনে সীতাকে রাবণের হেনস্থা থেকে বাঁচিয়েছিল, সীতা তাঁকেও আশীর্বাদ দিলেন, ‘‘সেই কল্পে তুমিই হবে ওদের মহারানি। তোমার নাম হবে ভিক্টোরিয়া।’’

তা হলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? হনুমান দলিত না জনজাতি, আর্যপুত্র না লালমুখো ইংরেজ?

Mythology Lord Hanuman Politics BJP Yogi Adityanath
Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy